চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) একজন ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী (Naturalist) ছিলেন। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত "Origin of Species By Means of Natural Selection" নামক গ্রন্থে তিনি অভিব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত ও জোরালো মতবাদ প্রকাশ করেন। এ মতবাদ প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ বা ডারউইনিজম নামেও পরিচিত। ১৮৩১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর এইচ. এম. এস. বিগল নৌজাহাজের একজন অবৈতনিক প্রকৃতিবিদ হিসেবে দক্ষিণ আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর জরীপদলের সাথে ইংল্যান্ডের ডেভেনপোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করেন। সুদীর্ঘ পাচ বছর পর ১৮৩৫ সালের ২রা অক্টোবর বিগল ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসে। এ সমুদ্র ভ্রমণে ডারউইন অসংখ্য জীবাশ্ম, খনিজ পদার্থ এবং পাথর সংগ্রহ করেন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ ও প্রমাণাদিসহ ১৮৫৯ সালের ২৪শে নভেম্বর “On the Origin of Species by Means of Natural Selection" শিরোনামে ভারউইনের বিশ্ব কাঁপানো, যুগান্ত সৃষ্টিকারী গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
ডারউইনবাদ বা ডারউইনিজম
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ডারউইন ও ওয়ালেস জৈব বিবর্তন সম্বন্ধে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাই পরবর্তীতে ডারউইনবাদ নামে পরিচিত হয়েছে। এ মতবাদের ভিত্তি দুটি; যথা- (১) জীবজগতের কতগুলো বাস্তব ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং (২) এ বাস্তব ঘটনাবলীর ফলাফল প্রকাশ। ভিত্তিমূল-দুটির উপর প্রতিষ্ঠিত ডারউইনবাদ বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ৬টি ধাপে ভাগ করেছে। মৌলিক সিন্ধান্তগুলো হলো-
জীবন সংগ্রাম
১. বংশ বৃদ্ধির উচ্চহার (Prodigality of production)
২. খাদ্য ও বাসস্থানের সীমাবদ্ধতা (Limitation for food and space)
যোগ্যতমের জয়
৩. জীবন সংগ্রাম (Struggle for existence)
৪. পরিবৃত্তির অসীম ক্ষমতা (Omnipotence of variation amongst the individual) -
নতুন প্রজাতির উৎপত্তি
৫. যোগ্যতমের জয় (Survival of the fittest)
৬. প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural selection)
১। বংশ বৃদ্ধির উচ্চহার : প্রাণী, উদ্ভিদ নির্বিশেষে জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধির প্রবণতা দেখায়। ফলে বাঁচার সম্ভাবনা সম্পন্ন জীবের সংখ্যার চেয়ে জন্মানোর সংখ্যা দাঁড়ায় বহুগুণ বেশি। উদাহরণস্বরূপ-একটি স্যামন মাছ এক ঋতুতেই দুই কোটি আশি লক্ষ ডিম পাড়ে। সমস্ত ডিম যদি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হয় এবং অনুরূপভাবে ডিম পাড়ে তবে দেখা যাবে, পৃথিবীর জলভাগ কয়েক বছরের মধ্যে কেবল এক প্রজাতির প্রাণী দিয়েই পূর্ণ হয়ে যাবে।
২। খাদ্য ও বাসস্থানের সীমাবদ্ধতা : প্রাকৃতিক খাদ্যবস্তুর উৎপাদন হার এবং ভূ-পৃষ্ঠের আয়তন সীমিত। এ অবস্থায় জীবের জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধির ফলে এদের ভেতর পর্যাপ্ত আহার ও যোগ্য বাসস্থানের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হবে অর্থাৎ এরা প্রাকৃতিক বাধার সম্মুখীন হবে।
৩। জীবন সংগ্রামঃ ডারউইনের মতে, প্রাকৃতিক বাধা কার্যকর হয় জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে। একদিকে ক্রমাগত বংশবৃদ্ধি অন্যদিকে পরিমিত খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান জীবনকে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেয়। এতে বেঁচে থাকার উপযুক্ত জীব বাছাই হয়ে যায়। এটিই জীবন সংগ্রাম বা অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম প্রধানত অন্তঃপ্রজাতির সংগ্রাম, আন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম এবং পরিবেশিক সংগ্রাম তিনভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে।
৪। পরিবৃত্তির অসীম ক্ষমতা : জীবিত বংশধরদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোন পার্থক্য দেখা না গেলেও প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকে। পৃথিবীতে যে কোন দুটি জীব কখনই অবিকল এক রকম হতে পারে না। এ পার্থক্যকে পরিবৃত্তি বা প্রকরণ বলে। ডারউইন মনে করতেন যে, অবিরত সংগ্রামের ফলে জীবদেহে যে প্রকরণ বা পার্থক্যের সৃষ্টি হয় তা প্রজননকালে বংশধরদের দেহে সঞ্চারিত হয়ে পরিশেষে জীবের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারাবাহিক পরিবর্তন ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির উত্তরের জন্য দায়ী।
৫। যোগ্যতমের জয় : জীবন সংগ্রামে লিপ্ত জীবগোষ্ঠীর মধ্যে যারা পরিস্থিতির উপযুক্ত মোকাবিলা করতে পারে শুধু তারাই বেঁচে থাকবে। এসব জীবদেহে স্বভাবতই দেখা দেয় অনুকূল প্রকরণ (favourable variation) যা প্রতিকূল পরিবেশেও জীবকে মানিয়ে নিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অন্যদিকে প্রতিকূল প্রকরণ সম্পন্ন জীব পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে কো পেরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এভাবে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত জীবদের মধ্যে যোগ্যতমের উদবর্তন করে।
৬। যোগ্যতমের জয় : যে সব জীবের মধ্যে অনুকূল পরিবৃত্তি আছে প্রকৃতি তাদের নির্বাচন ও লালন করে। সুবিধাজনক পরিবৃত্তিধারী জীব পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং অযোগ্যদের তুলনায় বেশি হারে বংশবিস্তার করতে পারে। এরেদ বংশধরদের মদ্যে পরিবত্তিগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবাহিত হয়। যাদের সুবিধাজনক পরিবৃত্তি বেশি থাকে প্রকৃতি পুনরায় তাদের নির্বাচন করে। এভাবে যুদ-যুগান্তর দরে প্রকৃতি কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদের নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।