On This Page
অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

নবম অধ্যায়

জাতক

জাতক ত্রিপিটকের অন্তর্গত খুদ্দক নিকায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এ গ্রন্থে গৌতম বুদ্ধের অতীত জীবনের নানা কাহিনী ও ঘটনা বর্ণিত আছে। বুদ্ধ তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্য ও অনুসারীদের প্রসঙ্গক্রমে এসব কাহিনী ও ঘটনা বর্ণনা করতেন। এসব কাহিনী মানুষকে নৈতিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে। তাছাড়া এসব কাহিনীতে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের নানারকম তথ্য পাওয়া যায়। ফলে জাতক কাহিনীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সামাজিক প্রভাব অপরিসীম। এ অধ্যায়ে আমরা জাতকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, সামাজিক প্রভাব এবং পূর্ণ জাতক, ভদ্রঘট জাতক, শিবি জাতক, বন্ধুপথ জাতক, ন্যাগ্রোধমৃগ জাতক সম্পর্কে পড়ব এ অধ্যায় শেষে আমরা

* জাতকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ্লেষণ করতে পারব।

* জাতক পাঠের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা ও সমাধানের উপায়সমূহ চিহ্নিত করতে পারব ।

জাতক পাঠ করে তৎকালীন ভৌগোলিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয় ব্যাখ্যা করতে পারব।

* জাতক কাহিনি বলতে পারব।

পাঠ : ১

জাতকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব

পূর্বের শ্রেণিতে আমরা জাতক কী তা পড়েছি। এখন আমরা জাতকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব পড়ব। জাতকে প্রাচীন ভারতের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিষয়ে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। তাই জাতককে প্রাচীন ইতিহাসের অনন্য উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।

জাতক পাঠে প্রাচীন কালের রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে জানা যায়। জাতক পাঠে জানা যায় যে, তখনকার সমাজে চার প্রকার বর্ণ প্রথা প্রচলিত ছিল। যথা : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র । ব্রাহ্মণরা যাজক বা পুরোহিত ছিলেন। সমাজে তাঁদের অনেক প্রতিপত্তি ছিল। ক্ষত্রিয়রা রাজ্য শাসন করতেন। বৈশ্যরা ব্যবসা বাণিজ্য করতেন। শূদ্ররা ছিলেন শ্রমজীবী। সমাজে দাসপ্রথা প্রচলিত ছিল। জাতকে চণ্ডাল নামক নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরও উল্লেখ পাওয়া যায়। চণ্ডালরা শ্মশানে, বৃক্ষের নিচে বা বনাঞ্চলে বসবাস করত । পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মানুষ কৃষি ও পশু পালন করে জীবিকা নির্বাহ করত। নগরে প্রাসাদ, প্রমোদ-উদ্যান, মন্দির, ক্রীড়াভবন ও নৃত্যশালা ছিল। প্রাসাদগুলো ছিল

 

68

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

কাঠের তৈরি। ধনী ও রাজন্য শ্রেণির লোকের আমোদ-প্রমোদের মধ্যে ছিল শিকার, অস্ত্র চালনা, নৃত্য-গীত ইত্যাদি । রাজকন্যা ও অভিজাত সম্প্রদায়ের কন্যারা খেলাধুলা ভালোবাসতেন। খেলায় পণ রাখার রীতি ছিল এবং পণে হেরে গিয়ে অনেকে সর্বস্বান্ত হতেন। উৎসবের সময় নাচ ও গান হতো। সাপুড়েরা সাপ ও বানর নিয়ে খেলা দেখাত। বিবাহে পণ প্রথা প্রচলিত ছিল। বুদ্ধ পণ প্রথার নিন্দা করেন। তখন বিধবা বিবাহ প্রচলিত ছিল। জনসাধারণের প্রধান আহার ছিল ভাত, জাউ, মাছ, মাংস ইত্যাদি। উৎসবের সময় পায়েস ও পিঠা তৈরি করা হতো। স্বর্ণ ও রৌপ্য অলঙ্কারের প্রচলন ছিল।

জাতকে অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। জাতক পাঠে সমুদ্র বাণিজ্যের কথা জানা যায়। বিভিন্ন রকম পণ্য নিয়ে বণিকেরা অর্ণবপোতের সাহায্যে সমুদ্র পাড়ি দিতেন। বিভিন্ন স্থানে নোঙ্গর করে পণ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ-রৌপ্য-প্রবাল নিয়ে ফিরে আসতেন। রাজারা প্রজাদের নিকট হতে কর সংগ্রহ করতেন। প্রজারা শস্যের একটি অংশ কর হিসেবে প্রদান করত। মুদ্রা ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল। তবে পণ্যের বিনিময়ে পণ্য দেয়ার প্রথাও ছিল।

জাতক পাঠে রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। জাতক পাঠে আরো জানা যায় যে, প্রাচীন ভারত ষোলটি জনপদ বা রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বুদ্ধের সময়কালে মগধ, কোশল, বজ্জি, মল্ল প্রভৃতি শক্তিশালী রাজ্য ছিল এবং বৈশালী, চম্পা, শ্রাবস্তী, রাজগৃহ, বারানসি প্রভৃতি ছিল সমৃদ্ধশালী। নগর । বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে রাজন্যবর্গ ও শ্রেষ্ঠীগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে রাজা বিম্বিসার, রাজা অজাতশত্রু, রাজা প্রসেনজিত, শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক প্রমুখ ছিলেন অন্যতম ভগবান বুদ্ধ 'মহাধর্মপাল' জাতক শুনিয়ে তাঁর পিতা রাজা শুদ্ধোদনকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন । তিনি স্পন্দন, লটুকিক, বৃক্ষধর্ম, দদভ ও সম্মোদমান এই পঞ্চজাতক শুনিয়ে শাক্য ও কোলিয়নের দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসান ঘটিয়েছিলেন। শাসন ব্যবস্থা ছিল রাজতন্ত্র। রাজার হাতে ছিল শাসন ক্ষমতা। কিন্তু রাজা অত্যাচারী হলে প্রজারা বিদ্রোহ করত। অনেক সময় প্রজারা রাজা নির্বাচন করত।

জাতকে ধর্ম, শিক্ষা ও শিল্প সম্পর্কেও তথ্য পাওয়া যায়। এতে জানা যায় যে, জনগণ ধর্ম হিসেবে পূজা, যাগযজ্ঞ, তন্ত্র-মন্ত্র এবং বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। পশুবলি প্রথা প্রচলিত ছিল । গুরুগৃহে শিক্ষা দেয়া হতো। শুরু মেধা অনুসারে শিক্ষার্থীকে নানা প্রকার শাস্ত্র ও শিল্প শিক্ষা দিতেন। জাতক পাঠে নারী শিক্ষার কথাও জানা যায়। দেশের রাজা ও ধনী ব্যক্তিরা গুরুকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করতেন

উপরে বর্ণিত বিষয় বিবেচনা করে বলা যায়, জাতক প্রাচীন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ধারক

ও বাহক । তাই পুরাতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকগণ জাতককে প্রাচীন জনজীবনের জীবন্ত ইতিহাস হিসেবে

অভিহিত করেছেন জাতক

অনুশীলনমূলক কাজ

জাতককে কেন প্রাচীন জনজীবনের জীবন্ত ইতিহাস বলা হয়?

পাঠ : ২

জাতকের সামাজিক প্রভাব

জাতকের অনেক সামাজিক প্রভাব রয়েছে। জাতকের সমস্ত কথাই উপদেশমূলক এবং মহাপুরুষের বাক্য। জাতকে কঠিন ধর্মতত্ত্বসমূহ কাহিনীর মাধ্যমে সহজ সরলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এজন্য নৈতিক জীবন গঠন ও ধর্মতত্ত্ব বোঝার জন্য জাতকের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। জাতকে প্রাচীন ভারতের সমাজ জীবনের চিত্র পাওয়া যায়। বুদ্ধের সময়কালে ভারতবর্ষের সমাজ ব্যবস্থায় বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এ চারটি ভাগে সমাজ জীবন বিভক্ত ছিল। ব্রাহ্মণরা ছিলেন পুরোহিত বা যাজক শ্রেণির। সমাজে তাঁদের খুব প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। ক্ষত্রিয়রা ছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। তারা রাজ্য শাসন করতেন। বৈশ্যরা ব্যবসা বাণিজ্য এবং শূদ্ররা শ্রমজীবী ছিলেন। বুদ্ধ ছিলেন জাতিভেদ প্রথার বিরোধী। তিনি জন্ম নয়, কর্ম দ্বারাই মানুষের পরিচয় নির্ধারণ করেছেন। জাতক জাতিভেদ ও বর্ণ বৈষম্য পরিহার করতে শিক্ষা দেয়। জাতকের কাহিনীগুলো নৈতিক উপদেশে সমৃদ্ধ। যেমন লোভে পাপ পাপে মৃত্যু; ত্যাগ ও দানই শ্রেষ্ঠ ধর্ম: চাটুকারিতার ফল কখনো ভালো হয় না; শীলবান ব্যক্তি সর্বত্র পূজিত ও প্রশংসিত হয় ইত্যাদি। এসব নীতিকথা মানুষকে অনৈতিক কর্ম পরিহার করে কুশলকর্ম সম্পাদনে উদ্বুদ্ধ করে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সমাজ বিনির্মাণে সাহিত্যের প্রভাব অপরিসীম। জাতকের কাহিনীগুলোতে গল্প ও উপন্যাস রচনার প্রচুর উপকরণ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কুশ জাতক থেকে পটভূমি গ্রহণ করে রাজা, শাপমোচন, অরূপরতন এ তিনটি নাটক রচনা করেন। জাতকের কাহিনী সমাজের অসামঞ্জস্য বিষয়সমূহ চিহ্নিত করে সেগুলো দূরীভূত করার উপায় শিক্ষা দেয়। জাতক পাঠে সর্বজীবের প্রতি মায়া প্রীতি জন্মে। দানশীলতা, দয়াশীলতা, সহনশীলতা, ক্ষমা ও পরোপকারী মনোভাব সৃষ্টি হয়। এসব গুণাবলি আমাদেরকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। সমাজে অনেক কুসংস্কার প্রচলিত থাকে। কুসংস্কার ত্যাগ করে সত্য ও ন্যায়ের পথ অনুসরণ করতে জাতক শিক্ষা দেয়। অতএব বলা যায়, সমাজজীবনে জাতকের প্রভাব অপরিসীম।

অনুশীলনমূলক কাজ

জাতকের উপদেশের একটি তালিকা তৈরি করো।

 

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ : ৩ গুধ জাতক

পুরাকালে বারানসির রাজা ব্রহ্মদত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব গুধ বা শকুন হয়ে জন্মেছিলেন। বড় হওয়ার পর তিনি বুড়ো মা-বাবাকে দেখাশোনা করতেন। এক পর্বতের উপর শকুনদের নির্জন গুহায় তাঁরা থাকতেন। বোধিসত্ত্বরূপী গুধু বারানসির শ্মশান থেকে মৃত গরুর মাংস এনে মা ও বাবাকে খাওয়াতেন। সেই শ্মশানে এক ব্যাধ মাঝে মাঝে শকুন ধরার জন্য ফাঁদ পেতে রাখত। একদিন গু সেখানে মৃত গরুর মাংস খুঁজতে গেলেন। শ্মশানে ঢুকতেই তিনি ফাঁদে আটকে পড়লেন । তখন তিনি ভাবলেন, আমি ফাঁদে আটকে গেলাম এজন্য আমার চিন্তা নেই, কিন্তু আমার বুড়ো মা-বাবাকে কে খাওয়াবে? কেমন করে তাঁরা জীবন বাঁচাবে? খেতে না পেলে তাঁরা পর্বতের গুহায় মারা যাবে।

এরূপ চিন্তা করার পর বিলাপ করতে করতে তিনি বললেন, “নিষ্ঠুর ব্যাধের ফাঁদে আমি আটকে পড়েছি। আমার আর উদ্ধার পাওয়ার আশা নেই। কিন্তু আমার বুড়ো মা-বাবার কী হবে? তাঁদের দুর্দশা কে ঘোচাবে?"

গৃধ্রের এই বিলাপ শুনে ব্যাধ উত্তরে বলল, “কী দুঃখ তোমার, কিসের দুর্দশা? পাখি হয়েও মানুষের

ভাষায় এভাবে কথা বলতে আমি কাউকে দেখিনি। কী অদ্ভুত ব্যাপার।"

গৃধ্র পুনরায় তাকে বললেন, “আমার মা-বাবা খুব বৃদ্ধ। আমি তাঁদের ভরণ-পোষণ করি। কিন্তু এখন আমি তোমার ফাঁদে বন্দি। কে এখন তাঁদের দেখাশোনা করবে?"

ব্যাধ পুনরায় উত্তরে বলল,

"শকুনরা আকাশের অনেক উপর থেকেও মরা প্রাণী দেখতে পায়। কিন্তু তুমি কেন তা দেখতে পেলে না? কী তার কারণ?"

গুধ পুনরায় উত্তর দিলেন,

“আয়ু শেষ হলে জীবগণ কাছের জিনিসও দেখতে পায় না। আমিও সে কারণে এই ফাঁদ দেখতে পাইনি।”

তখন ব্যাধ তাঁকে বলল,

“তুমি নিজের জন্য না ভেবে বুড়ো মা-বাবার কথা ভাবছ দেখে আমি মুগ্ধ। সেজন্য তোমাকে আমি ফাঁদ থেকে মুক্তি দিলাম। তুমি নির্ভয়ে চলে যাও, মা-বাবার সেবা কর।"

গৃধ ব্যাধের সহৃদয় কথা শুনে তাকে বললেন, “তুমি ব্যাধ হয়েও দয়াবান। এজন্য তোমার মঙ্গল হোক। আত্মীয়দের সঙ্গে তুমিও সুখী হবে। আমি আমার বুড়ো মা-বাবার কাছে চললাম ।

বোধিসত্ত্বরূপী পুত্র মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ব্যাধকে ধন্যবাদ দিলেন। তারপর শ্মশান থেকে মুখে করে মাংস নিয়ে মা-বাবার কাছে চলে গেলেন ।

উপদেশ: মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সত্যবাদীরা চরম বিপদ থেকে রক্ষা পান।

অনুশীলনমূলক কাজ পুত্র কাদের কথা চিন্তা করছিলেন? ব্যাধ কেন গৃধ্রকে মুক্ত করে দিল?

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ : ৪

ভদ্রঘট জাতক

পুরাকালে বারানসিরাজ ব্রহ্মদত্তের রাজত্বকালে বোধিসত্ত্ব এক শ্রেষ্ঠীকুলে জন্মগ্রহণ করেন । বৃদ্ধ পিতার মৃত্যুর পর তিনি শ্রেষ্ঠীপদ প্রাপ্ত হন। তাঁর শ্রেষ্ঠীপদ প্রাপ্তির সময়ে গৃহে চল্লিশ কোটি ধন ভূগর্ভে নিহিত ছিল ।

অনেক দানাদি পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে শ্রেষ্ঠীরূপী বোধিসত্ত্ব মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যুর পর দেবকুলে জন্মগ্রহণ করে দেবতাদের রাজা হন। সেই শ্রেষ্ঠীর ছিল একটি মাত্র পুত্র। সে ছিল খুবই উচ্ছৃঙ্খল। পিতার মৃত্যুর পর সে রাজপথের উপর এক মণ্ডপ নির্মাণ করল। সেখানে বন্ধু-বান্ধব পরিবৃত হয়ে সে সুরাপানে মত্ত থাকত। প্রমত্ত অবস্থায় সে সহস্র মুদ্রা বিলিয়ে দিত। কেবল নৃত্য, গীত, বাদ্য প্রভৃতি ভোগ-বিলাসে সে নিমগ্ন থাকত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চল্লিশ কোটি ধন ও অন্যান্য সম্পত্তি নিঃশেষ করল। একদিন নিঃস্ব অবস্থায় জীর্ণ বস্ত্র পরিধান করে বিচরণ করতে লাগল। দেবকুলে দেবতাদের রাজারূপী শ্রেষ্ঠী তাঁর পুত্রের দুর্দশার কথা জানতে পারলেন । একদিন স্নেহবশত তিনি পুত্রের নিকট উপস্থিত হন। তিনি পুত্রকে একটি ঘট প্রদান করে বললেন, "বৎস ! এই ঘটটিকে সাবধানে রাখবে, যাতে ভেঙে না যায়। এটা যতদিন তোমার কাছে অক্ষত থাকবে, ততদিন তোমার ধনের অভাব হবে না। এটির রক্ষণাবেক্ষণে যেন কোনো ত্রুটি না হয়।" তিনি পুত্রকে এই উপদেশ প্রদান করে পুনরায় দেবলোকে ফিরে গেলেন ।

পুত্র ঘটের নিকট যা চাইত তা-ই পেত। ঘট প্রাপ্তির পর পুত্রটি পুনরায় ধনী হয়ে গেল । সে আবার আগের মতো দিবারাত্র মদ্য পানে রত হলো। সুবিধাভোগী বন্ধুবান্ধবরা আবার তাকে ঘিরে ধরল । অবশেষে একদিন উন্মত্ত অবস্থায় সে ঘটটিকে বারবার ঊর্ধ্বে ছুড়ে দিয়ে ধরতে লাগল। এরূপ করার সময় একবার সে আর ঘটটি ধরতে পারল না। সেটি মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল।

 

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ : ৫

শিবি জাতক

প্রাচীনকালে শিবি রাজ্যের অরিষ্টপুর নগরে মহারাজ শিবি রাজত্ব করতেন। বোধিসত্ত্ব তাঁর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তখন তাঁর নাম রাখা হয়েছিল শিবিকুমার। তিনি বাল্যকালে তক্ষশীলায় গিয়ে বিবিধশাস্ত্র শিক্ষা করেন। সেখান থেকে রাজধানী অরিষ্টপুর নগরে ফিরে এলে তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পিতা তাঁর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁকে উপযুক্ত পদে নিয়োগ দান করলেন ।

কালক্রমে শিবি মহারাজের মৃত্যু হলো। শিবিকুমার রাজ্যের রাজা হয়ে যথাধর্ম রাজত্ব করতে লাগলেন । তিনি দশবিধ রাজধর্ম প্রতিপালন করতেন এবং অত্যন্ত প্রজাবৎসল ছিলেন। রাজধানীর ছয়টি স্থানে পানশালা নির্মাণ করে দৈনিক অনেক মুদ্রা ব্যয় করে মহাদান দিতেন। পূর্ণিমা, অমাবস্যা ও অষ্টমী তিথিতে নিজে দানশালায় গিয়ে দান বিতরণ দেখাশোনা করতেন ।

একদিন পূর্ণিমা তিথিতে তিনি সকালবেলা রাজপালঙ্কে বসে ছিলেন। তখন তাঁর দানকার্যের কথা মনে পড়ল তিনি দেখলেন, তাঁর বস্ত্র দান করার আর বাকি নেই। কিন্তু বাহ্যিক দানে তিনি পরিতৃপ্ত নন। তাঁর নিজ দেহের অংশ দান করে আধ্যাত্মিক দান পূর্ণ করার সংকল্প গ্রহণ করলেন। যদি কোনো প্রার্থী তাঁর দেহের মাংসখণ্ড চায় তিনি তা দান করবেন। কেউ হৃৎপিণ্ড চাইলে তাও দেবেন। যদি কেউ গৃহকর্মের জন্য তাঁকে দাস হিসেবে নিতে চায় তাহলে তিনি রাজবেশ ত্যাগ করে দাসত্ব করবেন ।

এমনি করে তিনি নানা আধ্যাত্মিক দানের বিষয় চিন্তা করছিলেন। শেষে তিনি চক্ষু দান করার সংকল্প করেন এরূপ ভাবনা করে রাজা সুগন্ধযুক্ত ষোল কলসি জলে স্নান করলেন। রাজাভরণে সজ্জিত হলেন। তারপর সুসজ্জিত হস্তীরাজের পিঠে আরোহণ করে দানশালার দিকে যাত্রা করলেন।

এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর চক্ষুদানের মনোবাসনা জানতে পেরে ভাবতে লাগলেন শিবিরাজ চক্ষুদানে কতটুকু সমর্থ? এটা তো দুস্কর কাজ। জগতে বিরল ঘটনা। দেবরাজ শিবিরাজের দানপারমী পূরণের যোগ্যতা পরীক্ষা করতে চাইলেন। তাই তিনি অন্ধ ব্রাহ্মণের বেশ ধরে দেবলোক থেকে মর্ত্যলোকে চলে এলেন । রাজার পমন পথে দাঁড়িয়ে শিবিরাজের মঙ্গল কামনা করে বললেন, মহারাজের জয় হোক। রাজা একথা শুনে হাতি থেকে নেমে ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী বললেন? অন্ধ ব্রাহ্মণ উত্তর দিলেন, মহারাজ! আপনার দানশীলতার কীর্তি ত্রিভুবনে ঘোষিত হয়েছে। আমি একজন অন্ধ, আপনি চক্ষুষ্মান। আমি অনেক দূরদেশ থেকে কষ্ট করে এসেছি। আমাকে আপনার একটি চক্ষু দান করুন, আমি পৃথিবীর আলো দেখতে চাই। তা শুনে রাজা ভাবলেন আমার কী পরম লাভ। আমি প্রাসাদে বসে চিন্তা করে এসেছি। আজ আমার মনোবাসনা পূর্ণ হবে। যা পূর্বে দান করিনি তা আজ দান করব। আজ আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে। যাচকের পরিচয় জানতে চেয়ে রাজা বললেন, হে অন্ধ ব্রাহ্মণ। আমার চক্ষুদান দেখতে আপনাকে এখানে কে পাঠিয়েছেন? মানুষের সবচেয়ে প্রিয় চক্ষু আপনাকে কে দান করবে?

জাতক

প্রত্যুত্তরে অন্ধ ব্রাহ্মণ বললেন, যিনি ত্রিলোক শাসন করেন, সেই দেবরাজ ইন্দ্র আমাকে আসতে বলেছেন। তাঁর স্ত্রী সুজাও আপনার সর্বশ্রেষ্ঠ দান দেখতে চান। রাজন । এবার আমার প্রার্থনা। পূর্ণ করুন। আমাকে আপনার একটি চক্ষু দান করুন। রাজা উত্তরে বললেন, হে ব্রাহ্মণ । অচিরেই আপনার আশা পূরণ করা হবে । আপনি একটি চেয়েছেন। আমার দুটি চক্ষুই আপনাকে দান করব । জগতবাসী আমার দানের মহিমা দেখুক

রাজা ভাবলেন, দানশালার সামনে চক্ষুদান করা ঠিক হবে না। পাত্র-মিত্র সবাই আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসবে । এজন্য তিনি ব্রাহ্মণকে রাজ অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন। রাজবৈদ্য সীবককে খবর দিলেন। রাজাজ্ঞা পেয়ে সীবক চলে এল। রাজা তাঁকে আদেশ দিলেন, 'প্রথমে আমার একটি চক্ষু সাঁড়াশি দিয়ে তুলে ফেল। সে কথা অন্ধ ব্রাহ্মণরূপী দেবরাজ শুনছিলেন। তিনি নির্দিষ্ট আসনে বসে আছেন ।

এদিকে এ খবর সমস্ত নগরে তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। সবখানে কোলাহল উৎপন্ন হল। রাজার প্রিয়পাত্র, নগরবাসী, অন্তঃপুরবাসী সবাই সমবেত হলো। সকলের পক্ষ থেকে সেনাপতি রাজাকে চক্ষুদান করতে বারণ করলেন।

রাজভাণ্ডারের মণিমুক্তা, ধন-দৌলত সব দান করে দিন। তবুও আপনার আলো প্রদায়ী চক্ষু দেবেন না। উপস্থিত জনতাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে রাজা বললেন, আমি চক্ষু দেব বলে মনস্থির করেছি, কথা দিয়েছি, সংকল্প ত্যাগ করা উচিত নয়। আমার চক্ষুদানে অন্ধ ব্রাহ্মণ জগতের আলো দেখবে। আর আমি বোধির আলোতে উদ্ভাসিত হব। সেনাপতি, অমাত্য সবাই নীরব হয়ে গেলেন।

রাজা সীবককে পুনরায় বললেন, তুমি আমার কল্যাণমিত্র। আমার দান পারমী পূরণে সহায়তা কর। আমার চক্ষু উৎপাটন কর। সীবক তদুত্তরে বললেন, মহারাজ ! বিবেচনা করে দেখুন। চক্ষু দান করা বড় কঠিন কাজ। রাজা বললেন, 'সীবক', আমি আমার সিদ্ধান্তে স্থির। কালবিলম্ব না করে আমার আদেশ পালন কর ।

সীবক রাজাকে সুযোগ দেয়ার জন্য প্রথমে শক্ত ঔষধ প্রয়োগ করলেন না। নানারকম ঔষধ চূর্ণ করে একটি নীলপদ্মের ওপর সেগুলো ছড়িয়ে রাখলেন। ঐ পদ্ম রাজার দক্ষিণ চক্ষুতে বুলিয়ে দিলেন। অমনি চক্ষুর গোলক ঘুরে গেল। সীবক বললেন, মহারাজ, ভেবে দেখুন। আমি এখনো প্রতিকার করতে পারি । রাজা উত্তর দিলেন, না ভাই, আমি সংকল্পে অটুট। সর্বজ্ঞতাই আমার চক্ষু ।

এভাবে রাজাকে তিনবার অনুরোধ করলেন। শেষে সীবক বাম হাতে রাজার চক্ষুটি ধরে ডান হাতে অস্ত্র প্রয়োগ করে চক্ষুটি রাজার হাতে দিলেন । ভীষন যন্ত্রণা সহ্য করে রাজা চক্ষুটি ব্রাহ্মণকে দিয়ে বললেন, আমার চক্ষু নিন। এ চক্ষু অপেক্ষা আমার নিকট সর্বজ্ঞতা চক্ষু হাজার গুণে প্রিয় ও শ্রেষ্ঠ তিনি মনে মনে পুলকিত হয়ে অনুরূপভাবে অপর চক্ষুটিও ব্রাহ্মণকে দান করলেন। অন্ধ ব্রাহ্মণ সেই চটিও নিয়ে রাজভবন থেকে দেখলোকে চলে গেলেন।

চক্ষুদানের কিছুদিন পর রাজা রাজপ্রাসাদে বসে ভাবলেন, যে জন অন্ধ তাঁর রাজ্যের কী প্রয়োজন? তিনি অমাত্যদের হাতে রাজ্য সমর্পণ করে উদ্যানে গিয়ে এরা গ্রহণ করে শ্রামণ্যধর্ম পালনের ইচ্ছা পোষণ করলেন। এ অভিবারের কথা জানিয়ে অমাত্যদেরকে ডেকে বললেন, আমার আর রাজত্বের দরকার নেই। আমি এখন অফ। আমাকে সাহায্য করার জন্য একজন লোক দিলেই চলবে। পাশের উদ্যানেই আমি ধ্যান- সমাধি চর্চা করে অবস্থান করব।

পালকে বসিয়ে অন্ধ রাজাকে উদ্যানস্থ পুকুর পাড়ে নেয়া হলো। সেখানে উপবেশন করিরে অমাত্যরা ফিরে গেলেন তাঁর সেবা শুধুষার ব্যবস্থা করা হলো। রাজা পালকে বসে নিজের সানের কথা ভাবতে লাগলেন অমনি দেবরাজ ইন্দ্রের আসন উত্তপ্ত হলো। তিনি এর কারণ বুঝতে পারলেন এবং ভাবলেন, রাজাকে বর দিয়ে চক্ষু দুটি পূর্বের মতো করে দেব।

জাতক

এ সংকল্প করে তিনি পুকুরঘাটে গিয়ে শিবিরাজের অদূরে পায়চারি করতে লাগলেন । পায়ের শব্দ শুনে রাজা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আমি আপনাকে বর দিতে এসেছি। ইচ্ছা করলে বর চাইতে পারেন। শিবিরাজ বললেন, আমার ধন, জন, বল অনেক আছে । কিন্তু তাতে কী ফল? এখন মৃত্যু ছাড়া গত্যন্তর নেই। তখন দেবরাজ বললেন, শিবিরাজ ! আপনি কি কেবল মৃত্যু কামনা করেই মরতে চান, না অন্ধ হয়েছেন বলে মরতে চান? রাজা উত্তর দিলেন, দেবেন্দ্র । আমি অন্ধ হয়েছি বলেই মরণ চাই ।

তখন দেবরাজ বললেন, হে শিবিরাজ ! ইহলোক ও পরলোকে দানফল ভোগ করা যায়। মানুষ পরলোকের সুখ শান্তির আশায় দান করে। আবার ইহজীবনে তার ফল প্রাপ্তির উদ্দেশ্যেও দানকার্য সম্পাদন করে থাকে । যাচক আপনার একটি চক্ষু চেয়েছিল। আপনি দুটি চক্ষু দিয়েছিলেন । সেই পুণ্যফল স্মরণ করে সত্যক্রিয়া করুন। আপনার আশা অবশ্যই পূর্ণ হবে। এ সত্যের প্রভাবে আবার চক্ষু লাভ হবে।

তা শুনে রাজা বললেন, দেবরাজ। যদি প্রকৃতই আপনি চক্ষু দান করতে ইচ্ছা করেন, তাহলে উপায় নির্দেশ করবেন না। আমার দানের ফলেই চক্ষু উৎপন্ন হবে। ইন্দ্র বললেন, হে শিবিরাজ । আমি দেবরাজ ইন্দ্র। কাউকে চক্ষু দেবার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার নিজের দানই সুফল প্রদান করুক। শিবিরাজ সত্যক্রিয়া করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম চক্ষুটি উৎপন্ন হলো। তিনি ব্রাহ্মণকে একটির পরিবর্তে

দুটি দান করেছিলেন। এ সত্যক্রিয়ার প্রভাবে অপরটিও আবির্ভূত হলো। এ দুটি পূর্বের চক্ষু নয়,

দিব্যচক্ষুও নয়, সত্যপারমিতা চক্ষু ।

এ রকম বিস্ময়কর ঘটনা শুনে রাজপরিবারবর্গ, পাত্রমিত্র সবাই সমবেত হলেন। উপস্থিত জনতাকে উপলক্ষ করে দেবরাজ ইন্দ্র উপদেশ দিলেন, তোমাদের রাজার পূর্ব চক্ষু দৃষ্টিবন্ধ ছিল। বর্তমানের চক্ষু দূর দূরান্তের পর্বত ভেদ করে সবকিছু অবলোকন করতে পারবে। তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে ধর্মপথে জীবন পরিচালিত কর। এই বলে তিনি দেবলোকে প্রস্থান করলেন।

শিবিরাজ পুনরায় চক্ষু লাভ করেছেন এ সংবাদ অচিরে শিবিরাজ্যে প্রচারিত হলো। তখন রাজ্যবাসী পূজার সামগ্রী নিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে একত্র হলো। তাঁরা মনের আকুতি নিয়ে লোকশ্রেষ্ঠকে শ্রদ্ধা জানালেন। রাজা তাদেরকে দান, শীল, ভাবনা প্রভৃতি পুণ্যব্রতে রত থাকার জন্য উপদেশ দিলেন ।

উপদেশ : ত্যাগ ও দানই শ্রেষ্ঠ ধর্ম ।

অনুশীলনমূলক কাজ

বাহ্যিক দান কী বলো।

আধ্যাত্মিক দান কী লেখ। শিবিরাজ কীভাবে দেবরাজ ইন্দ্রের মনোবাসনা পূর্ণ করলেন? বর্ণনা করো।

জাতক

এ সংকল্প করে তিনি পুকুরঘাটে গিয়ে শিবিরাজের অদূরে পায়চারি করতে লাগলেন । পায়ের শব্দ শুনে রাজা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি দেবরাজ ইন্দ্র। আমি আপনাকে বর দিতে এসেছি। ইচ্ছা করলে বর চাইতে পারেন। শিবিরাজ বললেন, আমার ধন, জন, বল অনেক আছে । কিন্তু তাতে কী ফল? এখন মৃত্যু ছাড়া গত্যন্তর নেই। তখন দেবরাজ বললেন, শিবিরাজ ! আপনি কি কেবল মৃত্যু কামনা করেই মরতে চান, না অন্ধ হয়েছেন বলে মরতে চান? রাজা উত্তর দিলেন, দেবেন্দ্র । আমি অন্ধ হয়েছি বলেই মরণ চাই ।

তখন দেবরাজ বললেন, হে শিবিরাজ ! ইহলোক ও পরলোকে দানফল ভোগ করা যায়। মানুষ পরলোকের সুখ শান্তির আশায় দান করে। আবার ইহজীবনে তার ফল প্রাপ্তির উদ্দেশ্যেও দানকার্য সম্পাদন করে থাকে । যাচক আপনার একটি চক্ষু চেয়েছিল। আপনি দুটি চক্ষু দিয়েছিলেন । সেই পুণ্যফল স্মরণ করে সত্যক্রিয়া করুন। আপনার আশা অবশ্যই পূর্ণ হবে। এ সত্যের প্রভাবে আবার চক্ষু লাভ হবে।

তা শুনে রাজা বললেন, দেবরাজ। যদি প্রকৃতই আপনি চক্ষু দান করতে ইচ্ছা করেন, তাহলে উপায় নির্দেশ করবেন না। আমার দানের ফলেই চক্ষু উৎপন্ন হবে। ইন্দ্র বললেন, হে শিবিরাজ । আমি দেবরাজ ইন্দ্র। কাউকে চক্ষু দেবার ক্ষমতা আমার নেই। আপনার নিজের দানই সুফল প্রদান করুক। শিবিরাজ সত্যক্রিয়া করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম চক্ষুটি উৎপন্ন হলো। তিনি ব্রাহ্মণকে একটির পরিবর্তে

দুটি দান করেছিলেন। এ সত্যক্রিয়ার প্রভাবে অপরটিও আবির্ভূত হলো। এ দুটি পূর্বের চক্ষু নয়,

দিব্যচক্ষুও নয়, সত্যপারমিতা চক্ষু ।

এ রকম বিস্ময়কর ঘটনা শুনে রাজপরিবারবর্গ, পাত্রমিত্র সবাই সমবেত হলেন। উপস্থিত জনতাকে উপলক্ষ করে দেবরাজ ইন্দ্র উপদেশ দিলেন, তোমাদের রাজার পূর্ব চক্ষু দৃষ্টিবন্ধ ছিল। বর্তমানের চক্ষু দূর দূরান্তের পর্বত ভেদ করে সবকিছু অবলোকন করতে পারবে। তোমরা অপ্রমত্ত হয়ে ধর্মপথে জীবন পরিচালিত কর। এই বলে তিনি দেবলোকে প্রস্থান করলেন।

শিবিরাজ পুনরায় চক্ষু লাভ করেছেন এ সংবাদ অচিরে শিবিরাজ্যে প্রচারিত হলো। তখন রাজ্যবাসী পূজার সামগ্রী নিয়ে রাজপ্রাসাদের বাইরে একত্র হলো। তাঁরা মনের আকুতি নিয়ে লোকশ্রেষ্ঠকে শ্রদ্ধা জানালেন। রাজা তাদেরকে দান, শীল, ভাবনা প্রভৃতি পুণ্যব্রতে রত থাকার জন্য উপদেশ দিলেন ।

উপদেশ : ত্যাগ ও দানই শ্রেষ্ঠ ধর্ম ।

অনুশীলনমূলক কাজ

বাহ্যিক দান কী বলো।

আধ্যাত্মিক দান কী লেখ। শিবিরাজ কীভাবে দেবরাজ ইন্দ্রের মনোবাসনা পূর্ণ করলেন? বর্ণনা করো।

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

পাঠ : ৬

বন্ধুপথ জাতক

পুরাকালে বারানসি নগরে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। সেসময় বোধিসত্ত্ব এক বণিকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন । বোধিসত্ত্ব বড় হয়ে পাঁচশত গাড়ি নিয়ে নানা জায়গায় বাণিজ্য করতেন।

ব্যবসা উপলক্ষে একবার বোধিসত্ত্ব ঘাট যোজন বিস্তৃত এক মরু অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছেন। সেই মরুভূমির বালি এতো মিহি ছিল যে তা হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যেত না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে সে বালি গলে পড়ে যেত। সূর্য ওঠার পর সেই বালুরাশি জ্বলন্ত কয়লার মতো গরম হয়ে উঠত। তখন সেই মরুভূমির ওপর দিয়ে কারও পক্ষে চলাফেরা করা সম্ভব হতো না। সেই ভীষণ মরুপথ পার হতো রাতে, দিনে নিতে হতো বিশ্রাম। ব্যবসায়ীরা সঙ্গে জল, তেল, চাল ও লাকড়ি ইত্যাদি রাখত। সূর্য উদয় হলে যাত্রা বন্ধ করে বলদগুলো গাড়ি থেকে খুলে দিত। গাড়িগুলো গোল করে সাজিয়ে নিয়ে মাঝখানে সামিয়ানা খাটিয়ে নিত। সকাল সকাল রান্নাবান্না করে খেয়ে সামিয়ানার নিচে দিন কাটাত। আবার যখন সূর্য ডুবতে বসত তখন তাড়াতাড়ি রান্না করে খেয়ে নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করত । নাবিকরা যেমন সমুদ্রে চলার সময় নক্ষত্র দেখে দিক নির্ণয় করে তেমনি মরূভূমিতে চলার সময় পথ প্রদর্শকরা নক্ষত্র দেখে পথ চিনে নিতেন।

বোধিসত্ত্ব একদিন সেই মরুভূমির ঊনষাট যোজন পথ অতিক্রম করে গেলেন। তারপর তিনি ভাবলেন, বাকি একযোজন পথও রাতের মধ্যে পার হয়ে যাবেন। এই ভেবে তিনি সন্ধ্যার পর জল, কাঠ ইত্যাদি অনেক জিনিস দরকার নেই দেখে ফেলে দিতে বললেন। এতে বোঝা হালকা হবে এবং মরুভূমি পার হয়ে গেলে সেসব জিনিস সব জায়গায় পাওয়া যাবে। এভাবে তাঁরা চলতে শুরু করলেন। যে গাড়িখানা দলের আগে চলছে তাতে বসা ছিল পথ প্রদর্শক। তিনি নক্ষত্র দেখে পথ চিনিয়ে দিচ্ছিলেন।

দীর্ঘদিন মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলতে চলতে পথ প্রদর্শকের ভালো ঘুম হচ্ছিল না। সেই রাতে তার চোখ জুড়ে ঘুম এল। বলদগুলোও আপন খেয়ালে উল্টো দিকে চলতে শুরু করল। সারারাত এভাবে সব গাড়ি চলল। ভোর হওয়ার আগে আগে পথ প্রদর্শকের ঘুম ভাঙল। আকাশের দিকে তাকিয়ে সে তাড়াতাড়ি বলল, গাড়ি ঘোরাও, গাড়ি ঘোরাও। সমস্ত গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে সূর্য ওঠার সময় হয়ে গেল। সবাই দেখল আগের সন্ধ্যায় তারা যেখান থেকে যাত্রা করেছিল ঠিক সেই জায়গাতেই তারা আবার ফিরে এসেছে। তখন সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ল। গাড়িতে জল নেই, কাঠ নেই । উপায় কী হবে ? উপায় না দেখে তারা বলদগুলো খুলে দিয়ে গাড়ি জড়ো করে সামিয়ানা খাটিয়ে হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ল ।

জাতক

বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, আমি চেষ্টা করে উপায় খুঁজে বের না করলে সবাই মারা যাবে। ভোরের সময় ঠাণ্ডায় ঠান্ডায় একবার চারদিকে ঘুরে দেখি, কোথাও জল পাওয়া যায় কিনা। এই ভেবে চারিদিকে ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় এক গুচ্ছ ঘাস দেখতে পেলেন। এতে তিনি বুঝতে পারলেন যে ওই জায়গায় নিশ্চয়ই জল আছে। নতুবা সেখানে ঘাস জন্মাতে পারত না। তখন তিনি তাঁর অনুচরদের কোদাল দিয়ে সেখানে খুঁড়তে আদেশ দিলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে ষাট হাত নিচে একটা পাথরে কোদালের কোপ পড়ে ঠং করে শব্দ হলো। বোধিসত্ত্ব নিচে নেমে পড়লেন। তিনি পাথরের ওপর কান পেতে শুনতে পেলেন নিচে জলের শব্দ হচ্ছে। তখন তিনি উপরে উঠে এক চাকরকে বললেন, তুমি নিচে নামো। বড় হাতুড়িটা দিয়ে পাথর ভাঙার চেষ্টা করো। চাকরটি খুব উৎসাহী ও উদ্যমী ছিল। সে দ্বিধা না করে প্রভুর আদেশ মতো পাথরের ওপর হাতুড়ির ঘা দিতে লাগল। তাতে পাথর ভেঙে গেল। অমনি ভিতরের জল উপর দিকে ছিটকে বেরিয়ে এল। সবাই মহাখুশিতে স্নান করল, জল পান করল।

বোধিসত্ত্ব মরুভূমিতে পানি খুঁজে পেল

তারপর গাড়িতে যেসব বাড়তি ঢাকা ও কাঠের সরঞ্জাম ছিল সেগুলো চিরে জ্বালানী কাঠ তৈরি করল। সেই কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাল। রান্নাবান্না করল। সবাই খেল। গরুগুলোকে খাইয়ে দাইয়ে চাজা করে তুলল। তারপর কুয়োর পাশে একটা পতাকা পুঁতে দিল, যাতে দূর থেকে পতাকাটি দেখে অন্য বণিকরা সহজে কুয়োটি চিনতে পারে। রাত নামলে তাঁরা মরুভূমি পাড়ি দিলেন। রাতের ফর্ম- ১৪, বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা-আম শ্রেণি

 

বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

শেষে গন্তব্য স্থানে পৌঁছালেন। সেখানে বেচাকেনা করে বোধিসত্ত্বের অনেক লাভ হলো। তারপর দেশে ফিরে এসে সুখে বাস করতে লাগলেন। বোধিসত্ত্ব পরিণত বয়সে পরলোক গমন করে স্বর্গে গেলেন।

উপদেশ বিপদে অধীর না হয়ে উদ্ধারের পথ খোঁজা উচিত।

পাঠ : ৭

ন্যাগ্রোধমৃগ জাতক

পুরাকালে বারানসিরাজ ব্রহ্মদত্তের সময়ে বোধিসত্ত্ব হরিণরূপে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর দেহের রং ছিল সোনার মতো । শিংগুলো রূপালি, মুখ লাল এবং চোখ দুটো ছিল মণিরত্নের মতো উজ্জ্বল । তিনি ন্যাগ্রোধ মৃগরাজ নাম ধারণ করে পাঁচশ মৃগের দলনেতা হয়ে অরণ্যে বিচরণ করতেন।

রাজা ব্রহ্মদত্ত অত্যন্ত মৃগয়াসক্ত ছিলেন। মৃগ মাংস না পেলে তাঁর আহার হতো না। তিনি প্রতিদিন বহু প্রজা সঙ্গে নিয়ে মৃগ শিকারে যেতেন। প্রজাদের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটায় তারা বড় বিরক্ত হয়ে পড়ল। শেষে একদিন তারা পরামর্শ করে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজার উদ্যানে মৃগদের আহারের জন্য তৃণ রোপণ করল। রূপ, পুস্করিণী খনন করে জলের আয়োজন করল। তারপর বন থেকে সকল মৃগ তাড়িয়ে এনে উদ্যানের মধ্যে প্রবেশ করাল এবং উদ্যানের হার বন্ধ করে দিল।

এভাবে বহু মৃগ সংগ্রহ করে তারা রাজার কাছে গিয়ে বলল, “মহারাজ, আপনি প্রতিদিন মৃগয়ায় গিয়ে আমাদের কাজে ব্যাঘাত করছেন। আমরা আপনার উদ্যান মৃগপূর্ণ করে রেখেছি। এখন

থেকে নিজে নিজে উদ্যানের মৃগ বধ করে ভোজন করুন।"

ব্রহ্মদত্ত উদ্যানে গিয়ে দেখলেন, সত্যই শত শত মৃগ উদ্যানে বিচরণ করছে। সোনালি বরণ ন্যাগ্রোধ মৃগরাজকে দেখে তিনি বললেন, “ তোমাকে অভয় দিলাম। তুমি নিঃশঙ্ক চিত্তে বাস কর।"

তারপর কোনো দিন রাজা উদ্যানে গিয়ে নিজে শরবিদ্ধ করে মৃগ হত্যা করতেন। কোনো দিন তাঁর পাচক গিয়ে মৃগ হত্যা করে নিয়ে এসে রান্না করত। এভাবে প্রতিদিন মৃগ হত্যা করা হতো। কিন্তু ধনুকের টঙ্কার শব্দ শোনা মাত্র প্রাণ ভয়ে মৃগগুলো চারিদিকে ছুটাছুটি শুরু করে দিত । ফলে প্রতিদিনই বহুমৃগ শরাহত হয়ে মৃত্যুবরণ করত ।

ন্যাগ্রোধ মৃগরাজ তা দেখে ভাবলেন, নিরর্থক অনেক মৃগ নিহত হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধান কল্পে তিনি স্থির করলেন, পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন একেকটি মৃগ স্বেচ্ছায় প্রাণ দেবে ।

একদিন এক গর্ভবর্তী হরিণীর পালা এসে পড়ল। হরিণী নিরুপায় হয়ে ন্যাগ্রোধ মৃগরাজের কাছে গেল এবং বলল, “প্রভু । আমি গর্ভবর্তী। এবার আমার পালা। এ সময়ে আমি গেলে একসাথে দুটি প্রাণ বিনষ্ট হবে জাতক

আমায় ছেড়ে দিতে অনুমতি করুন।" ন্যাগ্রোধ মৃগরাজ হরিণীকে অভয় প্রদান করে ছেড়ে দিলেন ।

হরিণীর পরিবর্তে তিনি নিজে গিয়ে প্রাণ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন । যথাসময়ে পাচক এসে ন্যাগ্রোধ মৃগরাজকে দেখে বিস্মিত হলো। কারণ রাজা তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন। তিনি ঘটনাটি রাজাকে জানালেন। রাজা শোনামাত্র পাত্রমিত্রসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলেন । তিনি ন্যাগ্রোধ মৃগরাজকে সম্বোধন করে বললেন, “সখা মৃগরাজ। আমিতো তোমায় অভয় দিয়েছিলাম। তবে তুমি কেন আজ নিজের প্রাণ দিতে হাজির হয়েছ?"

ন্যাগ্রোধ মৃগরাজ উত্তর দিলেন, “মহারাজ। আজ একটি গর্ভবর্তী হরিণীর পালা ছিল। সে আমার সাহায্য প্রার্থনা করলে আমি তাকে অভয় প্রদান করেছি। আমি তার প্রাণ রক্ষার্থে আরেক জনের প্রাণ বিনাশ করতে পারি না। তাই তার পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে এসেছি।"

অরণ্যে বিচরণরত স্বপনল

রাজা ন্যাপ্রোধ মৃগরাজের কথায় অত্যন্ত প্রীত হয়ে বললেন, “মৃগরাজ । আজ আপনি যে মৈত্রী, প্রীতি ও দয়ার পরিচয় দিলেন, তা মানুষের মধ্যেও দেখা যায় না। আমি প্রসন্ন মনে আপনাকে ও সেই গর্ভবর্তী হরিণীকে অভয় দিলাম।"

মহারাজ। দুটি মাত্র মৃগ অভয় পেল, অবশিষ্টদের ভাগ্যে কী হবে?

আমি অবশিষ্ট মৃগদেরও অভয় দিলাম।

আপনার উদ্যানের সকল মৃগ নিঃশঙ্ক হলো, কিন্তু অন্যান্য মৃগদের কী হবে?

আমি তাদেরও অভয় দিলাম

মৃগকুল নিস্তার পেল, কিন্তু অবশিষ্ট চতুষ্পদ প্রাণীদের কী হবে?

- আমি তাদেরকেও অভয় প্রদান করলাম।

চতুষ্পদ প্রাণী রক্ষা পেল, কিন্তু পাখিদের কী হবে?

আমি পাখিদেরও অভয় দিলাম।

পাখিরা অভয় পেল বটে, কিন্তু মৎস্যাদি জলচরদের কী হবে?

মৎস্যাদি জলচরদেরও অভয় দিলাম।

এভাবে রাজা ব্রহ্মদত্তের কাছ থেকে ন্যাগ্রোধ মৃগরাজ সকল প্রাণীর জন্য অভয় প্রাপ্ত হলেন। তারপর তিনি রাজাকে পঞ্চশীল শিক্ষা দিয়ে বললেন, “মহারাজ, ধর্মপথে চলুন, মাতাপিতা, পুত্রকন্যা, গৃহী, সন্ন্যাসী, পৌর জনপদ-সকলের সাথে যথাধর্ম নিরপেক্ষভাবে আচরণ করুন। তাহলে যখন দেহত্যাগ করবেন তখন দেবলোক প্রাপ্ত হবেন।” ন্যাগ্রোধ মৃগরাজ রাজাকে ধর্মোপদেশ প্রদান করে আরো কিছুদিন উদ্যানে বসবাস করে অনুচরগণসহ অরণ্যে ফিরে গেলেন। তারপর থেকে রাজা ব্রহ্মদত্ত আর কোনোদিন মৃগ মাংস ভক্ষণ করেননি ।

উপদেশ জীবন সকলের নিকট প্রিয়।

অনুশীলনমূলক কাজ

বোধিসত্ত্ব সকল প্রাণীকে কীভাবে রক্ষা করলেন বর্ণনা করো।

Content added || updated By

Promotion