'যাকাত' শব্দের অর্থ পরিচ্ছন্নতা, পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। মুসলমানদের নিসাব পরিমাণ ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ বছর পূর্তিতে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত খাতসমূহে ব্যয় করাকে যাকাত বলে।
ইসলামের পাঁচটি রুকনের মধ্যে সালাতের পরেই যাকাতের গুরুত্ব বেশি। কুরআন মজিদের বহু স্থানে আল্লাহ তায়ালা সালাতের সাথে যাকাতের কথাই উল্লেখ করে বলেছেন,
অর্থ : “তোমরা সালাত কায়েম করো এবং যাকাত দাও।' (সূরা মুয্যাম্মিল, আয়াত: ২০)
যাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ধনীদের সম্পদে গরিব ও নিঃস্বদের অধিকার। যাকাত দেওয়া দরিদ্রদের প্রতি ধনীদের কোনো অনুগ্রহ বা অনুকম্পা নয়, বরং তার সম্পদকে পবিত্র করার এবং তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার একটি অবশ্য করণীয় ব্যবস্থা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর তাদের (ধনীদের) সম্পদে অবশ্যই দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।' (আল-যারিয়াত, আয়াত : ১৯)
আমরা জেনেছি, যাকাভের একটি অর্থ পবিত্রতা। যাকাত দিলে দাতার অন্তর কৃপণতার কলুবতা থেকে পবিত্র হয়। তার আমলনামা গুনাহ থেকে পবিত্র হয়। ধনীদের সম্পদে গরিবদের অধিকার আছে, একটি নির্দিষ্ট অংশ মিশে আছে। পরিবদের অংশ দিয়ে দিলে অবশিষ্ট সম্পদ মালিকের জন্য পবিত্র হয়ে যায়। যাকাত না দিলে তা ময়লাযুক্ত থাকে। যাকাত দিলে তা ময়লাযুক্ত হয়ে যায়।
যাকাতের আর এক অর্থ বৃদ্ধি। যাকাত দিলে যাকাত দাতার সওয়াব বৃদ্ধি হয়। সামান্য যাকাতের বিনিময়ে পরকালে প্রচুর পুরস্কার লাভ করবেন। শুধু তাই নয়, দুনিয়াতেও আল্লাহ তায়ালা তার সম্পদে রহমত ও বরকত দান করবেন। তার অর্জিত সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আর তোমরা যে সুদের কারবার করে থাক মানুষের সম্পদের সঙ্গে মিলে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার উদ্দেশ্যে, আল্লাহর কাছে তা মোটেই বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে যাকাত দিয়ে থাক, তাই কেবল বৃদ্ধি পায় এরাই সম্পদশালী।' (সুরা রুম, আয়াত : ৩৯)
যাকাত দিলে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হয়, ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। মহানবি (স) বলেছেন,
অর্থ : যাকাত ইসলামের (ধনী-গরিবের মধ্যে) সেতুবন্ধ। (মুসলিম)।
যাকাত দিলে ধনী-গরিবের ব্যবধান কমে যায়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের খানিক ও মালিক। সকল ধনসম্পদের মালিকও তিনি। সম্পদের মালিকানা আল্লাহর এ কথার বাস্তব প্রমাণ ঘটে যাকাতে। সম্পদের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ বিধায় সম্পদ তাঁর বিধান অনুযায়ী গরিবদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। যাকাত না দিলে আল্লাহর মালিকানা অস্বীকার করা হয়। যারা সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখে, যাকাত দেয় না, তাদের পরকালে কঠিন আজাব ভোগ করতে হবে।
নিসাব মানে নির্ধারিত পরিমাণ বা মাত্রা। যে পরিমাণ সম্পদ থাকলে যাকাত ফরজ হয়, তাকে নিসাব বলে। অর্থাৎ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যয় বাদে নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হলে বছর পূর্তিতে একটি নির্দিষ্ট অংশ আল্লাহর নির্ধারিত খাতে যাকাত দিতে হয়। নিম্নোক্ত সম্পদ নিসাব পরিমাণ থাকলে যাকাত দিতে হয়।
১. সোনা, রূপা (নগদ অর্থ ও গহনাপত্রসহ), ২. গবাদি পশু, ৩. জমিতে উৎপন্ন ফসল, ৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের পণ্য, ৫. অর্জিত সম্পদ ইত্যাদি।
সোনা সাড়ে সাত ভরি বা সাড়ে সাত তোলা (৮৭.২৫ গ্রাম) অথবা রূপা সাড়ে বায়ান্ন তোলা (৬১২.২৫ গ্রাম) বা এর তৈরি গহনা থাকলে যাকাত দিতে হয়। এর কোনো একটি অথবা উভয়টির মূল্য পরিমাণ অন্য কোনো সম্পদ থাকলেও যাকাত দিতে হবে।
নিসাব পরিমাণ সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হয়। প্রতি একশত টাকার যাকাত হয় আড়াই টাকা। উৎপাদিত ফসল, দ্রব্যাদি, পশু ইত্যাদির যাকাতের হিসাব কষে জানতে পারব।
‘মাসারিফ' অর্থ ব্যয়ের খাতসমূহ। যাদের যাকাত দেওয়া যায় তাদেরকে বলে যাকাতের মাসারিফ। সবাইকে যাকাত দেওয়া যায় না। কেবলমাত্র আট শ্রেণির লোককে যাকাত দেওয়া যায়। তারা হলো :
১. ফকির বা অভাবগ্রস্ত, ২. মিসকিন বা সম্বলহীন, ৩. যাকাতের জন্য নিয়োজিত কর্মচারীবৃন্দ, ৪. ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে এমন ব্যক্তি ৫. দাসমুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত, ৭. আল্লাহর পথে সংগ্রামকারী ও ৮. অসহায় পথিকদের জন্য। যাকাতের এ খাতগুলো আল্লাহর নির্ধারিত।
যাকাত দিলে মাল পবিত্র হয়। সম্পদ ও সওয়াব বৃদ্ধি পায়। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর হয়। মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধ সৃষ্টি হয়। সমাজ থেকে অভাবজনিত অসামাজিক কার্যকলাপ ও অপরাধ দূর হয়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়। আল্লাহ তায়ালা খুশি হন।
যাকাত না দিলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। বৈরিতা সৃষ্টি হয়। সমাজে অশান্তি সৃষ্টি হয়। আখিরাতে রয়েছে কঠিন আজাব। আমরা হিসাব করে নিয়মিত যাকাত দেওয়ার জন্য পিতা মাতাকে বলব। আল্লাহর পথে অকাতরে ব্যয় করব। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে সচেষ্ট হব ।
পরিকল্পিত কাজ : শিক্ষার্থীরা যাকাতের মাসারিফ অর্থাৎ যাদের যাকাত দেওয়া যায়, খাতায় তাদের একটি তালিকা তৈরি করবে।
আরও দেখুন...