নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিসাববিজ্ঞান - আর্থিক বিবরণী | NCTB BOOK

বিশদ আয় বিবরণী এবং আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুতকরণে হিসাববিজ্ঞানের কিছু নিয়ম নীতি মানা হয়। সঠিকভাবে লাভ-ক্ষতি এবং সম্পদ ও দায়-দেনার পরিমাণ নিরূপণ করতে হলে এই নিয়ম নীতি অনুসরণ অবশ্যকরণীয়।

১) ব্যবসায়িক সত্তা নীতি (Entity) : ব্যবসায়ের মালিককে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথক বিবেচনা করা হয়। তাই মালিকের নামে হিসাব না রেখে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নামে যাবতীয় হিসাব রাখা হয়। এজন্য মালিক কর্তৃক প্রদত্ত মূলধন ব্যবসায়ের একটি দায়। একই কারণে মালিক কর্তৃক উত্তোলন তার নিজস্ব খরচ, যা তা মূলধনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

২) চলমান প্রতিষ্ঠান ধারণা ( Going Concern) : এ ধারণা অনুযায়ী কিছু নির্দিষ্ট মেয়াদি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকাল ধরে চলমান থাকবে বলে ধরে নেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর চলবে এবং ভবিষ্যতে এ ব্যবসা বন্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই। এই নীতির কারণে আয় ও ব্যয়কে মূলধন ও মুনাফা জাতীয় দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। মূলধন জাতীয় আইটেমসমূহ দ্বারা আমরা আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুত করি। তাই স্থায়ী সম্পত্তির ক্ষেত্রে তার জীবনকাল পর্যন্ত প্রতিবছর অবচয় ধরতে হয়। এই নীতি না থাকলে আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুত করা সম্ভব হতো না এবং অবচয় ধরারও প্রয়োজন হতো না।

৩) হিসাবকাল ধারণা (Periodicity) : চলমান নীতি অনুযায়ী ব্যবসায়ের নির্দিষ্ট কোনো আয়ুষ্কাল নেই। কিন্তু আর্থিক অবস্থা জানতে অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা যায় না। তাই প্রতি বছরই আর্থিক অবস্থা জানার জন্য বিশদ আয় বিবরণী ও আর্থিক অবস্থার বিবরণী প্রস্তুত করা হয়। প্রতিষ্ঠানের অনন্ত আয়ুষ্কালকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমান অংশে ভাগ করে নেওয়া হয়। একেকটি ভাগকে হিসাবকাল বলে। হিসাবকাল সাধারণত এক বছর মেয়াদি হয়।

৪) বকেয়া ধারণা (Accrual) : আয় বিবরণী শুধু নগদ প্রাপ্তি ও নগদ প্রদানের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত হয় না। বকেয়া ধারণার উপর ভিত্তি করে বিশদ আয় বিবরণী তৈরি করা হয়। প্রদত্ত খরচের সাথে বকেয়া খরচ এবং প্রাপ্ত আয়ের সাথে প্রাপ্য আয় যোগ করে বিশদ আয় বিবরণীতে দেখানো হয়। পক্ষান্তরে, অগ্রিম আয় ও ব্যয়কে সংশ্লিষ্ট হিসাব খাত থেকে বাদ দিয়ে দেখানো হয়। অর্থাৎ হিসাব সালের জন্য আয় বা ব্যয়ের পরিমাণ কত সেটিই মুখ্য; ঐ আয় বাবদ কত নগদে পাওয়া গেল বা ঐ ব্যয় বাবদ কত নগদে দেওয়া হলো সেটি মুখ্য নয় ।

৫) রক্ষণশীলতার নীতি (Conservatism) : এই নীতি অনুযায়ী মুনাফা নির্ণয়ে রক্ষণশীল হতে হবে অর্থাৎ যত দূর সম্ভব মুনাফা কম দেখাতে হবে। তাই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সকল ব্যয় ও ক্ষতিকে আয় বিবরণীতে লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু আয়ের ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকলে চলবে না বরং নিশ্চিত হতে হবে, নিশ্চিত আয়কেই আয় বিবরণীতে দেখানো হবে। সম্ভাব্য আয়ের উপর ভিত্তি করে যদি মালিক নিট লাভের অংশ নিয়ে যান এবং ঐ সম্ভাব্য আয় যদি আসলে না ঘটে তবে মালিক প্রকৃতপক্ষে মূলধনই ভেঙে ফেললেন, যা ব্যবসায়ের জন্য ক্ষতিকর। রক্ষণশীল নীতির জন্য সম্ভাব্য কুঋণ খরচ হিসাবে দেখানো হয়। আর সমাপনী মজুদের বাজার মূল্য ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি হলেও সেটি দেখানো হয় না বরং যেটি কম সেই মূল্যই দেখান হয়।

৬) ক্রয়মূল্য নীতি (Cost Price) : এই নীতি অনুযায়ী স্থায়ী সম্পদসমূহ যে মূল্যে ক্রয় করা হয়েছিল, সেই মূল্যেই প্রতিবছর আর্থিক অবস্থার বিবরণীতে দেখানো হয়। বাজারমূল্যে দেখানো হয় না, কারণ স্থায়ী সম্পদ বিক্রির জন্য নয় বরং দীর্ঘকাল ব্যবসায়ে ব্যবহারের জন্য ক্রয় করা হয়। ক্রয়মূল্য বলতে সম্পত্তি অর্জনে প্রদত্ত অর্থ ও ব্যবহার উপযোগী করার জন্য আনুষঙ্গিক খরচ উভয়কে বুঝায় ।

৭) সামঞ্জস্যতা নীতি (Consistency) : এই নীতি অনুসারে হিসাববিজ্ঞানের হিসাবসমূহ প্রত্যেক বছরে একই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রস্তুত করা হয়। এই বছর এক পদ্ধতি এবং আরেক বছর অন্য পদ্ধতি- এই নীতি অনুসরণ করলে বিভিন্ন বছরে হিসাবসমূহের সঠিক তুলনা করা যায় না। ফলে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তনের সঠিক চিত্র পাওয়া যায় না।

৮) বস্তুনিষ্ঠতা ধারণা (Materiality) : হিসাববিজ্ঞানে বস্তুনিষ্ঠতা প্রথা বলতে হিসাবরক্ষকের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার দ্বারা লেনদেনসমূহ হিসাবভুক্তকরণকে বুঝায়। হিসাবরক্ষককে প্রাসঙ্গিকতা ও অপ্রাসঙ্গিকতা বিচার করে হিসাবের বইতে লেনদেন লিপিবদ্ধ করতে হয়। উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি বুঝানো যেতে পারে- প্রতিষ্ঠান কোনো সম্পদ যা দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হবে তা স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে ক্রয় করল। যেমন-ঘড়ি, স্ট্যাপলার, পাঞ্চিং মেশিন, ক্যালকুলেটর প্রভৃতি ব্যবসায়ে দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হয় কিন্তু এদের মূল্য অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় প্রাথমিক হিসাবের বইতে সম্পদ হিসেবে লিখলেও হিসাবকাল শেষে তা সম্পদের অন্তর্ভুক্ত না করে সংশ্লিষ্ট হিসাব বছরের খরচ হিসাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

Content added || updated By