যেসব উদ্ভিদ লবণাক্ত মাটিতে জন্মায় তাদেরকে লোনামাটির উদ্ভিদ বলে। এরূপ আবাসস্থলে দ্রবীভূত লবণের পরিমাণ (NaCl, MgCl,, Mg SO.) বেশি থাকায় সাধারণ উদ্ভিদ সেখান থেকে পানি শোষণ করতে পারে না। তাই, সেখানে বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ জন্মায়। মাটিতে প্রচুর পানি থাকা সত্ত্বেও লবণের আধিক্যের জন্য সাধারণ উদ্ভিদের পক্ষে ঐ পানি শোষণ করা সম্ভব হয় না অগ্রহণযোগ্য পানিযুক্ত এরূপ মাটিকে শারীরবৃত্তীয় শুষ্ক বা উষর মাটি (physiologically dry soil) বলা হয়। এ কারণে লবণাক্ত মাটির উদ্ভিদের ও মরু উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যের সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। অনেক পরিবেশ বিজ্ঞানী লোনামাটির উদ্ভিদকে মরুপ্রেমী (xerophilous) উদ্ভিদ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন।
লোনামাটির উদ্ভিদ সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে জন্মায় তাদের ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ (mangrove plants) বলা যেসব হয়। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে যথা- সুন্দরবনে এই জাতীয় উদ্ভিদ পাওয়া যায় ।
লোনামাটির উদ্ভিদ চারটি গ্রুপে বিভক্ত, যথা-
মিথোফিলাস (Lithophilous) : লবণাক্ত অঞ্চলের
নিউম্যাটোফোর শিলা ও পাথরের নুড়ির উপর জন্মায়।
স্যামোফিলাস (Psammophilous) : লোনাপানিতে বালি মাটির উপর জন্মায় ।
পেলোফিলাস (Pelophilous) : লোনাপানির কাদা
মাটিতে জন্মায়।
হেমোফিলাস (Helophilous) : লবণাক্ত জলাভূমিতে জন্মায়। লবণাক্ত মরু অঞ্চলেও জন্মাতে পারে।
লোনামাটির উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যঃ
১. এসব উদ্ভিদের কাণ্ড ও পাতা রসালো।
২. কদমাক্ত মাটিতে খাড়া হয়ে থাকার জন্য স্তম্ভমূল ঠেসমূল থাকে যা মাটির সামান্য নিচে বিস্তৃত থাকে ।
৩. এই বিশেষ ধরনের মূল যা অক্সিজেন গ্রহণের জন্য (উল্টো দিকে বর্ধিত হয়ে) মাটির উপরে উঠে আসে তাকে নিউম্যাটোফোর (pneumatophore) বলে।
৪. মূলের অভ্যন্তরে (কর্টেক্স-এ) বড় বড় বায়ুকুঠুরী থাকে।
৫. লোনামটির উদ্ভিদে প্রস্বেদন কম হয়।
৬. উদ্ভিদ অপেক্ষাকৃত খর্বাকার হয় এবং এদের এপিডার্মিস বহুস্তর বিশিষ্ট হয় ।
৭. অনেক উদ্ভিদে জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম (viviparous germination) হয়।
লোনামাটির অভিযোজনঃ
১. মাটির গভীরতার সাথে সাথে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়, তাই অধিকাংশ উদ্ভিদের মূলতন্ত্র মাটির খুব গভীরে না গিয়ে মাটির উপরের স্তরেই বিস্তৃত থাকে।
২. অধিক লবণাক্ত পানি শোষণ করতে অসুবিধা হয়, তাই বৃষ্টির সময় লবণাক্ততা কিছু কমে আসলে উদ্ভিদ দ্রুত পানি শোষণ করে তাদের প্যারেনকাইমা কোষে সঞ্চয় করে রাখে। এ কারণে এদের কাণ্ড, পাতা ও মূলকে কিছু রসালো দেখায়।
৩. জোয়ার-ভাটার সময় পানির টানকে সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য অনেক উদ্ভিদে স্তম্ভমূল বা ঠেসমূল থাকে।৪. শ্বাসমূলের ভেতরে বায়ুকুঠুরী থাকে এবং সে কুঠুরীতে বায়ু (O2) ধরে রাখতে পারে। শ্বাসমূলের কারণে মূল ও বাইরের সাথে গ্যাসের বিনিময় সহজ হয়।
৫. জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের (ম্যানগ্রোভ অঞ্চল) অনেক উদ্ভিদে জরায়ুজ অংকুরোদগম হয় ফল মাতৃউদ্ভিদে থাকা অবস্থায় বীজের অংকুরোদগম শুরু হওয়াকে জরায়ুজ অংকুরোদগম বা vivipary বলে । এক্ষেত্রে বীজের ভ্রূণমূল বড় হয়ে কাদা মাটিতে খাড়াভাবে পড়ে, ফলে এরা জোয়ার-ভাটায় ভেসে না গিয়ে স্থায়ী হয়।
উদাহরণ : কেওড়া (Sonneratia apetala), পশুর (Carapa moluccansis), গোলপাতা ( Nipa fruticans), হারগোজা (Acanthus illicifolius), সুন্দরী (Heritiera fomes) প্রভৃতি।ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ (Mangrove Vegetation)।
লবণাক্ত পরিবেশে প্রাণীর অভিযোজন
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জুওপ্লাংক্টনসহ বিশাল আকৃতির তিমি পৃথিবীর লবণাক্ত পরিবেশে বাস করে। পৃথিবীর লবণাক্ত পরিবেশ বলতে সাগর-মহাসাগরীয় অঞ্চলকে বোঝায়। এটি পৃথিবীর বিশালতম ঝুয়োম। এখানে বসবাসকারী জীবের অভিযোজনগুলো নিচে আলোচিত হলোঃ
১. লবণ নিয়ন্ত্রণ : মাছ লোনাপানি পান করতে পারে, ফুলকার ভিতর দিয়ে ত্যাগও করতে পারে। সামুদ্রিক পাখিও লোনা পানি পান করে। কিন্তু নাসাগহ্বরে অবস্থিত নাসাগ্রন্থি বা লবণ গ্রন্থি (salt glands)-র মাধ্যমে পাখি সর্দি ঝড়ার মতো করে সে লবণ বের করে দেয়। তিমি কখনও লবণ পানি পান করে না বরং খাদ্য হিসেবে যে সব জীব গ্রহণ করে সেখান থেকে পানির প্রয়োজন মেটায়।
২. অক্সিজেন প্রাপ্তিঃ পানির নিচে বসবাসকারী মাছ ও অন্যান্য জীব হয় ফুলকা না হয় ত্বকের মাধ্যমে O2 গ্রহণ করে। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীরা পানিপৃষ্ঠে নাক উঠিয়ে শ্বসন সম্পন্ন করে। এ কারণে গভীর পানিতে বাসকারী তিমির মাথার চূড়ায় ব্রো-হোল (blowhole) নামে বিশেষভাবে নির্মিত একটি ছিদ্রপথ রয়েছে।
৩. পানির চাপজনিত সমস্যার মোকাবিলা : সমুদ্রে গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপও বেড়ে যায়। (প্রতি ৩৩ ফুট পানির জন্য প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১৫ পাউন্ড পর্যন্ত পানিচাপ বেড়ে যায় । কিছু সামুদ্রিক প্রাণী কখনও পানির গভীরতা পরিবর্তন করে না, কিন্তু যেসব প্রাণী (যেমন-তিমি, সামুদ্রিক কাছিম ও সীল) দৈনিক বেশ কয়েকবার অগভীর পানি থেকে গভীর পানিতে চলাচল করে তারা এ সমস্যা মোকাবিলায় যথেষ্ট পারদর্শী প্রমাণিত হয়েছে । স্পার্ম-তিমি (sperm whale) সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দেড় মাইল সাগরতলে ডুব দিতে সক্ষম। এ সময় তিমির ফুসফুস ও বক্ষপিঞ্জর সংকুচিত হয়ে শরীরকে পানির গভীরে যেতে বিশেষভাবে অভিযোজিত করেছে।
৪. তাপমাত্রার উঠা-নামা প্রতিরোধ : অনেক সামুদ্রিক প্রাণী শীতল রক্তবিশিষ্ট। এদের দৈহিক তাপমাত্রা পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রার মতোই। কিন্তু স্তন্যপায়ীরা উষ্ণরক্তবিশিষ্ট হওয়ায় পরিপার্শ্বিক তাপমাত্রা যাইহোক দৈহিক তাপমাত্রা অর্থাৎ অন্তঃস্থ তাপ সব সময় স্থির রাখতে হয়। এ কারণে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীর দেহে চর্বি ও যোজক টিস্যুনির্মিত তাপ অপরিবাহী স্তর থাকে ।
৫. বায়ু ও পানিতরঙ্গ : জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের অন্তর্বর্তী অংশে (intertidal zone) বসবাসকারী প্রাণিদের উচ্চ পানিচাপ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, কিন্তু উচ্চ বায়ুচাপ ও তরঙ্গের মোকাবিলা করতে হয়। অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ও উদ্ভিদ পাথর ও অন্যান্য কঠিন বস্তুতে আটকে থাকার অভিযোজনে অভিযোজিত হওয়ায় পানির টানে ভেসে যায় না, অনেকে কঠিন খোলসে আবৃত থাকে ।
৬. আলো প্রাপ্তি : যে সব জীবের পর্যাপ্ত আলো দরকার (যেমন-গ্রীষ্মমন্ডলীয় প্রবাল ও তাদের সংশ্লিষ্ট শৈবাল) সে সব জীব অগভীর ও এমন পরিষ্কার পানিতে বাস করে যাতে পর্যাপ্ত আলো পৌঁছাতে পারে। গভীর পানিতে যেহেতু অপর্যাপ্ত আলো থাকে, কিংবা অন্ধকার থাকে সে কারণে তিমিরা শিকারের জন্যো ইকোলোকেশন বা শব্দের উপর। হরণশক্তির উপর) নির্ভর করে । অতল সাগরে কিছু প্রাণী নিজস্ব আলো বিচ্ছুরণকারী অঙ্গের সাহায্যে, কিছু প্রাণী আলো উৎপন্নকারী ব্যাকটেরিয়া ধরে রেখে আহার ও সঙ্গীকে খুঁজে নেয়।