On This Page
অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

ষষ্ঠ অধ্যায়

পারমী

পূর্ববর্তী শ্রেণিতে বিভিন্ন সময়ে আমরা 'পারমী' শব্দটি পড়েছি। বৌদ্ধধর্মে পারমীর গুরত্ব অপরিসীম। কারণ বুদ্ধত্ব ও নির্বাণ লাভ করতে হলে পারমী অনুশীলন করে চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করতে হয়। গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্বরূপে ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করেন। প্রতিটি জন্মে তিনি পারমী পূর্ণ করে জীবনের উৎকর্ষ সাধনপূর্বক বুদ্ধত্ব লাভের পথে অগ্রসর হন। এ অধ্যায়ে আমরা পারমী সম্পর্কে পড়ব। এই অধ্যায় শেষে আমরা-

* পারমীর পরিচয় ও প্রকারভেদ বর্ণনা করতে পারব।

* দশ পারমী বর্ণনা করতে পারব।

* পারমীর তাৎপর্য মূল্যায়ন করতে পারব।

পাঠ : ১

পারমী পরিচিতি

'পারমী' শব্দের সাধারণ অর্থ হলো : পূর্ণতা, সমাপ্তি, সম্পূর্ণতা, প্রকৃষ্ট কৌশল, গুণ, সম্পূর্ণ গুণ বা জ্ঞান, উন্নত অবস্থা, সৎকার্যের পূর্ণতা সাধন, সামর্থ্য, পারমিতা ইত্যাদি। সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষ প্রাপ্ত হয়েছে এরূপ বৈশিষ্ট্য বা গুণ অর্থে পারমী শব্দের প্রয়োগ হয়। উৎকর্ষ সাধন বা পরিশুদ্ধিতা অর্জনের জন্য যে সাধনা বা সৎকর্মের অনুষ্ঠান তাই পারমী। বৌদ্ধধর্মে মানবতার পূর্ণ বিকাশ বা চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য যে সাধন প্রণালি নির্দেশ করা হয়েছে তা পারমী নামে পরিচিত। এ সাধন প্রণালির মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করা সম্ভব। বুদ্ধত্ব লাভে অভিলাষী বোধিসত্ত্বগণকে পারমী পূর্ণ করতে হয়। বৌদ্ধধর্ম মতে, পারমী দশ প্রকার, যা দশ পারমিতা নামেও পরিচিত। যথা: আনুভূমিক বিন্যাস করতে হবে।

১) দান পারমী

২) শীল পারমী

৩) নৈষ্ক্রম্য পারমী

৪) প্রজ্ঞা পারমী

৫) বীর্য পারমী

৬) ক্ষান্তি পারমী

৭) সত্য পারমী

৮) অধিষ্ঠান পারমী

৯) মৈত্রী পারমী

১০) উপেক্ষা পারমী

 

 

পারমী

পারমীসমূহ প্রত্যেকটি তিনটি স্তরে বিভক্ত। যেমন: উপপারমী, পারমী এবং পরমার্থ পারমী। এভাবে পারমী ত্রিশ প্রকার বোধিসত্ত্বগণ জন্মজন্মান্তরে এই ত্রিশ প্রকার পারমিতার পূর্ণতা সাধন করে শেষ জন্মে বোধি লাভ করে বুদ্ধ হয়ে থাকেন। জগত দুঃখে পরিপূর্ণ। দুঃখ হতে মুক্তি লাভ করার একমাত্র পথ হলো নির্বাণ সাক্ষাত করা। নির্বাণ সাক্ষাত করতে হলে অর্হত্ব লাভ করতে হয়। অর্থত্ব প্রাপ্তির জন্য জন্মজন্মান্তরে পারমী পূর্ণ করতে হয়।

নিচে গৌতম বুদ্ধের বোধিসত্ত্বকালীন জীবনের একটি কাহিনী তুলে ধরা হলো। এ কাহিনী থেকে আমরা পারমী সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি ।

দীপংকর বুদ্ধ ও সুমেধ তাপস

জগত জন্ম-মৃত্যুর শৃঙ্খলে আবদ্ধ। মানুষ ও প্রাণিকূল জন্মগ্রহণ করে কর্মফল অনুযায়ী জীবনযাপন করে মৃত্যুবরণ করে এবং পুনরায় কর্মফল অনুযায়ী জন্মগ্রহণ করে। এভাবে তাকে জন্ম, জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর আবর্তে ঘুরতে হয় অনন্তকাল। বুদ্ধগণ জগতের দুঃখময়তা অনুধাবন করে দুঃখ মুক্তির পথ নির্দেশ করেন। সহজে বুদ্ধ হওয়া যায় না। এজন্য জন্মজন্মান্তরে কঠোর সাধনা ও বহু কুশল কর্ম সম্পাদন করতে হয়। বৃদ্ধ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ ও সংকল্পবদ্ধ হতে হয়। গৌতম বুদ্ধ একজন্মে অমরাবতী নগরে জ্ঞানী তাপস রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম ছিল সুমেধ তাপস। ঐ সময় দীপংকর বুদ্ধ জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। দীপংকর বুদ্ধ অমরাবতী নগরে আসবেন শুনে সেখানে তাঁকে বরণ করার জন্য সাজ সাজ রব পড়ে গেল। নগরকে নানাভাবে সজ্জিত করা ৫৪

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

হলো । সুমেধ তাপস জানতে পারলেন তথাগত বুদ্ধ আসছেন। তিনি বুদ্ধ দর্শনের দান আনন্দে শিহরিত হলেন। কীভাবে অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানাবেন তা ভাবতে শুরু করলেন। বুদ্ধ আসছেন। যত নিকটবর্তী হচ্ছেন সুমেধ তাপস ততই পুলকিত হয়ে ভাবছেন তিনি কী করতে পারেন। তিনি লক্ষ করলেন বুদ্ধের আগমন পথের এক অংশ কর্দমাক্ত হয়ে আছে । তিনি ভাবলেন, বুদ্ধকে এই কাদায় পা রাখতে দেয়া যায় না। তিনি ঐ পথটুকুতে শুয়ে পড়লেন। বুদ্ধকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন তাঁর দেহের উপর দিয়ে হেঁটে যান। সুমেধ তাপসের এরূপ বুদ্ধভক্তি দেখে সমবেত জনগণ 'সাধুবাদ' প্রদান করল। বুদ্ধও বিমোহিত হলেন।

দীপংকর বুদ্ধের কাছে সুমেধ ভাপস একটি প্রার্থনা করলেন, তিনি যেন 'বুদ্ধ' হতে পারেন। দীপংকর বুদ্ধ আশীর্বাদ করে প্রার্থনা অনুমোদন করলেন। সুমেধ তাপস ঐদিন থেকে ভবিষ্যতে বুদ্ধ হওয়ার জন্য পারমী পূর্ণ করার সংকল্প গ্রহণ করলেন। শুরু হয়ে গেল তাঁর পারমী পূরণের জন্য জন্মান্তর ব্যাপী কুশলকর্ম সম্পাদনের যাত্রা। পাঁচশত ঊনপঞ্চাশ বার বোধিসত্ত্ব রূপে জন্মগ্রহণ করার পর শেষ জন্মে কপিলাবস্তুর শাক্য রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। এ জন্মেও তাঁকে পারমী পূর্ণ করতে হয়েছে অবশেষে ছয় বছর কঠোর তপস্যা করে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন। সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর সর্বপ্রাণীর কল্যাণের জন্য ধর্ম প্রচার করে কুশীনগরের যমক শালবৃক্ষের নিচে পরিনির্বাণ লাভ করলেন । পরিনির্বাণের মাধ্যমে তিনি জন্ম নিরোধ করলেন। এখানে সুমেধ তাপস বুদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য শপথ গ্রহণপূর্বক জন্মজন্মান্তরে যে সকল কুশলকর্ম সম্পাদন করেছিলেন তা-ই পারমী । বোধিসত্ত্বগণ এভাবে পারমীসমূহ পূর্ণ করে থাকেন ।

অনুশীলনমূলক কাজ পারমী শব্দের অর্থ কী? পারমী বলতে কী বুঝ ? দশ পারমী কী কী?

পাঠ : ২

দশ পারমী

দান পারমী : দশ পারমীর মধ্যে দান পারমীর স্থান সর্বাগ্রে। গৌতম বুদ্ধ 'বুদ্ধত্ব লাভের জন্য দশ পারমীর মধ্যে প্রথম 'দান পারমী'কেই গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ দান মানুষের ত্রাণ বা রক্ষাকারী । দান দ্বারা মানুষের দুঃখ-দৈন্য দূর হয়। দান স্বর্গের সোপান সদৃশ এবং ইহকাল ও পরকালে শান্তিকর সুখ আনয়ন করে । তাই নিঃস্বার্থভাবে দান করে দান পারমী পূর্ণ করতে হয়। নিজের ধন সম্পত্তি, অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ, স্ত্রী-পুত্র এবং জীবন উৎসর্গ করা দান পারমীর পর্যায়ভুক্ত। ত্যাগের পথ মহাপথ। গৌতম বুদ্ধ 

পারমী

৫৫

জন্মজন্মান্তরব্যাপী এ পথ অবলম্বন করে দান পারমী পূর্ণ করেছেন। তিনি দীপংকর বুদ্ধের সময় সুমেধ তাপসরূপে জন্মগ্রহণ করেন এবং বুদ্ধত্ব লাভের প্রত্যয়ে দান পারমী পূরণের দৃঢ় সংকল্প করেন। তাই সংসার চক্রের দুঃখ হতে মুক্তি প্রত্যাশী ব্যক্তির দান পারমী পূরণ করা উচিত। দান পারমী তিন প্রকার। যথা : দান উপ-পারমী, দান পারমী, এবং দান পরমার্থ পারমী ।

দান উপ-পারমী অপরের জীবন রক্ষার্থে নিজের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, যেমন, চক্ষু, রক্ত, মাংস প্রভৃতি দান করাকে দান উপ-পারমী বলে। তথাগত বুদ্ধ শিবিরাজ জন্মে চক্ষু দান করেছিলেন । বর্তমানে বাংলাদেশেও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায়। বিভিন্ন ব্যক্তি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করে অনেকের জীবন রক্ষা করেছেন- এরূপ দৃষ্টান্ত দেখা যায় ।

দান পারমী ব্যবহারিক জীবনে উন্নত ও উদার চিত্তে অপরের সুখ-শান্তি কামনায় টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র প্রভৃতি বাহ্যিক বস্তু দান করাকে দান পারমী বলে। তথাগত বুদ্ধ বেস্সান্তর জন্মে ধন-সম্পদ, মঙ্গলহস্তি এবং পুত্র-কন্যাসহ স্ত্রীকেও দান করেছিলেন।

দান পরমার্থ পারমী : অপরের সুখ শান্তির জন্য জীবন উৎসর্গ করাকে পরমার্থ দান বলা হয়। সাধারণত বাহ্যিক বস্তু দান করা সহজ। জীবন দান করা খুবই কঠিন। জন্মজন্মান্তরে বাহ্যিক বস্তু দানের অভ্যাস না থাকলে জীবন উৎসর্গ করা যায় না। বাহ্যিক বস্তু দান অভ্যাস করার পর অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ ও জীবন উৎসর্গ করতে সক্ষম হয়।

শীল পারমী 'শীল' শব্দের অর্থ চরিত্র। তথাগত বুদ্ধ চরিত্রের উৎকর্ষতা সাধনের জন্য যেসব নিয়ম বিধিবদ্ধ করেছেন তা শীল নামে অভিহিত । প্রাণিহত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যাভাষণ, মাদক দ্রব্য সেবন ইত্যাদি থেকে বিরত থেকে কুশল কর্ম সম্পাদনের চেতনাই শীল। শীল পারমীর পরিপূর্ণতায় মানব জীবন পরিশুদ্ধ হয়। শীলে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির জীবন কলুষতাহীন এবং নির্বাণ অভিমুখী হয়। অপরদিকে দুঃশীল ব্যক্তির জীবন বেঁচে থেকেও মৃতবৎ। সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় দুঃশীল ব্যক্তি দ্বারা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে প্রভূত অশান্তি সৃষ্টি হয়। এজন্য তথাগত বুদ্ধ শীলকে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। গৌতম বুদ্ধ জন্মজন্মান্তরব্যাপী শীল পারমী চর্চা করেছেন। তিনি বোধিসত্ত্ব অবস্থায় একবার এক কুলপুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন । একদা তাঁর মাতা এক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। বহু চেষ্টা করেও রোগ নিরাময় করা গেল না। অবশেষে বৈদ্য পরামর্শ দিলেন যে, শশকের মাংস খাওয়ালে রোগ নিরাময় হবে। পরামর্শ মতো কুলপুত্র বহু কষ্টে জীবিত এক শশক ধরলেন। তখন শশকটি প্রাণভয়ে আর্তনাদ করতে লাগল। শশকের আর্তনাদে কুলপুত্রের চিত্তে মৈত্রী উৎপন্ন হয়। তিনি উপলব্ধি করলেন, আমার মায়ের জীবন আমার নিকট যেমন অতি প্রিয়, তেমনি এ অসহায় প্রাণীটির জীবনও তার কাছে অতি প্রিয়। একজনের জীবন রক্ষার জন্য অন্যের জীবন হরণ করব না- এরূপ ভেবে তিনি শশকটি ছেড়ে দিলেন। এভাবে বুদ্ধ হওয়ার পূর্বে সিদ্ধার্থ গৌতম অসংখ্য জন্মে শীল পারমী পূর্ণ করে চরিত্রের উৎকর্ষতা সাধন করেছিলেন ।

৫৬

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

নৈষ্ক্রম্য পারমী নৈষ্ক্রম্য' শব্দের অর্থ নির্গমন বা বের হয়ে যাওয়া। সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করে বা সংসার হতে বের হয়ে বিশুদ্ধ জীবনযাপন করাকে নৈষ্ক্রম্য বলা হয়। জাগতিক ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করে সংসারের বন্ধন হতে মুক্তির জন্য উৎসাহী হওয়ার ব্রতকে নৈষ্ক্রম্য পারমী বলে । বুদ্ধবংস গ্রন্থে নৈষ্ক্রম্য পারমীর স্বরূপ সম্পর্কে এরূপ বর্ণনা আছে কারাগারে আবদ্ধ বন্ধনজনিত দুঃখে দুঃখিত ব্যক্তি যেমন তথায় চিরকাল বাস করলেও সেখানে থাকতে ইচ্ছা করে না, মুক্তি লাভের চেষ্টা করে; সেরূপ তুমিও ভবত্রয়কে কারাগারের ন্যায় ভেবে মুক্তির জন্য নৈচমাভিমুখী হও। বুদ্ধ বলেছেন: গৃহবাস সর্বার্থ, প্রব্রজ্যা উন্মুক্ত আকাশ তুল্য । প্রব্রজিত ব্যক্তি যা ইচ্ছা করেন তা সহজেই পূর্ণ করতে পারেন। কারণ তিনি সংসারের জটিল বন্ধন থেকে মুক্ত। লোভ-দ্বেষ-মোহ মুক্ত। তিনি অল্প লাভে সন্তুষ্ট থাকেন ও উদ্যমশীল হন। বৌদ্ধধর্মে প্রব্রজ্যা অবলম্বনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। নৈষ্ক্রম্য পারমী পূরণের জন্য প্রথমে স্ত্রী-পুত্র, মাতা-পিতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বাড়িঘর, সংসার সম্পত্তি প্রভৃতি সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়। বোধিসত্ত্বগণ অনাগারিক জীবনযাপন করে নৈষ্ক্রম্য পারমী পূর্ণ করেন এবং নির্বাণ লাভের সাধনার পথে অগ্রসর হন।

প্রজ্ঞা পারমী : 'প্রজ্ঞা' শব্দের অর্থ হলো সম্যক চিন্তা। ভাবনার মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে প্রকৃষ্টরূপে জানা । জ্ঞান অর্জনের সাধনাই হলো প্রজ্ঞা পারমী প্রজ্ঞা পারমী তিন প্রকার। যথা চিন্তাময় প্রজ্ঞা, শ্রুতিময় প্রজ্ঞা এবং ভাবনাময় প্রজ্ঞা। অন্য কারো সাহায্য ব্যতীত পুনঃপুনঃ চিন্তা ভাবনার ফলে যে প্রজ্ঞা উৎপন্ন হয় তাকে চিন্তাময় প্রজ্ঞা বলে। সম্যকভাবে চিন্তা করলে সকল প্রকার কাজ ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করা যায়। এটিই চিন্তাময় প্রজ্ঞা। তথাগত বুদ্ধের সর্বজ্ঞতা জ্ঞানকে চিন্তাময় প্রজ্ঞা বলা যেতে পারে। কারণ তিনি আপন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই এ জ্ঞান অর্জন করেন। শ্রুতিময় প্রজ্ঞা দুভাবে অর্জন করা যায়। জ্ঞানী-গুণী বা গুরুর নিকট শুনে এ জ্ঞান অর্জন করা যায়। আবার অন্যের সাহায্য ব্যতীত গবেষণার মাধ্যমেও এ জ্ঞান লাভ করা যায়। ধ্যান সমাধির দ্বারা অর্জিত জ্ঞানকে ভাবনাময় প্রজ্ঞা বলে । প্রজ্ঞা পারমীর অনুশীলনে ক্লেশসমূহ ধ্বংস হয়। অনিত্য, দুঃখ এবং অনাত্মা সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি জাগ্রত হয়। বোধিসত্ত্বগণ প্রজ্ঞা পারমীর অনুশীলন করে অর্হত্ব ও বুদ্ধত্ব লাভের পথে অগ্রসর হন।

বীর্য পারমী : "বীর্য" শব্দের অর্থ হলো বীরত্ব, কর্মশক্তি ইত্যাদি। প্রবল উৎসাহ ও সম্যক প্রচেষ্টার মাধ্যমে কঠিন ব্রত সম্পাদন করাই হচ্ছে বীর্য পারমী। সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভের পূর্বে বুদ্ধত্ব লাভের জন্য কঠোর সাধনা করেছিলেন । তিনি কঠিন সংকল্প করে বলেছিলেন, 'আমার শরীর অস্থি মজ্জা শুকিয়ে গেলেও আমি বুদ্ধত্ব লাভ না করে এ আসন থেকে উঠব না। বুদ্ধত্ব লাভের এ প্রচেষ্টাই বীর্য পারমী । বোধিসত্ত্ব অতীত জন্মে এক কাঠবিড়ালীরূপে জন্মগ্রহণ করেন। কাঠবিড়ালীরূপী বোধিসত্ত্ব তখন নদীর ধারে এক বটবৃক্ষে বসবাস করত। সেখানে তার দুটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। একদিন বাচ্চা দুটি নদীতে পড়ে সাগরে ভেসে যায়। এতে সে খুব কষ্ট পায় এবং লেজ দ্বারা সমুদ্র সেচন করে বাচ্চা দুটি উদ্ধার করার সংকল্প করে। অতঃপর সে লেজ দ্বারা সাগরের পানি সেচন করতে থাকে। তার এ কঠোর পরিশ্রম দেখে দেবরাজ ব্রাহ্মণের বেশ ধারণ করে এসে জিজ্ঞাসা পারমী

করলেন, কাঠবিড়ালী তুমি কী করছ? কাঠবিড়ালী বলল, আমার বাচ্চা দুটি সাগরে তলিয়ে গেছে। তাদের উদ্ধারের জন্য জল সেচন করছি। ব্রাহ্মণ পুনরায় বলল, লেজ দ্বারা কি পানি সেচন করা সম্ভব? উত্তরে কাঠবিড়ালী বলল, চেষ্টা করলে সব কিছু করা যায়। অতঃপর সে প্রাণপণে লেজ দ্বারা সাগরের পানি সেচন করতে লাগল। কাঠবিড়ালীর উদ্যম ও চেষ্টা দেখে ব্রাহ্মণরূপী দেবরাজ, সমুদ্র হতে তার বাচ্চা দুটি উদ্ধার করে দিয়ে বললেন, 'কাঠবিড়ালী ! তোমার সদিচ্ছার জয় হোক। বোধিসত্ত্বগণকে বীর্য পারমী সাধনা করতে হয়।

ক্ষাস্তি পারমী 'ক্ষান্তি' পারমী হচ্ছে সহনশীলতার সাধনা । ক্ষান্তি শব্দের অর্থ হলো ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, নিবৃত্তি, বিরতি ইত্যাদি । ক্ষমা মহত্বের লক্ষণ। জ্ঞানীগণ সর্বদা ক্ষান্তি ও সহিষ্ণুতার প্রশংসা করে থাকেন। শাস্ত্রে ক্ষান্তি ও তিতিক্ষাকে পরম তপস্যা বলা হয়েছে। সর্ব অবস্থায় ক্ষমা বা সহনশীলতা প্রদর্শনের ব্রতই হচ্ছে ক্ষান্তি পারমী । বুদ্ধবংস গ্রন্থে বলা হয়েছে: 'পৃথিবীতে শুচি অশুচি নানাবিধ বস্তু নিক্ষিপ্ত হলেও পৃথিবী নীরবে সহ্য করে, নিক্ষেপকারীর প্রতি দয়া বা ক্রোধ কিছুই প্রদর্শন করে না। সেরূপ সকল মান-অপমান সহ্য করে ক্ষান্তি পারমী পূর্ণ করে সম্বোধি লাভ করতে হয়। সবল হয়েও যিনি দুর্বলকে ক্ষমা করেন তাঁর ক্ষান্তিই পরম ক্ষান্তি। ক্ষান্তি পারমী চর্চাকারী ব্যক্তি লাভ- অলাভ, যশ-অযশ, নিন্দা-প্রশংসা, সুখ-দুঃখ এই আট প্রকার লোক ধর্মে অবিচল থাকেন। তাঁরা পৃথিবীর ন্যায় মৌন, ইন্দ্রখীলের ন্যায় স্থির এবং স্বচ্ছ সরোবরের ন্যায় নির্মল হন। ক্রোধ আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ক্রোধ শুধু নিজেকে দগ্ধ করে না, অপরকেও দক্ষ করে । ক্রোধকে একমাত্র ক্ষান্তি পারমীর অনুশীলন দ্বারা দমন করা যায়। বোধিসত্ত্বগণ সর্বদা ক্ষান্তি পারমী অনুশীলন করে সাধনার পথে নিজেকে এগিয়ে নেন।

সত্য পারমী সর্বদা সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকার ব্রতকে সত্য পারমী বলে। বুদ্ধবংস গ্রন্থে বলা হয়েছে, 'সপ্তম পারমী অর্থাৎ সত্য পারমী ব্রত দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে সভ্যভাষি হলে সম্বোধি লাভের পথ সুগম হয়।' সত্য পারমীতে কথা ও কাজের মধ্যে মিল থাকা প্রয়োজন । জাতকে বোধিসত্ত্ব অবস্থায় গৌতম বুদ্ধের সত্য পারমী পূরণের অনেক কাহিনি পাওয়া যায়। এসব কাহিনিতে তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, মহাসুতসোম জাতকে দেখা যায়, বোধিসত্ত্ব নরমাংস খাদকের নিকট সত্যক্রিয়া করে মুক্তি লাভ করেন। একদা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বোধসত্ত্ব জীবন বিসর্জনের জন্য নরমাংস খাদকের নিকট উপস্থিত হন। নরমাংস খাদক তার সত্যব্রত দেখে বিস্মিত হয় এবং বোধিসত্ত্বের নিকট জীবনের মূল্যবান উপদেশ লাভ করে তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে । সে বলির উদ্দেশ্যে আনা সকল পশুকে মুক্ত করে দেয় এবং নরমাংস গ্রহণ হতে বিরত থাকার শপথ নেয়। এ জাতকে বোধিসত্ত্বকে বলতে দেখি, নরমাংস খাদক আমাকে বধ করবে কিনা আমার কোনো সংশয় উৎপন্ন হয়নি। সত্য বাক্য রক্ষার জন্য আমি জীবনের মায়া ত্যাগ করে নরমাংস খাদকের নিকট উপস্থিত হয়েছিলাম। সত্যে আমার সমকক্ষ কেহ নেই। এরূপ ছিল আমার সত্য পারমী। ত্রিপিটকে সত্য পারমী চর্চার এরূপ আরও অনেক কাহিনি পাওয়া যায় ।

ফর্মা-৮, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা-অষ্টম শ্রেণি

 

 

৫৮

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

অধিষ্ঠান পারমী অধিষ্ঠান' হলো দৃঢ় সংকল্পে অটল ও অচল থাকা। সর্ববিধ অন্তরায়কে পরাভূত করে কুশল কর্ম সম্পাদনে অবিচল থাকার ব্রতকে অধিষ্ঠান পারমী বলে। অধিষ্ঠান পারমীকে পারমীসমূহের মূলমন্ত্র বলা হয়। কারণ অধিষ্ঠান ছাড়া অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণের প্রধান অবলম্বন হলো অধিষ্ঠান। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধুলা প্রভৃতি ক্ষেত্রে সফলতার জন্য অধিষ্ঠান পারমীর অনুশীলন করা একান্ত প্রয়োজন । বুদ্ধবংস গ্রন্থে বলা হয়েছে : অধিষ্ঠান পারমী গ্রহণ করলে সম্বোধি অর্জিত হয়। অচল, সুপ্রতিষ্ঠিত শিলাময় পর্বত যেমন ঝড়-ঝঞ্ঝায় কম্পিত হয় না, স্বীয় স্থানে স্থিত থাকে, তদ্রূপ তুমিও অধিষ্ঠানে সর্বদা নিশ্চল হও। এরূপ অটল চিত্তের অধিকারী ব্যক্তি সম্বোধি লাভে সমর্থ হন। ত্রিপিটকে বোধিসত্ত্ব জীবনে গৌতম বুদ্ধের অধিষ্ঠান পারমী পূরণের অনেক কাহিনী পাওয়া যায়। চরিয়পিটকে তেমিয় পণ্ডিত বোধিসত্ত্ব বলেন, 'মাতা-পিতা আমার অপ্রিয় ছিল না। আমার নিজের সত্ত্বা আমার কাছে অপ্রিয় নয়। কিন্তু সর্বজ্ঞতা জ্ঞান অর্জনই আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়তর। এজন্য আমি বিভিন্নভাবে অধিষ্ঠান রক্ষা করেছি, কখনো অধিষ্ঠান ভঙ্গ করিনি।'

মৈত্রী পারমী স্নেহ, মায়া, মমতা, বন্ধুত্ব, প্রীতিভাব, ভালোবাসা ও উদারতা প্রদর্শন করাই হলো মৈত্রী। সর্বপ্রাণীর প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ করার ব্রতই হচ্ছে মৈত্রী পারমী। মৈত্রী পারমীর চর্চায় পরিপূর্ণভাবে মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধিত হয়। মানব জীবনে সফলতা বা পরিপূর্ণতা আনয়ন করতে মৈত্রী পারমীর গুরুত্ব অপরিসীম। বুদ্ধবংস গ্রন্থে মৈত্রী পারমী সম্পর্কে এরূপ বর্ণিত আছে : জল যেমন সৎ-অসৎ, হীন-উত্তম, সকলকেই শীতলতার দ্বারা শান্ত করে এবং শরীরের ময়লা বিদূরিত করে, তেমনি শত্রু-মিত্র সকলের প্রতি সমান প্রীতিভাব পোষণ করে মৈত্রী পারমীর সাধনা পূর্ণ করতে হয়। যাঁরা মৈত্রী সাধনা করেন তাঁদের হিংসা, ক্রোধ ইত্যাদি দূর হয়। তাঁদের কায়-মন- বাক্য সংযত হয়। তাঁরা সর্বপ্রাণীর মঙ্গল কামনা করেন এবং সকলের প্রিয় হন। তাই মৈত্রী ভাবনাকারীর কোনো শত্রু থাকে না । তাঁদের ইহকাল ও পরকাল সুখের হয়। যিনি সকল জীবের প্রতি মৈত্রীভাব পোষণ করেন, তিনি পরম শান্তি নির্বাণ লাভ করতে সক্ষম হন। এ কারণে বুদ্ধ সকলকে মৈত্রী পারমী অনুশীলনের উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, 'মা যেমন একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করেন, তেমনি সকল প্রাণীর প্রতি অপরিসীম মৈত্রীভাব পোষণ করবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি আনয়নে মৈত্রী পারমীর অনুশীলন করা একান্ত প্রয়োজন ।

উপেক্ষা পারমী : 'উপেক্ষা' হলো সর্ববিষয়ে চিত্তের নিরপেক্ষ ও সাম্য অবস্থা। সাধারণত প্রিয় বস্তু বা ব্যক্তি দেখলে চিত্ত প্রফুল হয়, অপ্রিয় বস্তু বা ব্যক্তি দেখলে চিত্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়। অনুরূপভাবে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তিতে চিত্ত আনন্দিত ও দুঃখিত হয়। যথাযথ নিরীক্ষণের মাধ্যমে সর্ব বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে চিত্তের নিরপেক্ষভাব বজায় রাখার ব্রত হলো উপেক্ষা পারমী। উপেক্ষা পারমীর অনুশীলনে চিত্ত আসক্তিহীন বা বিরক্তিহীন, অনুকূলতা বা প্রতিকূলতাবিহীন থাকে। বুদ্ধবংস গ্রন্থে বর্ণিত আছে তুলাদণ্ডের ন্যায় মধ্যস্থভাব সম্পন্ন হয়ে দৃঢ়চিত্তে উপেক্ষা পারমী অনুশীলন পারমী

করতে হয়। গৌতম বুদ্ধ বোধিসত্ত্ব অবস্থায় অনেকভাবে উপেক্ষা পারমী পূর্ণ করেছিলেন, মহালোমহংসক জাতকে দেখা যায়, বোধিসত্ত্ব একজনে ব্রহ্মচর্য পালনে ইচ্ছুক হয়ে শশ্মশানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এসময় তাঁর নাম হয় মহালোমহংসক ঋষি। সংসার অসার, এই দেহ ও জীবন ক্ষণস্থায়ী — এরূপ অনিত্য চিন্তায় মগ্ন হয়ে তিনি সাংসারিক কাজকর্মে নির্লিপ্ত থাকতেন। এতে বহু - লোক তাঁর প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন ছিলেন। ক্রমে লোমহংসক ঋষির লাভ -সৎকার, যশ-খ্যাতি ও প্রশংসা আরও বেড়ে যায়। অপরদিকে কেউ কেউ তাঁকে ভণ্ড ঋষি বলে তিরস্কার করত। তিনি বলতেন, যে আমাকে দুঃখ দেয় কিংবা সুখ দেয় আমি উভয়ের প্রতি সমভাবাপন্ন। এমনকি আমার প্রতি যার দয়া নেই তার প্রতিও আমার সমভাব রয়েছে। যারা আমাকে প্রশংসা বা নিন্দা করে তাঁদের সকলের প্রতি সর্বদা আমি সমভাবাপন্ন থাকি। এ আমার উপেক্ষা পারমী ।

অনুশীলনমূলক কাজ দান উপপারমী কাকে বলে? নৈষ্ক্রম্য শব্দের অর্থ কী ? আট প্রকার লোকধর্ম কী?

পাঠ : ৩

পারমী সম্পর্কিত কাহিনি : মহাকপি জাতক

মহাকপি জাতকটি পাঠ করে আমরা দশ পারমী বোঝার চেষ্টা করব। 'কপি' শব্দের অর্থ বানর। একবার বোধিসত্ত্ব বানররূপে জন্মগ্রহণ করে মহৎ কাজের জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। এজন্যে এ জাতকটি মহাকপি জাতক নামে অভিহিত । বোধিসত্ত্ব মহাকপি এক বনে বাস করত। বনের পাশেই ছিল কাশী গ্রাম। ঐ গ্রামের এক কৃষক বনের মধ্যে তার গরু খুঁজতে এসে পথ হারিয়ে ফেলে। পথ খুঁজতে খুঁজতে সে ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়ে। একটি ফলবান বৃক্ষ দেখে সে বৃদ্ধে উঠে ফল খেতে গিয়ে বৃক্ষের নিচে গর্তে পড়ে যায়। গর্তটি খুব গভীর ছিল। কৃষক নিজের চেষ্টায় গর্ভ থেকে ওপরে উঠতে পারছিল না। এভাবে দশদিন অতিবাহিত হলো। কৃষক আরও দুর্বল হয়ে গেল। এক সময় বানররূপী বোধিসত্ত্ব ফল খাওয়ার জন্য ঐ বৃক্ষের কাছে এলে মৃতপ্রায় কৃষককে গর্তের মধ্যে দেখতে পেল। কৃষককে বিপদগ্রস্থ দেখে বানরের দয়া হলো। সে কৃষককে বাঁচানোর সংকল্প করল এবং বাঁচানোর উপায় খুঁজতে লাগল। নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও সে কৃষককে বাঁচানোর শপথ করল। অনেক চিন্তা করে সে বাঁচানোর উপায় বের করল যদি কৃষককে পিঠে নিয়ে এক লাফে গর্ত থেকে উঠে আসা যায় তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব। এই ভেবে সে পিঠে বড় পাথর বেঁধে বার বার লাফ দেওয়া অনুশীলন করতে থাকল । এইকাজে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস অর্জনের পরে সে উদ্ধার অভিযান শুরু করলো। তার জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও সে তার সংকল্পে অটল রইল। বারবার চেষ্টার পর অবশেষে সে কৃষককে উদ্ধার

করতে সক্ষম হলো।

 

৬০

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

কৃষককে গর্ত থেকে উদ্ধারের পরে বানর অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাই অচেতন কৃষকের কোলে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে যায়। এসময় কৃষকের জ্ঞান ফিরলে সে বানরকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। পাথর দিয়ে সে বানরের মাথায় আঘাত করে। এতে বানরের মাথা ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। তখন বানরটি এক লাফে গাছে উঠে যায়। এরপর বানর চিন্তা করল কীভাবে কৃষককে বন থেকে বার হতে সাহায্য করা যায়। বানর এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে যেতে থাকে এবং রক্তের ফোঁটা নিচে পড়তে থাকে । এভাবে রক্তের ফোঁটা অনুসরণ করে কৃষক জঙ্গল থেকে বের হতে সমর্থ হয় ।

ঐ কৃষককে বাঁচানোর জন্য বানরের কোনো স্বার্থ ছিল না। শুধু দয়া ও করুণার বশবর্তী হয়ে মহাকপি কৃষকের জীবন রক্ষা করেছিল। বোধিসত্ত্বগণ এরূপ আত্মত্যাগ করে পরের হিতের জন্য কুশলকর্ম করেন । এভাবেই পারমীসমূহ পূর্ণ করতে হয়।

এখন উপরে বর্ণিত মহাকপি জাতকে বানররূপী বোধিসত্ত্ব কীভাবে কোন পারমী পূর্ণ করেছেন তা চিহ্নিত করব।

১) (বানররূপী) বোধিসত্ত্ব নিজের জীবন বিপন্ন করে কৃষককে বাঁচাতে চেয়েছেন। আত্মত্যাগের এই ইচ্ছাই দান পারমীর অন্তর্গত।

২) কৃষক পাথর দিয়ে বানরের মাথায় আঘাত করা সত্ত্বেও তিনি কোনো হিংসা বা প্রতিহিংসা

পোষণ করেননি। এটি শীল পারমী ।

৩) কোনো কিছুর আকাঙ্খা করে তিনি কৃষকের জীবন রক্ষায় নিয়োজিত হননি। এটি নৈষ্ক্রম্য পারমী ।

৪) কৃষককে গর্ত থেকে বাঁচানোর জন্য বোধিসত্ত্ব যে উপায় উদ্ভাবন করেন তা প্রজ্ঞা পারমী ।

৫) কৃষককে উদ্ধারের জন্য বার বার লাফ দেওয়া অনুশীলন করে তিনি সাহসের সাথে কাজটি করার

সিদ্ধান্ত নিয়ে বীর্য পারমীর উদাহরণ প্রদর্শন করেন।

৬) মাথায় আঘাত পেয়ে রক্তক্ষরণ ও প্রচণ্ড কষ্ট পাওয়া সত্ত্বেও কৃষকের প্রতি ক্ষুব্ধ আচরণ না করে চরম সহনশীলতা ও উদারতা প্রকাশ করেন। এই অহিংস চেতনাই ক্ষাস্তি পারমী । ৭) সংকল্প রক্ষায় তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ । নিজের জীবন বিপন্ন অবস্থায়ও তিনি সংকল্পে অনড়

ছিলেন । এটি সত্য পারমী । ৮) কৃষক বানরকে হত্যা করার চেষ্টা করলেও তিনি কৃষকের জীবন রক্ষার লক্ষ্য থেকে চ্যুত হননি। এই লক্ষ্যে একাগ্রতাই অধিষ্ঠান পারমী ।

৯) গভীর গর্তে পতিত মরণাপন্ন কৃষককে দেখে বানর যে করুণা ও উদ্বিগ্নতার প্রকাশ করেন তা মৈত্রী পারমী।

১০) বানর কৃষকের হত্যা প্রচেষ্টাকে গুরুত্ব না দিয়ে ধৈর্য ও করণীয় কর্মে একাগ্রতা বজায় রেখে যান এবং কৃষককে বনের বাইরে যেতে সাহায্য করেন। এই মনোভাব দ্বারা তিনি উপেক্ষা পারমীর দৃষ্টান্ত রেখেছেন।

 

পারমী

বৌদ্ধ সাহিত্যে বোধিসত্ত্বের পারমী পূরণের এরূপ আরও অনেক কাহিনী পাওয়া যায়। কাহিনীগুলো পাঠ করলে পারমী পূরণের উৎসাহ জাগ্রত হয়।

অনুশীলনমূলক কাজ

বানররূপী বোধিসত্ত্ব কীভাবে দান পারমী পূর্ণ করেছিলেন? মহাকপি জাতকে বোধিসত্ত্ব কি কি পারমী পূর্ণ করেছিলেন?

পাঠ : 8

বৌদ্ধধর্মে দশ পারমী চর্চার গুরুত্ব

নির্বাণ বৌদ্ধদের পরম লক্ষ্য। পারমীর চর্চা ব্যতীত নির্বাণ লাভ সম্ভব নয়। তাই বৌদ্ধধর্মে পারমী গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব হিসাবে স্বীকৃত এবং বৌদ্ধদের জন্য পারমী অনুশীলন করা অপরিহার্য। দশ পারমী পূরণের মাধ্যমে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বোধিসত্ত্বগণও বুদ্ধত্ব লাভের জন্য পারমী চর্চা করেন। কুশল কর্ম করার মাধ্যমে পারমী চর্চা করতে হয়। দশ পারমী চর্চায় চরিত্রের উৎকর্ষ ও পরিশুদ্ধিতা অর্জিত হয়। মানবিক গুণাবলির বিকাশ সাধিত হয়। ভয়-ভীতি, লোভ-দ্বেষ-মোহ, অজ্ঞতা, শত্রুতা প্রভৃতি দূরীভূত হয়। আর্তপীড়িতের সেবা এবং পরোপকার করার প্রেরণা জাগায়। দায়িত্ববোধ, সহমর্মিতা, সহিষ্ণুতা, কর্মোদ্যম প্রভৃতি সৃষ্টি হয়। পারমীর অনুশীলনে ছাত্র জীবনেও সাফল্য লাভ করা যায়। তাই ছাত্র জীবনে পারমীর অনুশীলন করা একান্ত দরকার। পরিবার ও সমাজে বিরাজমান বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা দূর করে শান্তি স্থাপনে পারমী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পারমীর গুণসমূহ শুধু বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের জন্য নয় এগুলো সকল বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের আচরণীয় হতে পারে। দশ পারমীর চর্চা জীবনে সাফল্য ও পূর্ণতা আনয়ন করে। পরিশেষে বলা যায়, নৈতিক, মানবিক ও উন্নত জীবন গঠনে দশ পারমী চর্চা অত্যাবশ্যক।

অনুশীলনমূলক কাজ

ছাত্র হিসাবে তুমি কোন কোন পারমী অনুশীলন করতে পার উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করো ।

Content added || updated By

Promotion