IVF-এর জনক কে?
আইভিএফ পদ্ধতি (IVF-In Vitro Fertilization Process)-কৃত্রিম গর্ভধারণঃ
সাধারণত নারীদেহের অভ্যন্তরে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিউক্লিয়াসের একীভবনের মধ্য দিয়ে নিষেক সম্পন্ন হয় । নিষিক্ত ডিম্বাণুটি গর্ভাশয়ের প্রাচীরে সংস্থাপিত হয়ে প্রায় ৯ মাস পর পরিস্ফুটন শেষে একটি শিশুসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এ প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক গর্ভধারণ (natural conception) নামে পরিচিত। ডিম্বনালি বন্ধ হয়ে গেলে, ক্ষত হলে বা এন্ডোমেট্রিওসিস ছাড়াও পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা কম হলে বা অস্বাভাবিক গড়নের শুক্রাণু হলে, অথবা নারী ও পুরুষ উভয় থেকে শুক্রাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হলে, নারীতে ডিম্বপাত না হলে IVF গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। তখন দেহের বাইরে গবেষণাগারে কাচের পাত্রে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ুতে স্থাপন করে গর্ভধারণ করানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রক্রিয়ার নাম ইন ভিট্রো নিষেক (In Vitro Fertilization, সংক্ষেপে IVF) প্রক্রিয়া। ‘in vitro’ একটি ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে কাচের ভিতরে (within the glass)। প্রক্রিয়াটি টেস্ট টিউব পদ্ধতি এবং ভূমিষ্ঠ শিশুটি টেস্ট টিউব বেবী নামে সাধারণভাবে প্রচলিত। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হসপিটালে প্যাট্রিক স্টেন্টো (Patric steptoe, 1913-1988) এবং রবার্ট জি. এডওয়ার্ডস (Robert G. Edwards, 1925-2013) এর তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয় বিশ্বের সর্বপ্রথম টেস্ট টিউব বেবী লুইস ব্রাউন (Louise Joy Brown) নামের কন্যা শিশুটি। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় এ অনন্য অবদানের জন্য তাকে ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে প্রথম টেস্ট টিউব বেবীর Louise Joy Brown জন্ম হয় ২০০১ সালে।
আইভিএফ পদ্ধতির ধাপসমূহ (Steps to the IVF procedure):
আইভিএফ পদ্ধতি ছাড়া আর কোনও উপায়ে গর্ভধারণ সম্ভব নয় নিশ্চিত হলে যে কোনো দম্পতি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারেন। সব চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রায় একই ধরনের চিকিৎসা সম্পন্ন হয়ে থাকে। নিচে এ ধাপগুলো সম্বন্ধে সংক্ষেপে সাধারণ ধারণা দেয়া হলো।
ধাপ-১. স্বাভাবিক রজঃচক্র দমন : IVF-এর প্রথম ধাপে স্ত্রীর স্বাভাবিক রজঃচক্র দমিয়ে রাখতে একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওষুধটি ইনজেকশন হিসেবে কিংবা নাকের ভিতর স্প্রে করে দেয়া হয়।
ধাপ-২. ডিম্বাণুর সরবরাহ বৃদ্ধি : নারীদেহে সাধারণত প্রতিমাসে একটি করে ডিম্বাণু পরিণত (mature) হয়. কিন্তু কৃত্রিম গর্ভধারণের ক্ষেত্রে একাধিক ডিম্বাণুর প্রয়োজন হয় কারণ একটিমাত্র ডিম্বাণু নিয়ে পূর্ণ-চিকিৎসা সম্পন্ন করার ঝুঁকি নেয়া ঠিক নয়। এ কারণে ডিম্বাণুর উৎপাদন বাড়াতে FSH (Follicle Stimulating Hormone) নামে হরমোনযুক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি ডিম্বাণু উৎপাদিত হলে বেশি ডিম্বাণু নিষিক্ত করে যাচাই-বাছাইয়ে সুবিধা হবে। এভাবে ডিম্বাশয়কে বেশি ডিম্বাণু উৎপাদনে উদ্দীপ্ত করা হয়।
ধাপ-৩. অগ্রগতি পরীক্ষা : ডিম্বাণু উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োগিত হরমোনের ফলাফল পরীক্ষা করা হয় তৃতীয় ধাপে। এ জন্য আন্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান (বা ছবি) ও হরমোনের মাত্রা যাচাইয়ের জন্য রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা করা হয়।
ধাপ-৪. ডিম্বাণু সংগ্রহ : ডিম্বাণু সংগ্রহের ৩৪-৩৮ ঘন্টা আগে ডিম্বাণু পরিপক্কতায় সাহায্য করতে আর হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয় । ডিম্বাণু চোষক (follicular aspiration) প্রক্রিয়ায় নারীদেহের ডিম্বাশয় থেকে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পরিপক্ক ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। এর আগে অবশ্য ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ানো হয়। আল্ট্রাসাউন্ড ছবির সূত্র ধরে যোনি পথে একটি সূক্ষ্ম ফাপা উঁচ প্রবেশ করিয়ে ডিম্বাশয় ও ফলিকলে (ডিম্বথলিতে) আবৃত ডিম্বাণুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয় । সুঁচটি চোষক যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো থাকে। এ যন্ত্র ডিম্বাশয়ের ফলিকল থেকে সামান্য তরলসহ ডিম্বাণু সংগ্রহ করে। এভাবে একটি একটি করে সুস্থ ও পরিপক্ক ডিম্বাণু সংগৃহীত হয়। একটি ডিম্বাণু সংগ্রহের পর সেটি নির্ধারিত পাত্রে রেখে আবার আরেকটি ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। প্রত্যেক ডিম্বাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিপক্ক ডিম্বাণু সংগ্রহের পর পূর্ব পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় (নারীদেহের সমান তাপমাত্রায়) সংরক্ষিত থাকে।
ধাপ-৫. শুক্রাণু সংগ্রহ : নারীর ডিম্বাণু সংগ্রহের সময়কালে পুরুষ সঙ্গীকে শুক্রাণু দানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। শুক্রাণু সংগ্রহের পর কিছু সময়ের জন্য কালচার মিডিয়ামে জমা রাখা হয়। এর পর তা বিশেষ প্রক্রিয়ায় বীর্যরস পরিষ্কার করে দ্রুতগতিতে ঘূর্ণনের মাধ্যমে সুস্থ ও সক্রিয় শুক্রাণু নির্বাচন করা হয়।
ধাপ-৬. ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ : গবেষণাগারে ইনকুবেটরে রাখা সর্বোচ্চ গুণগত মানের শুক্রাণু ও ডিম্বাণকে নিষেকের জন্য একসঙ্গে ১৬-২০ ঘন্টা পেট্রিডিশ বা কাচের টিউবে রেখে দেয়া হয়। প্রত্যেক ডিম্বাণুর জন্য প্রায় একলক্ষ শুক্রাণুর ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপর পরীক্ষা করে দেখা হয় কোনো ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়েছে কিনা। নির্ধারিত সময় পর যদি নিষেক না ঘটে থাকে তখন বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে একটি ডিম্বাণুর ভিতরে একটি শুক্রাণুর প্রবেশ ঘটিয়ে নিষেকের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ার নাম অন্তঃসাইটোপ্লাজমিক শুক্রাণু ইনজেকশন (intracytoplasmic sperm injection সংক্ষেপে ICSI)। নিষেক ঘটেছে এবং ক্লিভেজ (বিভাজন) শুরু হয়েছে এমন অবস্থা দেখা দিলেই নিষিক্ত ডিম্বাণকে ভ্রূণ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ধাপ-৭. ভ্রূণ স্থানান্তর : নিষিক্ত ডিম্বাণু সংগ্রহের পর ১-৬ দিনের মধ্যে (সাধারণত ২-৩ দিনের মধ্যে) নারীর জরায়ুতে স্থানান্তর করা হয়। এ সময়ের ভিতর নিষিক্ত ডিম্বাণু ২-৪ ব্লাস্টোমিয়ার বিশিষ্ট ভুণে রূপ নেয়। একটি সুস্থ, সক্রিয় বিভাজনশীল ভ্রূণকে ক্যাথেটারের সাহায্যে আন্ট্রাসাউন্ড প্রতিচ্ছবি দেখে গর্ভাশয়ে সাবধানে স্থাপন করা হয়। এটি একটি ব্যথাহীন প্রক্রিয়া, তবে কেউ পেশিতে সামান্য খিল ধরায় আক্রান্ত হতে পারে। ভ্রূণ যদি জরায়ু অর্থাৎ গর্ভাশয়ে সংস্থাপিত হয় তাহলে গর্ভসঞ্চার হয়েছে বলে মনে করা হয়। এরপর ১০ মিনিট থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যে গর্ভবতী বাসায় চলে যেতে পারেন। কেউ একাধিক ভ্রূণ গর্ভাশয়ে সংস্থাপন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত অবস্থা, বয়স প্রভৃতি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হয়। অনেকে একটি ভ্রূণ সংস্থাপিত হওয়ার পর বাকি ভ্রূণগুলোকে গবেষণাগারে ভবিষ্যতে সংস্থাপনের জন্য, কেউবা অন্য কাউকে দান করার জন্য গবেষণাগারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জমা রাখেন। সংস্থাপনের পরবর্তী সময়কালটি সুনির্দিষ্ট নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। কারণ IVF পদ্ধতিতে জীবিত সন্তান জন্মদানের হার খুব বেশি নয়।
যেসব কারণে আই.ভি.এফ ব্যর্থ (Reasons why IVF fails)
সাধারণত স্ত্রীর বয়স, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গুণগত মান, প্রজনন অক্ষমতার মেয়াদকাল, জরায়ুর স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও বিভিন্ন কারণে আইভিএফ সফলতা পায়না :
1.ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর পরিপক্কতার জন্য যে সময় প্রয়োজন সে সম্পর্কে ভুল অনুমান।
2.ডিম্বাণু পরিণত হওয়ার আগেই পৃথক করা।
3.পৃথকীকরণের সময় ডিম্বাণু নষ্ট হলে ।
4.নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে ভ্রূণের বিকাশ না হওয়া।
5.ভ্রূণের ত্রুটিপূর্ণ প্রতিস্থাপন।
6.ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ত্রুটির কারণে আই.ভি.এফ ব্যর্থ হয়।
আই.ভি.এফ পদ্ধতিতে স্বাভাবিক বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতাও কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুন্ন হয়। শুক্রাণু, ডিম্বাণু ও একটি জরায়ু হলেই এ পদ্ধতিতে গর্ভধারণ সম্ভব। আজকাল দেখা যায় যে, জরায়ুতে সমস্যা থাকলে, স্বামী-স্ত্রী নিজেদের শুক্রাণু-ডিম্বাণু দিয়ে তৈরি জ্বণ অন্য কোনো নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করছেন। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে আগত শিশুর মানসিকতা। বয়সের সঙ্গে মা-বাবার পরিচয় নিয়েও তার মনের ভিতর সংশয় তৈরি হতে পারে । কৃত্রিম পরিবেশে ভ্রূণ সংরক্ষণ করার সময় ভ্রূণের সাথে অপ্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ ঘটানোর ফলে গবেষণার উদ্দেশ্যে জ্বণের অপব্যবহারের শঙ্কা থাকে। তাছাড়া ভ্রূণকে পণ্যের মতো ব্যবহারের শঙ্কা রয়েই যায়। এত সবের পরও থেমে নেই আই ভি,এফ পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম । সন্তান ধারণের মাঝ দিয়ে নারী পায় তার পূর্ণতা । তাই প্রজনন সংক্রান্ত প্রতিকূলতার কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নন প্রজননে অক্ষম পুরুষ ও নারীকুল। মাতৃত্বের আকাঙ্খা পূরণে আই.ভি.এফ পদ্ধতি তাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।
প্রথম টেস্টটিউব কুকুরের জন্ম (Birth of the first test-tube dog) :
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গত ০৯/১২/২০১৫ তারিখে। আইভিএফ পদ্ধতিতে সাতটি কুকুরছানার জন্ম দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এসব গবেষকেরা একটি কুকুরীর জরায়ুতে ১৯টি ভ্রূণ স্থাপন করে এ সাফল্য পান। বিজ্ঞানীদের এ সাফল্যের প্রভাব সুদূর প্রসারী হতে পারে। কারণ এ আইভিএফ পদ্ধতি ব্যবহার করে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রাণী সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত (Bangladesh Perspective) :
বাংলাদেশে প্রথম ত্রয়ী টেস্টটিউব বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে হীরা, মনি ও মুক্তা। এদের জন্ম হয় ২০০১ সালের ৩০ মে। এদের পিতা ও মাতা যথাক্রমে আবু হানিফ এবং ফিরোজা বেগম। এ দম্পতি Bangladesh Assisted Conception Center (BACC) and Women’s Hospital (WH), ঢাকা এর Dr. Fatema Parveen এর তত্ত্বাবধায়নে ১৯৯৪ সাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে ৬ বছর পর সন্তানত্রয় জন্মদানে সক্ষম হন। বর্তমানে বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি নিয়ে সাফল্যজনকভাবে কাজ চলছে।বেসরকারীভাবে বেশ কয়েকটি আই.ভি.এফ সেন্টার রয়েছে।
আইভিএফ-এর সুবিধা (Advantages of IVF) :
এতে মাতৃত্বের বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সহজ পদ্ধতি। ডিম্বনালি ক্ষতিগ্রস্ত থাকলেও গর্ভধারণ সম্ভব। এর দীর্ঘস্থায়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
আইভিএফ-এর অসুবিধা (Disadvantages of IVF):
বেশিবার গর্ভধারণে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এতে শিশুর অকাল জন্ম হতে পারে। এটি ব্যয় সাপেক্ষ চিকিৎসা। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। মানসিক চাপে স্নায়বিক দৌর্বল্য দেখা দিতে পারে। টেস্ট টিউব শিশুদের বিকলাঙ্গতা ও বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে বলে বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করেছেন। ডিম্বাণু সংগ্রহের সময় ডিম্বাশয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে রক্তক্ষরণ ও পরবর্তীতে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। অনেকে টেস্ট টিউব বেবি নেয়াকে অনৈতিক মনে করেন কেননা এ পদ্ধতিতে অনেক ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।