পুরুষ প্রজননতন্ত্র (Male Reproductive System):
মানুষে শুক্রাণু উৎপাদন, সঞ্চয় ও পরিবহন কাজের ভিত্তিতে পুরুষ জননতন্ত্রকে দুভাবে ভাগ করা যায়ঃ মুখ্য (primary) ও আনুষঙ্গিক (accessory)। যে অঙ্গ শুক্রাণু উৎপন্ন করে তাকে মুখ্য জনন অঙ্গ; এবং যে সব অঙ্গ শুক্রাণু সঞ্চয় ও পরিবহনের কাজে নিয়োজিত সেগুলোকে আনুষঙ্গিক জনন অঙ্গ বলে।
শুক্রাশয় হচ্ছে মুখ্য জননাঙ্গ।
১. শুক্রাশয় (Testes): একজোড়া ডিম্বাকার শুক্রাশয় ক্রোটাম (scrotum) নামক একটি থলির ভিতর আবদ্ধ এবং শুক্ররজ্জু দিয়ে লাগানো অবস্থায় দু’পায়ের উরুসন্ধিতে উপাঙ্গের মতো ঝুলে থাকে। প্রত্যেক শুক্রাশয়ের ভিতরে প্রায় ১০০০টি সূক্ষ্ম ও প্যাচানো সেমিনিফেরাস নালিকা (seminiferous tubules) থাকে। এসব নালিকা কতকগুলো সংগ্রাহক নালিকায় উন্মুক্ত হয়ে এক জালিকাকার গঠন সৃষ্টি করে, একে রেটি টেসটিস (rete testis) বলে । রেটি টেসটিস থেকে প্রায় বিশটি ৪-৬ মিলিমিটার লম্বা সংগ্রাহক নালি সৃষ্টি হয়ে প্রত্যেক শুক্রাশয়ের শীর্ষদেশ থেকে শুক্রাশয় ত্যাগ করে এপিডিডাইমিসে মিলিত হয়। সংগ্রাহক নালিগুলোকে ভাসা ইফারেন্সিয়া (vasa efferentia) বলে।
কাজ: শুক্রাণু-মাতৃকোষ শুক্রাণু উৎপন্ন করে এবং টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন ক্ষরণ করে।
২. এপিডিডাইমিস (Epididymis): প্রত্যেক শুক্রাশয়ের ভাসা ইফারেন্সিয়া একত্রে মিলিত হয়ে একটি করে ৪-৬ মিটার লম্বা অত্যন্ত প্যাচানো এপিডিডাইমিস গঠন করে।
কাজ: শুক্রাণুর নিষেক ক্ষমতা বাড়ায় এবং পুষ্টি পদার্থ ক্ষরণ করে এগুলোকে সতেজ রাখে।
৩. ভাস ডিফারেন্স (Vas deferens) বা শুক্রনালি: প্রতিটি এপিডিডাইমিস প্রায় ৪০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা, বড় গহ্বর ও মোটা প্রাচীরবিশিষ্ট একেকটি ভাস ডিফারেন্স-এ উন্মুক্ত হয়। মূত্রনালি অতিক্রম করার পর অ্যাম্পুলা (ampulla) নামক একটি মাকু আকৃতির ফোলা অংশ গঠন করে। অ্যাপুলা পরে সেমিনাল ভেসিকলে যুক্ত হয়।
কাজ: প্রধান কাজ হচ্ছে সঙ্গমের সময় দ্রুত শুক্রাণু পরিবহন করা। তবে কিছু সময়ের জন্য শুক্রাণু জমাও রাখে।
পুরুষ প্রজননতন্ত্র (Male Reproductive System):
৪. সেমিনাল ভেসিকল (Seminal vesicle): সেমিনাল ভেসিকল হচ্ছে মূত্রথলির নিম্নপ্রান্ত ও মলাশয়ের মাঝখানে অবস্থিত একজোড়া ছোট, আঙ্গুলের মতো কোঁচানো থলিকা।
কাজ: বীর্য বা সিমেন (semen) উৎপন্নের জন্য ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ বিপুল পরিমাণ পিচ্ছিল থকথকে পদার্থ ক্ষরণ করে। ক্ষরণের ফুক্টোজ সচল শুক্রাণুর শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
৫. ক্ষেপন নালি (Ejaculatory duct): প্রত্যেক সেমিনাল ভেসিকল থেকে সৃষ্ট একটি করে খাটো নালি প্রত্যেক ভাস ডিফারেন্সের সাথে একীভূত হয়ে ০.৩ মিলিমিটার ব্যাসের ১৯ মিলিমিটার লম্বা অভিন্ন ক্ষেপন নালি গঠন করে।
কাজ: সেমিনাল ভেসিকলের ক্ষরণসহ শুক্রাণুকে ইউরেথ্রায় পৌঁছে দেয়।
৬. ইউরেথ্রা (Urethra): এটি রেচনতন্ত্র ও প্রজননতন্ত্রের একটি অভিন্ন নালি যা প্রায় ২০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং শিশ্নের শীর্ষদেশে উন্মুক্ত হয়।
কাজ: এ নালির মাধ্যমে বীর্য বাইরে স্খলিত হয় এবং মূত্র নিষ্কাশিত হয়।
৭. বহিঃযৌনাঙ্গ (External genitalia): এটি দুরকম, যথা- স্ক্রোটাম ও শিশ্ন।
ক. স্ক্রোটাম (scrotum) বা অন্ডথলি: এটি দুই উরুর মাঝখানে ঝুলে থাকা ও ত্বকে আবৃত থলি বিশেষ। ত্বকের নিচে পাঁচ ধরনের পেশিস্তর ক্রমান্বয়ে বিন্যস্ত থাকে।
কাজ: স্ক্রোটাম শুক্রাণু উৎপন্নের অনুকূল তাপমাত্রা রক্ষা করে। শুক্রাশয়কে চাপজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
খ. শিশ্ন (Penis) বা পুরুষাঙ্গ: শিশ্ন হচ্ছে পুরুষের এমন একটি বহিরাঙ্গ যার ভিতর দিয়ে ইউরেথা অতিক্রম করে বাইরে উন্মুক্ত হয়। এর ত্বকের নিচে চর্বি নেই কিন্তু পাতলা টিস্যু আছে। তাই শিশ্নের ত্বক এত আলগা। যে অংশ থেকে শিশ্ন উঠেছে তাকে শিশ্নমূল (root) বলে। শিশ্নের যে অংশ ঝুলে থাকে, সেটি শিশ্নদেহ। এর ডগায় ব্যাঙের ছাতা আকৃতির লাল মুন্ডিকে গ্লান্স পেনিস (glans penis) বলে। এতে সবচেয়ে বেশি স্নায়ুর প্রান্তদেশ উন্মুক্ত। এ মুন্ডিকে যে চামড়া ঢেকে রাখে, তাকে প্রীপিউস (prepuce) বলে (মুসলমান পুরুষে এ অংশটি খতনার সময় কেটে ফেলা হয়)। শিশ্নদেহ দুধরনের ইরেকটাইল (erectile) টিস্যুতে গঠিত:
(i) কর্পোরা ক্যাভারনোসা (corpora cavernosa) ও
(ii) কর্পোরা স্পঞ্জিওসাম (corpora spongiosum)। এ টিস্যু দৃঢ় হলে শিশ্ন প্রসারিত হয়।
কাজ: এটি ইউরেথার মাধ্যমে বীর্য স্ত্রী জননতন্ত্রের অভ্যন্তরে প্রেরণ করে।
৮. জনন গ্রন্থি: মানুষের জনননালি সংশ্লিষ্ট নিচে বর্ণিত দুটি গ্রন্থি পাওয়া যায়।
ক. প্রস্টেট গ্রন্থি (Prostate gland): এটি শ্রোণিগহ্বরে মূত্রথলির নিচে অবস্থিত নাশপাতি আকৃতির গ্রন্থি এবং গোড়া ও চূড়ায় বিভক্ত।
কাজ: এ গ্রন্থি থেকে একধরনের ক্ষারীয় তরল নিঃসৃত হয় যা বীর্যরসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং যোনির ভিতরের অম্লীয় অবস্থাকে প্রশমিত করে শুক্রাণুকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।
খ. বাল্বোইউরেথ্রাল (Bulbo-urethral) বা কাওপার-এর গ্রন্থি (Cowper’s gland): এ গ্রন্থি হচ্ছে ইউরেথ্রার দুপাশে অবস্থিত দুটি মটর দানার মতো গ্রন্থি যা থেকে নালিকা বেরিয়ে ইউরেথ্রায় মিলিত হয়।
কাজ: সংগমের সময় এ গ্রন্থি মিউকাস (পিচ্ছিল পদার্থ) ক্ষরণ করে।
পুরুষ প্রজননতন্ত্রের হরমোনাল ক্রিয়া (Hormonal Action of Male Reproductive System):
পুরুষ প্রজননতন্ত্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন হরমোন ও সেগুলোর কাজ নিচে উল্লেখ করা হলো−
১. শুক্রাশয়ের ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ থেকে ক্ষরিত টেস্টোস্টেরন (testosterone) হরমোন মুখ্য ও আনুষঙ্গিক
জননাঙ্গের বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং বিভিন্ন গৌণ (Secondary) যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে।
২. অগ্র পিটুইটারি গ্রন্থির সম্মুখ খণ্ড (lobe) থেকে ক্ষরিত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (Follicle Stimulatine hormone ) ও লুটিনাইজিং হরমোন (Luteinising Hormone-LII) এর প্রভাবে যৌন হরমোন টেস্টোস্টেরন ক্ষরিত হয়।
৩. পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত লুটিওট্রফিক হরমোন (Lucotrophic formoneLTH) গৌণ যৌন অঙ্গের বিকাশ ঘটায়।
৪. অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত গোনাডোকর্টিকয়েড (Gonadlocorticoids) হরমোন ভ্রণের যৌন বিভেদ নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌনগ্রন্থি, যৌনাঙ্গ ও গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।
৫. শুক্রাশয় থেকে ক্ষরিত অ্যান্ড্রোস্টেরন (Androsterone) পুরুষের গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায় এবং স্পার্মাটোজেনেসিস বা শুক্রাণুজননে শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে।
৬. শুক্রাশয়ের সারটলি কোষ (sertoli cell) থেকে ক্ষরিত ইনহিবিন (Inhibin) হরমোন শুক্রাণু উৎপন্নে সাহায্য করে।