নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - অর্থনীতি - বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রসঙ্গ | NCTB BOOK

উন্নত দেশ: উচ্চ আয়ের যেসব দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে এবং এই উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে অব্যাহত আছে, এমন দেশকে উন্নত দেশ বলে । এসব দেশের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত ।
অনুন্নত দেশ: অধ্যাপক র‍্যাগনার নার্কস বলেন, অনুন্নত দেশ হচ্ছে সে সব দেশ, যেগুলোতে জনসংখ্যার
তুলনায় মূলধন বা পুঁজি কম । নিম্ন আয়ভুক্ত এসব দেশে জনসাধারণ নিম্নমানের জীবন যাপন করে ।
উন্নয়নশীল দেশ: যেসব দেশের মাথাপিছু প্রকৃত আয় উন্নত দেশের তুলনায় কম কিন্তু উন্নয়নের সূচকগুলোর ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে তাকে উন্নয়নশীল দেশ বলে । এসব দেশের মাথাপিছু আয় বর্ধনশীল এবং জীবনযাত্রার মান ক্রমেই বাড়ছে । এরা নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয় এবং মধ্যম আয় থেকে উচ্চ আয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
উন্নত, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে ।

৯.২.১ উন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Developed Countries)


উন্নত দেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ;


১. ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ : উন্নত দেশ সাধারণত পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ । কখনো কখনো এসব দেশে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের স্বল্পতা থাকলেও সেগুলোর সুষ্ঠু ব্যবহার ও সংরক্ষণ হয়। উন্নত দেশ যেমন, আমেরিকা, জাপান, ইউরোপের দেশগুলো ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহার ও সুষ্ঠু সংরক্ষণ করে আজ উন্নত বিশ্বের নেতৃত্ব দান করছে ।
২. মূলধন : উন্নত দেশে মূলধনের যোগান পর্যাপ্ত । অর্থনীতিতে সঞ্চয় বৃদ্ধির দ্বারা মূলধন গঠন করা হয় ।
৩. দক্ষ জনশক্তি : যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দক্ষ জনশক্তি একান্ত প্রয়োজন । কোনো দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ, মূলধন ইত্যাদি পর্যাপ্ত থাকলেও যদি দক্ষ জনশক্তি না থাকে তাহলে সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় না। উন্নত দেশ দক্ষ জনশক্তি গঠনে বিশেষ নজর রাখে। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয় ।
৪. উচ্চগড় আয়ুস্কাল : উন্নত দেশের জনগণের গড় আয়ুস্কাল সাধারণত বেশি হয় । উন্নত স্বাস্থ্য সুবিধার কারণে তাদের গড় আয়ুস্কাল বেশি হয়ে থাকে ।
৫. কারিগরি জ্ঞান : বর্তমানে উন্নত দেশে শ্রমিকদের উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ বৃদ্ধির মূলে রয়েছে কারিগরি জ্ঞানের উন্নতি । যে দেশ কারিগরি জ্ঞানে যত বেশি উন্নত, সে দেশের অর্থনীতি তত বেশি সমৃদ্ধ । উন্নত দেশে মানুষ উন্নত কারিগরি জ্ঞানের দ্বারা প্রকৃতিকে বশে এনেছে এবং এই প্রকৃতির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করছে ।
৬. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম শর্ত । যে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নেই, সে রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। উন্নত দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদ্যমান থাকায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয় । অর্থাৎ সে সব দেশে সরকারের পরিবর্তন হলেও অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা ও সুশাসন অব্যাহত থাকে ।
৭. ভৌত অবকাঠামো তথা উন্নত পরিবহনব্যবস্থা : যেখানে ভৌত অবকাঠামো ও পরিবহনব্যবস্থা যত বেশি উন্নত সেখানে তত বেশি উৎপাদন ও উন্নয়ন হয়। ভৌত অবকাঠামো তথা পরিবহনব্যবস্থা উন্নত হলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পায় এবং বিনিয়োগ বাড়ে । ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ।

অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Least Developed Countries) এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ অনুন্নত। পৃথিবীর বেশির ভাগ লোক এসব অনুন্নত দেশে বসবাস করে।

অনুন্নত দেশের বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নরূপ;

১. কম উৎপাদনশীল কৃষি খাত : অনুন্নত দেশের বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। বেশির ভাগ লোক
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি উৎপাদনের সাথে জড়িত এবং কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা ও প্রযুক্তি সনাতনী । ২. কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি : এসব দেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ কৃষি খাত থেকে আসে ।
৩. বেকারত্ব : অনুন্নত দেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ায় ছদ্মবেশী ও মৌসুমী বেকারত্ব প্রকটভাবে
পরিলক্ষিত হয় ।
৪. কম মাথাপিছু আয় : অনুন্নত দেশে মাথাপিছু আয় ও সঞ্চয় কম । ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কম হয় ।
৫. দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র : অনুন্নত দেশে কম উৎপাদনের ফলে আয় কম হয় । আয় কম হলে সঞ্চয় কম হয় । সঞ্চয় কম হওয়ায় বিনিয়োগও কম হয় । মূলধনও কম হয় । ফলে উৎপাদনও কম হয় । এ অবস্থাকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র বলে । অনুন্নত দেশে এই চক্র বিরাজমান থাকায় উন্নয়নের গতি মন্থর থাকে ।
৬. জনসংখ্যাধিক্য : বেশির ভাগ অনুন্নত দেশে জনসংখ্যা বেশি এবং মাথাপিছু আয় কম । জনসংখ্যার আধিক্যের ফলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, যানবাহন, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সন্তোষজনকভাবে করা যায় না ।
৭. ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার : অনুন্নত দেশ প্রযুক্তি ও কৌশল পরিবর্তন করে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে না । ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও বেগবান হয় না ।
৮. অনুন্নত যোগাযোগ ও পরিবহনব্যবস্থা : অনুন্নত দেশের পরিবহন ও যোগাযোগব্যবস্থা অনুন্নত থাকে । ফলে মালামাল স্থানান্তরে বিঘ্ন ঘটে। উৎপাদন ব্যয় বেশি হয় । উদ্যোক্তা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয় না ।
৯. প্রতিকূল বাণিজ্যশর্ত : অনুন্নত দেশগুলো শিল্পে উন্নত না থাকায় এসব দেশ কৃষিজাত পণ্য, কাঁচামাল, প্রাথমিক পণ্য রপ্তানি করে এবং শিল্পজাত পণ্য আমদানি করে। যেসব কৃষিপণ্য উপকরণ হিসাবে কম মূল্যে বিদেশে রপ্তানি করে, সেই কৃষিপণ্য শিল্পপণ্যে রূপান্তরিত হয়ে অধিক মূল্যে এসব দেশে আমদানি করা হয় । ফলে বাণিজ্যের ভারসাম্যে প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করে ।
১০. অনুন্নত শিল্প কাঠামো : অনুন্নত দেশে শিল্প কাঠামো সেকেলে এবং বৃহদায়তন মূলধনী শিল্প খুব কম । অনুন্নত দেশের শিল্প খাতে অন্যান্য খাতের তুলনায় শ্রমিক নিয়োগ কম এবং শ্রমিকদের দক্ষতাও কম ।

উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Developing Countries) উন্নয়নশীল দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য;


১. কৃষিনির্ভর অর্থনীতি : দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল । শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষিতে নিয়োজিত । কৃষিক্ষেত্রে পুরনো আমলের জীবন নির্বাহী ক্ষুদ্র খামারে চাষাবাদ হয়, তবে এখানেও কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কৃষিতে বন্যা, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব থাকে ।
২. মাথাপিছ আয় : উন্নত দেশগুলোর তুলনায় উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয় কম কিন্তু অনুন্নত দেশের তুলনায় বেশি। ফলে জীবনযাত্রার মান তেমন উন্নত নয় ।
৩. প্রাকৃতিক সম্পদের অপূর্ণ ব্যবহার : অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তার
পরিপূর্ণ ব্যবহার হয় না ।
৪. মূলধনের স্বল্পতা : উন্নয়নশীল দেশের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার কম । কাজেই সঞ্চয়ের পরিমাণ কম হয় । কম সঞ্চয় মূলধন গঠনের পথে অন্তরায় ।
৫. প্রাথমিক পণ্য উৎপাদনকারী দেশ : উন্নয়নশীল দেশ প্রধানত প্রাথমিক পণ্য উৎপাদন করে এবং
উৎপাদন-ব্যবস্থায় শ্রমনিবিড় উৎপাদন কৌশল ব্যবহার করা হয়। প্রাথমিক পণ্য বলতে শিল্পের
কাঁচামাল যেমন, পাট, চামড়া ইত্যাদি বোঝায় ।
৬. শিল্পের বিকাশ : উন্নয়নশীল দেশসমূহে শিল্প প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে। তবে কোথাও কোথাও রপ্তানীমুখী শ্রমঘন শিল্পের দ্রুত বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।
৭. বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি : উন্নয়নশীল দেশে প্রতিবছর রপ্তানির মাধ্যমে যে পরিমাণ আয় আসে, তার চেয়ে অনেক বেশি আমদানির মাধ্যমে ব্যয় হয়। ফলে এ দেশগুলোকে প্রতি বছর বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতির সম্মুখীন হতে হয় ।
৮. উদ্যোক্তার অভাব : উন্নয়নশীল দেশে পণ্যসামগ্রী বেশির ভাগই কৃষি থেকে প্রাপ্ত । এসব পণ্যের মূল্যের উত্থান-পতন হয় বেশি । পণ্যের মূল্য উত্থান-পতন হওয়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ । ফলে দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তার অভাবে উন্নয়ন ব্যাহত হয় ।
৯. অর্থনৈতিক অবকাঠামো দুর্বল : উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো যেমন, যোগাযোগ ও পরিবহন, বিদ্যুৎ, ব্যাংক, বিমা প্রভৃতি প্রয়োজনের তুলনায় কম ।
১০. বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীলতা : উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেকাংশে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল।

Content added By