মাটি আমাদের অতি প্রয়োজনীয় একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। মাটিতে পাছপালা জন্মার, ফসল উৎপন্ন হয়। আমাদের দায়িত্ব এই প্রাকৃতিক সম্পদকে নানা ধরনের দূষণ থেকে রক্ষা করা। একই সাথে মাটি আমাদের তেল, গ্যাস, কয়লাসহ নানা রকম খনিজ পদার্থের উৎস। তাই আমরা একদিকে যেরকম এই খনিজ উত্তোলন করে দেশকে সমৃদ্ধ করব, অন্যদিকে লক্ষ রাখব এই প্রক্রিয়ায় আমাদের মূল্যবান সম্পদটির যেন অপচয় না হয়।বিজ্ঞান
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা :
৮.১.১ মাটির গঠন
তোমরা কি বলতে পার মাটি আমাদের কী কী কাজে লাগে?
প্রথমত: মাটিতে গাছপালা জন্মায়, আর সেই গাছপালা থেকেই আমরা খাদ্যশস্য পাই। অক্সিজেন ছাড়া আমরা এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারব না, সেই অত্যাবশ্যকীয় অক্সিজেন গ্যাসও আমরা পাই সেই গাছপালা থেকে। মাটি না থাকলে গাছপালা জন্মাতে পারত না, আমরা খাদ্যশস্য আর অক্সিজেন পেতাম না। দ্বিতীয়ত: মাটিতেই আমরা ঘরবাড়ি, অফিস, রাস্তাঘাট তৈরি করি। শুধু তা-ই নয়, মাটির নিচ থেকে জীবনধারণের জন্য দরকারি পানির বড় একটি অংশ আসে। এছাড়াও আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় জ্বালানির (যেমন: তেল, গ্যাস, কয়লা) সিংহভাগ আমরা আহরণ করি মাটির নিচ থেকে। একইভাবে সোনা, রুপা, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, লোহাসহ নানা রকম খনিজ পদার্থ এই মাটিরই অংশ। এখন আমরা আমাদের অতি প্রয়োজনীয় এই মাটির গঠন সম্পর্কে জেনে নিই।
মাটি হলো নানারকম জৈব আর অজৈব রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ। বিভিন্ন এলাকার মাটির গঠন ভিন্ন হয়। মাটিতে বিদ্যমান পদার্থগুলোকে সাধারণত চার ভাগে ভাগ করা হয়। এরা হলো খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়বীয় পদার্থ আর পানি। তবে এসব পদার্থ বেশিরভাগ সময়েই একটি আরেকটির সাথে মিশে একধরনের জটিল মিশ্রণ তৈরি করে। তাই একটিকে আরেকটি থেকে সহজে পৃথক করা যায় না। মাটিতে বিদ্যমান খনিজ পদার্থগুলো অজৈব যৌগ হয়।মাটিতে বিদ্যমান প্রধান প্রধান খনিজ পদার্থ বা অজৈব পদার্থগুলো হলো ক্যালসিয়াম (Ca), অ্যালুমিনিয়াম (Al), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), লোহা (Fe), সিলিকন (Si), পটাশিয়াম (K) ও সোডিয়াম (Na), অল্প পরিমাণে ম্যাংগানিজ (Mn), কপার (Cu), জিংক (Zn), কোবাল্ট (Co), বোরন (B), আয়োডিন (I) এবং ফ্লোরিন (F)। এছাড়া মাটিতে কার্বোনেট, সালফেট, ক্লোরাইড, নাইট্রেট এবং ক্যালসিয়াম (Ca), ম্যাগনেসিয়াম (Mg), পটাসিয়াম (K), সোডিয়াম (Na) ইত্যাদি ধাতুর জৈব লবণও পাওয়া যায়।মাটিতে বিদ্যমান জৈব পদার্থ হিউমাস (Humus) নামে পরিচিত। হিউমাস আসলে অ্যামিনো এসিড, প্রোটিন, চিনি, অ্যালকোহল, চর্বি, তেল, লিগনিন, ট্যানিন এবং অন্যান্য অ্যারোমেটিক যৌগ নিয়ে গঠিত একটি বিশেষ জটিল পদার্থ। এটি দেখতে অনেকটা কালচে রঙের হয়। এই হিউমাস তৈরি হয় মৃত গাছপালা আর প্রাণীর দেহাবশেষ থেকে।
মাটিতে বিদ্যমান পানির ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে গাছপালার জন্য। তোমাদের কি মনে প্রশ্ন জেগেছে যে মাটিতে পানি কোথায় আর কীভাবে থাকে? মাটিতে পানি থাকে মাটির কণার মাঝে থাকা ফাঁকা জায়গাগুলোতে বা রন্ধ্রে। এই রঞ্জের আকার-আকৃতির উপর নির্ভর করে মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা। তোমরা বল দেখি বালি আর কাদামাটির মধ্যে কোনটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বেশি? নিঃসন্দেহে কাদা মাটির। এর কারণ হলো, কাদামাটির বেলায় মাটির কণাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে থাকা র খুব সূক্ষ্ম, যা পানি ধরে রাখে। অন্যদিকে বালি মাটির বেলায় রক্সগুলো বড় বস্তু, যে কারণে পানি আটকে থাকে না বা ধরে রাখতে পারে না।ফাঁকা স্থান বা রন্জ ছাড়াও মাটির কণায় শোষিত অবস্থায়ও পানি থাকতে পারে। মাটিতে থাকা হিউমাস পানি শোষণ করে রাখতে পারে। হিউমাসে শোষিত পানি সহজে গাছপালায় স্থানান্তরিত হয় না ।
মাটিতে পানি না থাকলে কী সমস্যা হতো? মাটিতে পানি না থাকলে কী সমস্যা হতো তার বড় প্রমাণ হলো মরুভূমি যেখানে দু-একটি বিশেষ প্রজাতির গাছ ছাড়া আর কিছুই জন্মায় না। অর্থাৎ মাটিতে পানি না থাকলে গাছপালা জন্মাতে পারত না এবং জন্মালেও বেড়ে উঠতে পারত না। তোমরা জান বে উদ্ভিদকোষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রোটোপ্লাজম, আর এই প্রোটোপ্লাজমের শতকরা ৮৫-৯৫ ভাগই হলো পানি, যা আসে মাটি থেকে। গাছ পাতায় থাকা স্টোমাটা (Stomata) দিয়ে কিছু পানি গ্রহণ করলেও বেশির ভাগই গাছের মূলের মাধ্যমে মাটি থেকে আসে। মাটি থেকে পাওয়া পানির সাহায্যেই গাছপালা সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেদের খাবার তৈরি করে আর আমাদেরকে অক্সিজেন দেয়। গাছপালা তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি (যেমন: খনিজ পদার্থ, নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি) মাটি থেকে সরাসরি গ্রহণ করতে পারে না। এগুলো গ্রহণ করে মূলের সাহায্যে এবং এক্ষেত্রে পানি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। কাজেই পানি না থাকলে উদ্ভিদ মাটি থেকে এসব পুষ্টিও গ্রহণ করতে পারত না, ফলে এদের বেড়ে ওঠাও সম্ভব হতো না। এবারে আসা যাক মাটিতে থাকা বায়বীয় পদার্থের প্রসঙ্গে। মাটির কণার মধ্যকার ফাঁকা স্থান বা রে যেমন পানি থাকতে পারে, তেমনি বারবীয় পদার্থ বা বাতাসও থাকতে পারে। মাটিতে নাইট্রোজেন, অক্সিজেন আর কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস থাকে।মজার ব্যাপার হলো, মাটিতে থাকা প্যানের সাথে কিন্তু সবসময় বায়ুমণ্ডলে থাকা গ্যাসের বিনিময় হতে থাকে। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলের প্যাস মাটিতে যার এবং মাটিতে থাকা গ্যাস বায়ুমণ্ডলে চলে আসে। এই প্রক্রিয়াকে মাটির বায়বায়ন (Soil Aeration) বলে। এখন প্রশ্ন হলো, মাটিতে থাকা প্যাস কি কোনো কাজে লাগে? হ্যাঁ, অবশ্যই এটি কাজে লাগে। মাটিতে নানারকম উপকারী অণুজীব (Microorganismn) থাকে। এর মধ্যে কিছু অণুজীবের জন্ম আর বেড়ে ওঠার জন্য অক্সিজেন অত্যাবশ্যক, অক্সিজেন না থাকলে এরা বাঁচতে পারে না। আবার অক্সিজেন পানিতে অদ্রবণীয় অনেক খনিজ পদার্থকে ভেঙে দ্রবণীয় পদার্থে পরিণত করে, যা পরে মাটিতে থাকা পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং পরে উদ্ভিদে স্থানান্তরিত হয়।
আমরা যদি কোনো একটি স্থানের মাটির গভীরে যেতে থাকি, তাহলে কী পাব? সব জায়গায় কি মাটির গঠন একই হবে, নাকি ভিন্ন হবে? নিচের দিকে মাটির গঠন পরীক্ষা করে দেখা যায় যে মাটি এটি সমান্তরাল স্তরে বিভক্ত। প্রতিটি স্তরকে দিগবলয় বা হরাইজোন (Horizon) বলে। সবার উপরে যে স্তরটি থাকে, তাকে বলে হরাইজোন A (Horizon A) বা টপ সয়েল (Top Soll)। এই স্তরেই উদ্ভিদ আর প্রাণীর মরা দেহে পচন শুরু হয় এবং উৎপাদিত পদার্থ, বিশেষ করে হিউমাসসহ অন্যান্য জৈব পদার্থ এই স্তরেই থাকে। এই স্তরে সাধারণত খনিজ পদার্থ থাকে না, সেগুলো পানির সাথে প্রবাহিত হয়ে নিচের স্তরে চলে যায়। প্রথম জ্বরের মাটি সাধারণত বালুময় হয়। মাটির দ্বিতীয় স্তরটিকে সাবসয়েল (Sub Soil) বা হরাইজোন B (Horizon B ) বলে। এ স্তরে সামান্য পরিমাণ হিউমাস থাকে। তবে এই স্তর ওপরের স্তর থেকে আসা খনিজ পদার্থে ভরা থাকে। মাটির তৃতীয় স্তরটিকে হরাইজোন C (Horizon C) বলে। মাটি তৈরি হয় শিলা থেকে, যেখানে জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়া জড়িত। মুল শিল্পা আস্তে আস্তে নরম হয়ে এক পর্যায়ে মাটির কণায় পরিণত হয়। মূল শিলা থেকে পরিবর্তিত হয়ে প্রথমে যে নরম শিলা তৈরি হয়, সেগুলো হরাইজোন C- তে থাকে। এই নরম শিলা মূল শিলা থেকে নরম কিন্তু মাটির কণা থেকে অনেক গুণ শত। এই নরম শিলাই পরবর্তীতে পরিবর্তিত হয়ে মাটির কণায় পরিণত হয়। এই স্তরের নিচে থাকে Horizon D বা মূল শিলা যা খুবই শক্ত।
তোমরা বলতো, সব জায়গার মাটি কি এক রকম? না, একেক জায়গার মাটি একেক রকম। মাটির গঠন, বর্ণ, পানি ধারণক্ষমতা— এসব বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে মাটিকে মূলত চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো বালু মাটি, পলি মাটি, কাদামাটি এবং দো-আঁশ মাটি। এবার আমরা বিভিন্ন প্রকার মাটির বৈশিষ্ট্যগুলো জেনে নিই।
বালু মাটি
বালু মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে এদের পানি ধারণক্ষমতা খুবই কম। এটি তোমরা নিজেরাই পরীক্ষা করে দেখতে পারবে।
একক কাজ
কাজ: অল্প পরিমাণ বালু মাটি নিয়ে তাতে একটু পানি দাও। এবার হাতের তালুতে নিয়ে এই বালু মাটি দিয়ে গোল গোল ছোট মাটির বলের মতো বানাতে পার কি না দেখ। পারবে না, কারণ বাজুতে মাটির পানি ধরে রাখার ক্ষমতা নেই বলে পানি যোগ করলেও বালু মাটি তা শোষণ করতে পারে না। যদি পারত তাহলে পানি মাটির কণার গায়ে লেগে থাকত আর তোমরা খুব সহজেই বলের মতো মাটির গুটি বানাতে পারতে।বালু মাটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো যে এতে বিদ্যমান মাটির কণার আকার সবচেয়ে বড়, যার ফলে কণাগুলোর মাঝে ফাঁকা জায়গা অনেক বেশি থাকে, তাই অনেক বেশি বায়বায়ন হয়। বালু মাটি তোমরা হাতে নিলে দেখবে যে এরা দানাযুক্ত। বালু মাটিতে খুব ছোট ছোট শিলা আর খনিজ পদার্থও থাকে। বালু মাটিতে হিউমাস থাকলে এটি চাষাবাদের জন্য সহজসাধ্য, কিন্তু যেহেতু এই মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম, তাই পানি দিলে তা দ্রুত নিষ্কাষিত হয়ে যায় এবং গ্রীষ্মকালে, বিশেষ করে উদ্ভিদে পানির স্বল্পতাদেখা যায়। তাই যে সকল ফসলাদিতে অনেক বেশি পানি লাগে, সেগুলো বালু মাটিতে ভালো হয় না। তবে যখন প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়, যার কারণে জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, সে সকল ক্ষেত্রে বালু মাটি চাষাবাদের জন্য উপযোগী হয়ে উঠতে পারে। কারণ, বালু মাটিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় না, যার ফলে গাছের শিকড় পঁচে না। জলাবদ্ধতার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে এতে গাছের শিকড়ে পঁচন ধরে, যার ফলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়।
পলি মাটি
পলি মাটির পানি ধারণক্ষমতা বালু মাটির চেয়ে বেশি। পলি মাটি চেনার উপায় কী? সামান্য পানিযুক্ত মাটি নিয়ে আঙুল দিয়ে ঘষলে যদি মসৃণ অনুভূত হয়, তাহলে বুঝতে হবে এটি পলি মাটি। পলি মাটিতে উপস্থিত পানির জন্য এটি হাতের সাথে লেগে থাকবে, যা বালু মাটির বেলায় ঘটে না। পলি মাটি খুবই উর্বর হয় আর মাটির কণাগুলো বালু মাটির কণার তুলনায় আকারেও ছোট হয়। জমিতে পলি পড়ার কথা তোমরা সবাই জান। পলি মাটির কণাগুলো ছোট হওয়ায় এরা পানিতে ভাসমান আকারে থাকে এবং একপর্যায়ে পানির নিচে থাকা জমিতে পলির আকারে জমা পড়ে। পলি মাটিতে জৈব পদার্থ ও খনিজ পদার্থ (যেমন: কোয়ার্টজ) থাকে। বালু মাটির মতো পলি মাটির কণাগুলোও দানাদার হয় এবং এতে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর উপাদান বেশি থাকে
কাদা মাটি
তোমরা কাদা মাটি দেখেছ? এই মাটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এরা প্রচুর পানি ধারণ করতে পারে। এরা অনেকটা আঠালো ধরনের হয় এবং হাত দিয়ে ধরলে হাতে লেগে থাকে। এই মাটিতে মাটির কণাগুলো খুব সূক্ষ্ম হয়, ফলে কণাগুলোর মধ্যকার রন্ধ্র খুব ছোট আর সরু হয়। কাদা মাটি থেকে সহজে পানি নিষ্কাশিত হয় না। এই জাতীয় মাটিতে সামান্য বৃষ্টিপাত হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, তাই ফসলাদি বা উদ্ভিদের মূলে পচন সৃষ্টি করে। কাদা মাটিতে ফসল চাষের জন্য জৈব সার দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে থাকে। এই মাটিতে খনিজ পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এই মাটি দিয়ে ঘর সাজানোর তৈজসপত্র, এমনকি গহনাও তৈরি করা হয়।
দো-আঁশ মাটি
এই মাটি বালু, পলি আর কাদা মাটির সমন্বয়েই তৈরি হয়। দো-আঁশ মাটিতে থাকা বালু, পলি আর কাদা মাটির অনুপাতের উপর নির্ভর করে দো-আঁশ মাটির ধরন কেমন হবে। দো-আঁশ মাটির একদিকে যেমন পানি ধারণক্ষমতা ভালো আবার প্রয়োজনের সময় পানি দ্রুত নিষ্কাশনও হতে পারে। তাই ফসল চাষাবাদের জন্য দো-আঁশ মাটি খুবই উপযোগী।
উপরে উল্লেখিত চার প্রকার ছাড়াও আরো দুই প্রকারের মাটি পাওয়া যায়। একটি হলো পিটি মাটি (Peaty Soil), অন্যটি খড়িমাটি (Chalky Soil)। পিটি মাটি তৈরি হয় মূলত জৈব পদার্থ থেকে; আর সে কারণে এতে অন্য সব মাটি থেকে জৈব পদার্থের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। সাধারণত ডোবা আর আর্দ্র এলাকায় এই মাটি পাওয়া যায়। এই মাটিতে পুষ্টিকর উপাদান কম থাকে, তাই ফসল উৎপাদনের জন্য এটি তেমন উপযোগী নয়। অন্যদিকে খড়িমাটি ক্ষারীয় হয় এবং এতে অনেক পাথর থাকে। এই মাটি সাধারণত দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং সে কারণে ফসল উৎপাদনের জন্য খুব একটা উপযোগী নয় বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। এছাড়া খড়িমাটিতে গাছপালার জন্য অত্যাবশ্যকীয় আয়রন আর ম্যাগনেসিয়াম সরবরাহে ঘাটতি থাকে।
ফসল উৎপাদনের জন্য মাটির অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একটি মানদণ্ড হলো এর pH। মাটির pH মান জানা থাকলে এটি এসিডিক, ক্ষারীয় না নিরপেক্ষ সেটি বোঝা যায়। বেশির ভাগ ফসলের বেলাতেই মাটির pH নিরপেক্ষ হলে অর্থাৎ এর মান ৭ বা তার খুব কাছাকাছি হলে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যায় । তাই কোনো একটি জমির মাটি পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় এর pH ৭-এর চেয়ে বেশ কম বা অনেক বেশি তাহলে এর pH ৭ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। তবে কিছু কিছু ফসল আছে, যেমন: আলু এবং গম— এরা মাটির pH ৫-৬ হলে সর্বোচ্চ উৎপাদন দেয়। অন্যদিকে কিছু ফসল যেমন: যব, মাটির pH ৮ হলে ভালো উৎপাদন হয়। তাহলে বুঝতেই পারছ ভালো ফলনের জন্য মাটির pH অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মাটির pH অনুযায়ী ফসল নির্বাচন করা বেশ জরুরি।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তোমরা পানিদূষণ সম্পর্কে জেনেছ। মাটিদূষণ আর পানিদূষণ একটির সাথে আরেকটি সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ পানিদূষণের জন্য যেসব কারণ দায়ী, সেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাটি দূষণেরও কারণ। এখন তাহলে আমরা মাটিদূষণের নির্দিষ্ট কিছু কারণ জেনে নিই।
শিল্প-কারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য
তোমরা কি জান, আমাদের দেশে শিল্প-কারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য কী করা হয়? বেশির ভাগ সময় শিল্প-কারখানা ও শহরাঞ্চলের গৃহস্থালির বর্জ্য মাটির নিচে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয় বা কখনো কখনো একটি খোলা জায়গা বা ডাস্টবিনে জড়ো করে রাখা হয়। গ্রামাঞ্চলে প্রায় সব সময়েই বাড়ির আশপাশেই জঞ্জাল ফেলা হয়। এসব বর্জ্যের পচনশীল দ্রব্যগুলো জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পচতে থাকে এবং জৈব সারে পরিণত হয়। তোমরা কি ধারণা করতে পার এই জাতীয় দূষণের ফলাফল কেমন হতে পারে? যেহেতু শিল্প-কারখানার বর্জ্যে মারকারি, জিংক, আর্সেনিক ইত্যাদি থেকে শুরু করে এসিড, ক্ষার, লবণ, কীটনাশক—এ ধরনের হাজারো রকমের মারাত্মক ক্ষতিকর পদার্থ থাকে, তাই এই জাতীয় দূষণের প্রভাবও হয় বহুমাত্রিক। যেমন: মারকারি আর অন্যান্য ধাতব পদার্থ মাটিতে বিদ্যমান উপকারী অণুজীবগুলোকে মেরে ফেলে, যার ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। আবার মাত্রাতিরিক্ত লবণ, এসিড বা ক্ষার গাছপালা আর ফসলের ক্ষতি করে। এই জাতীয় বর্জ্যে থাকা প্রোটিন বা অ্যামিনো এসিড ব্যাকটেরিয়ার দ্বারা ভেঙে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস, সালফার ডাই-অক্সাইড গ্যাস কিংবা ফসফরাসের অক্সাইড তৈরি করে, যার কারণে মাটি দূষিত হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় চিন্তার কারণ হচ্ছে, এ ধরনের দূষণের ফলে ক্ষতিকর পদার্থ মাটি থেকে খাদ্যে এবং খাদ্য থেকে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীদেহে প্রবেশ করে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এই জাতীয় দূষণের ফলে মাটির জৈব রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন ঘটতে পারে, যেটি ফসল উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তেজস্কির পদার্থের নিঃসরণ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কারখানা থেকে দুর্ঘটনা বা পরীক্ষা- নিরীক্ষার ফলে বের হয়ে আসা তেজস্ক্রিয় পদার্থ দিয়ে মাটির মারাত্মক দূষণ হতে পারে। রেডন (Rm), রেডিয়াম (Ra), ঘোরিয়াম (Th), সিজিয়াম (cs), ইউরেনিয়াম (U) ইত্যাদি তেজস্ক্রিয় পদার্থ শুধু যে মাটির উর্বরতাই নষ্ট করে তা নয়, এরা প্রাণীদেহের ত্বক ও ফুসফুসের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে। উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার ফলে গাছপালাও মরে যায়। এছাড়া অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের মতো এরাও খাদ্যশৃংখলের মাধ্যমে প্রাণীদেহে প্রবেশ করে ভয়াবহ রোগ সৃষ্টি করে।
তোমরা কি চেরোনোবিল দুর্ঘটনার কথা জান?
দলগত কাজ
কাজ: চেরোনোবিল দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে এর ভয়াবহতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
অতিরিন্ন গলি থেকে মাটিদূষণ নদীভাঙনের কথা তোমরা সবাই জান। নদী ভাঙনের ফলে নদীর পাড় ভাঙা মাটি বা অন্য কোনোভাবে সৃষ্ট মাটি কিংবা পানিতে অদ্রবণীয় পদার্থ পানির সাথে প্রবাহিত হরে একপর্যায়ে কোথাও না কোথাও তলানি আকারে জমা পড়ে। এগুলো কখনো নদ-নদী, খাল-বিল ইত্যাদির তলদেশে জমা হতে পারে আবার কখনো ফসলি জমির উপর জমা হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সমস্ত তলানিতে নানারকম ক্ষতিকর পদার্থ থাকতে পারে। এই জাতীয় ভলানি ফসলি জমির ওপর পড়লে সেটি জমির উপরিভাগ, যা ফসল উৎপাদনে মূল ভূমিকা পালন করে, তার ওপর একটা আস্তরণ তৈরি করে। ফলে এই জমির ফসল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়। এসব পদার্থ নদীগর্ভে জমা হলে কী হয় তা তোমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে ইতিমধ্যে জেনে গেছ।
খনিজ পদার্থ আহরণের দ্বারা মাটির দূষণ
খনি থেকে মূল্যবান খনিজ পদার্থ বা তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের সময় প্রচুর মাটি খনন করে সরিয়ে ফেলতে হয়। এতে যেমন বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসলহানি ঘটে, ঠিক তেমনি মাটিদূষণের ফলে মাটির উর্বরতাও নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি অনেক সময় এর ফলে সৃষ্ট মাটি ক্ষয়ের কারণে তা আশপাশের জলাভূমি ভরাট করে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
অনেক খনিই বন এলাকায় থাকে, যে কারণে খনি খননের কারণে বনজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। যার ফলে ঐ সকল স্থানে মাটিদূষণ ঘটে। এছাড়া খনিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা (যা সচরাচর ঘটেই চলেছে) ঘটলে তা আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকার মাটির উৎপাদনশীলতা নষ্ট করে দিতে পারে।
এছাড়া অতিরিক্ত সার, কীটনাশক, আগাছা ধ্বংসকারী দ্রব্যাদি, গাছপালার অবশিষ্টাংশ, প্রাণিজ বর্জ্য, মাটির ক্ষয় এমনকি কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলেও মাটিদূষণ হয় এবং মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়।মানুষের মলমূত্র, পাখির বিষ্ঠা বা অন্যান্য প্রাণীর মলমূত্র থেকে কি মাটিদূষণ হতে পারে? হ্যাঁ, অবশ্যই পারে। কারণ, এসব মলমূত্রে রোগ সৃষ্টিকারী নানারকম জীবাণু থাকে, যারা মাটিতে বেড়ে উঠে এবং পরবর্তী সময়ে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।
মাটি আমাদের একটি অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। আমাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসাসহ অন্যান্য যে সকল চাহিদা রয়েছে, তার সবগুলোই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে মাটির উপর নির্ভরশীল। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় এই সম্পদটি নানাভাবে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এবং এর উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। ঝোড়ো বাতাস মাটি উড়িয়ে নেয়, ভারী বৃষ্টিপাত, নদীর পানির স্রোত বা নদীর ভাঙন ইত্যাদি নানা কারণে মাটি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। মাটি ক্ষয় হলে এর উর্বরতা ধ্বংসের পাশাপাশি মাটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আমরা গাছপালা ও বনজঙল কেটে, পাহাড় কেটে শিল্প-কারখানা স্থাপন করে (যেমন: ইটভাটা) প্রতিনিয়ত মাটির ক্ষয়সাধন করে চলেছি। তোমরা সবাই জান যে সাম্প্রতিক কালে পাহাড়ধসে চট্টগ্রাম এলাকায় অনেক প্রাণহানি ঘটছে, যার মূল কারণ পাহাড় কেটে মাটির ক্ষয়সাধন। এই ক্ষয় বন্ধ না হলে এটি আমাদের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হতে পারে।
ক্ষয়রোধ করে মাটি সংরক্ষণ
মাটি সংরক্ষণের সবচেয়ে কার্যকর এবং সহজ কৌশল হলো মাটিতে বেশি করে গাছ লাগানো। মাটিতে তৃণগুল্ম ও দূর্বা কিংবা অন্য যেকোনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ এবং অন্যান্য গাছপালা থাকলে ভারী বৃষ্টিপাত ও মাটির ক্ষয়সাধন করতে পারে না। গাছের শিকড় মাটির ভিতরে থাকায় সেটি মাটিকে দৃঢ়ভাবে আটকে রাখে এবং সরে যেতে দেয় না। জমিতে ফসল তোলার পর গোড়া উপড়ে না তুলে জমিতে রেখে দিলে একদিকে যেমন জমির উর্বরতা বাড়ে, অন্যদিকে তেমনি জমির ক্ষয়ও কমে যায়।বৃষ্টি হলে সাধারণত ঢালু জায়গায় মাটির ক্ষয় বেশি হয়। কাজেই ঢালু জায়গা দিয়ে যেন পানি প্রবাহিত না হতে পারে, তার ব্যবস্থা করা, তবে এই কাজ সবসময় খুব সহজ নয়। এরকম ক্ষেত্রে ঢালু জায়গায় ঘাস, ধনচে বা কলমিজাতীয় গাছ লাগিয়ে মাটির ক্ষয়রোধ করা যায়। গ্রাম এলাকায় অনেকেই ঘাস কেটে বা তুলে গবাদিপশুকে খাওয়ায়। এক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে যে ঘাস মাটি থেকে তুলে ফেললে সেটি মাটির ক্ষয়সাধন করে। তাই ঘাস কাটার সময় একেবারে মাটি ঘেঁষে কাটা উচিত নয়। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় গরু, ছাগল, ভেড়া—এগুলো মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয় ঘাস খাওয়ার জন্য। এরা যেন মাটির উপরে থাকা ঘাসের আচ্ছাদন সমূলে খেয়ে না ফেলে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বনের গাছ কাটার ফলে অনেক সময় বিস্তীর্ণ এলাকা গাছশূন্য এবং অনাচ্ছাদিত হয়ে পড়ে। কাজেই নতুন গাছ লাগানোর ব্যবস্থা না করে বনের গাছ কখনোই কাটা ঠিক নয়। অন্যথায় কোনোভাবে মাটির ক্ষয়সাধন রোধ করা যাবে না।রাসায়নিক সারের পরিবর্তে যতটুকু সম্ভব জৈব সার ব্যবহার করা উচিত, কারণ জৈব সারে থাকা উপাদান ও হিউমাস পানি শোষণ করতে পারে। ফলে অল্প বৃষ্টিপাতে মাটির ক্ষয় হয় না। এছাড়া রাসায়নিক সার মাটিতে বসবাসকারী অনেক উপকারী পোকামাকড় অণুজীব ধ্বংস করে দেয়, যার ফলে মাটির উর্বরতাও নষ্ট হয়ে যায়। একই জমিতে বারবার একই ফসল চাষ করলেও উর্বরতা নষ্ট হয়। তাই একই জমিতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা উচিত।
নদীভাঙনের মাধ্যমে মাটির ক্ষয় বন্ধ করা
নদীর পাড়ে কলমি, ধনচে ইত্যাদি গাছ লাগানো যায়। নদী অত্যধিক খরস্রোতা হলে নদীর পাড়ে বালুর বস্তা ফেলে বা কংক্রিটের তৈরি ব্লক দিয়ে ভাঙন ঠেকানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না ।
আমরা যে নানারকম খনিজ লবণ, পেন্সিলের সিস, ট্যালকম পাউডার, চীনা মাটির থালা-বাসন এরকম হাজারো জিনিস ব্যবহার করি, তার অধিকাংশই মাটি কিংবা শিলা থেকে পাওয়া খনিজ পদার্থ। বেশির ভাগ খনিজ পদার্থই কঠিন অবস্থায় পাওয়া যায়। এদের নির্দিষ্ট রাসায়নিক সংযুক্তি থাকে। এখন পর্যন্ত প্রকৃতিতে প্রায় ২৫০০ রকমের খনিজ পদার্থ পাওয়া গেছে। খনিজ পদার্থ ধাতব কিংবা অধাতব দুটোই হতে পারে। ধাতব খনিজ পদার্থের মাঝে অন্যতম হলো লোহা (Fe), তামা (Cu), সোনা (Au) কিংবা রুপা (Ag)। অধাতব খনিজ পদার্থের মধ্যে রয়েছে কোয়ার্টজ (Quartz), মাইকা (Mica) কিংবা খনিজ লবণ।কয়লা, , গ্যাস, পেট্রোল এসব কী খনিজ পদার্থ? হ্যাঁ, অবশ্যই এগুলোও খনিজ পদার্থ। তবে এদেরকে জৈব খনিজ পদার্থ বলে। এদের সম্পর্কে তোমরা পরবর্তী পাঠে বিস্তারিত জানতে পারবে।
টেবিল ৮.১: কয়েকটি সাধারণ খনিজ পদার্থের ব্যবহার
খনিজ পদার্থের ভৌত ধর্ম
খনিজ পদার্থগুলো সাধারণত দানাদার বা কেলাসাকার হয়। অনেক খনিজ পদার্থ আছে, যাদের রাসায়নিক সংযুক্তি একই কিন্তু তাদের কেলাস গঠন ভিন্ন যে কারণে তাদের ভৌত ধর্মও ভিন্ন। যেমন- গ্রাফাইট ও ডায়মন্ড। যদিও দুটি পদার্থই কার্বন দিয়ে গঠিত, কিন্তু গঠনের ভিন্নতার কারণে গ্রাফাইট (যা আমরা পেন্সিলে ব্যবহার করি) নরম হয় কিন্তু ডায়মন্ড বা হীরা এখন পর্যন্ত জানা খনিজের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন খনিজ পদার্থ । খনিজ পদার্থগুলো সাধারণত কঠিন হয় এবং একেকটি খনিজের কাঠিন্য একেক রকম। বেশি কঠিন খনিজ খুব সহজেই কম কঠিন খনিজে দাগ কাটতে পারে; কিন্তু কম কঠিন খনিজ বেশি কঠিন খনিজে দাগ কাটতে পারে না। কাঠিন্য অনুযায়ী সবচেয়ে নরম খনিজ হলো ট্যালক (Talc), যা দিয়ে ট্যালকাম পাউডার তৈরি হয় এবং আগেই বলা হয়েছে, সবচেয়ে কঠিন খনিজ হলো হীরা বা ডায়মন্ড। খনিজ পদার্থের নির্দিষ্ট দ্যুতি থাকে। ধাতব খনিজ যেমন: পাইরাইটস ধাতুর মতোই দ্যুতি প্রদর্শন করে অর্থাৎ অনেকটা ধাতুর মতোই চকচক করে। খনিজ হীরা অধাতু এবং এটিকে দেখে সাধারণ কাচের মতো মনে হতে পারে কিন্তু এটি কাটার পর এর দ্যুতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।কিছু কিছু খনিজ পদার্থ আছে, যেগুলো খুব স্বচ্ছ এবং এর মধ্যে আলো প্রবেশ করতে পারে। যেমন: কোয়ার্টজ বা সিলিকা, আবার কিছু কিছু খনিজ পদার্থ আছে, যার মধ্য দিয়ে আলো প্রবেশ করলেও এর মধ্য দিয়ে কোনো বস্তু দেখা যায় না, যেমন: অ্যারাগনাইট। অন্যদিকে এমন খনিজও আছে, যার মধ্য দিয়ে মোটেই আলো প্রবেশ করতে পারে না, যেমন: ক্যালসাইট (Calcite) বা চুনাপাথর। সাধারণত প্রতিটি খনিজ পদার্থেরই একটা নির্দিষ্ট বর্ণ আছে, যা দিয়ে একটি থেকে আরেকটিকে আলাদা করা যায় ।
বেশির ভাগ খনিজ পদার্থে ফাটল থাকে, যা দেখে অনুমান করা যায় এটি ভাঙলে কী ধরনের আকার- আকৃতিবিশিষ্ট ছোট ছোট টুকরা পাওয়া যাবে। বেশির ভাগ খনিজ পদার্থের আপেক্ষিক গুরুত্ব ২.৫-৩.৫- এর মধ্যে হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে।
রাসায়নিক ধর্ম: খনিজ পদার্থের রাসায়নিক ধর্ম নির্ভর করে এতে বিদ্যমান উপাদানের উপর।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক জ্বালানির মধ্যে অন্যতম হলো প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং পেট্রোলিয়াম। এছাড়া রান্নার কাজে ব্যবহৃত কাঠের খড়ি, গাছের পাতা, পাটকাঠি, ধানের গুঁড়া এবং খড় বা গোবর দিয়ে তৈরি লাকড়ি, এগুলোকেও প্রাকৃতিক জ্বালানি হিসেবে গণ্য করা যায়। এখন আমাদের দেশে বহুল ব্যবহৃত গ্যাস, কয়লা ও পেট্রোলিয়াম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক ।
তোমরা কি জান আমরা বাসায় গ্যাসের চুলায় বা সিএনজি (CNG) পাম্প স্টেশন থেকে গাড়িতে যে গ্যাস নিই, তাতে আসলে কী গ্যাস থাকে? এতে থাকে প্রাকৃতিক গ্যাস, যা মূলত মিথেন (CH4) গ্যাস, তবে সামান্য পরিমাণে অন্যান্য পদার্থ যেমন: ইথেন, প্রোপেন এবং বিউটেনও থাকে। এছাড়া এতে অতি সামান্য পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, হাইড্রোজেন, আর্গন এবং হিলিয়াম থাকে।এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি হয়? প্রাকৃতিক গ্যাস কীভাবে তৈরি হয় তা নিয়ে কিছুটা ভিন্ন মত আছে। সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী, প্রাকৃতিক গ্যাস তৈরি হয় মৃত গাছপালা ও প্রাণীদেহ থেকে। লক্ষ লক্ষ বছর আগে মরে যাওয়া গাছপালা ও প্রাণীর পচা দেহাবশেষ কাদা ও পানির সাথে ভূগর্ভে জমা হয়। সময়ের সাথে সাথে এগুলো বিভিন্ন রকম শিলা স্তরে ঢাকা পড়ে। শিলা স্তরের চাপে পচা দেহাবশেষ ঘনীভূত হয় এবং প্রচণ্ড চাপে ও তাপে দেহাবশেষে বিদ্যমান জৈব পদার্থ প্রাকৃতিক গ্যাসে ও পেট্রোলিয়ামে পরিণত হয়। প্রকৃতিতে এভাবে উৎপন্ন গ্যাসের খনিকে আমরা গ্যাসকূপ বলি।
প্রাকৃতিক গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ
প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রক্রিয়াকরণ একটি জটিল শিল্পপ্রক্রিয়া, যেটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় (চিত্র ৮.০৩)। সাধারণত যেখানে গ্যাসকূপ পাওয়া যায়, সেখানেই এর প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। প্রক্রিয়াকরণ অনেকাংশে নির্ভর করে গ্যাসের গঠন অর্থাৎ এতে বিদ্যমান অন্যান্য পদার্থের উপর। সাধারণত গ্যাসকূপে গ্যাস ও তেল একসাথে থাকে। তাই প্রথমেই ভেলকে গ্যাস থেকে আলাদা করা হয়। এরপর প্রাকৃতিক প্যাসে থাকা বেনজিন ও বিউটেন ঘনীভূত করে আলাদা করা হয়। প্রাকৃতিক গ্যাসে থাকা পানি দূর করার জন্য নিরুদকের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়। অতঃপর গ্যাসে থাকা দূষকগুলো (H2S, CO2) পৃথক করা হয়। এরপর প্রান্ত প্যাসের মিশ্রণ থেকে নাইট্রোজেন আলাদা করা হয়। এই অবস্থায় প্রাপ্ত প্রাকৃতিক প্যাস বিশুদ্ধ মিথেন গ্যাস, যেটি পাইপলাইনের মাধ্যমে সঞ্চালন করা হয়।
ব্যবহার
প্রাকৃতিক গ্যাস আমরা নানা কাজে ব্যবহার করি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইউরিয়া সার উৎপাদন। শতকরা প্রায় ২১ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস ইউরিয়া সারের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ বিদ্যুৎও উপন্ন করা হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাসই বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। প্রায় শতকরা ২২ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হয় শিল্প-কারখানায়, ১১ ভাগ বাসা-বাড়িতে এবং ১১ ভাগ জ্বালানি হিসেবে। এছাড়া প্রায় শতকরা ১ ভাগ প্রাকৃতিক গ্যাস বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়। বাকি শতকরা ৫ ভাগ অপচয় (System Loss) হয়। আমাদের দেশে ২০০৩ সাল থেকে যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা শুরু হয়েছে।
সীমাবদ্ধতা ও সংরক্ষণ
তোমাদের কি মনে হয় আমাদের যে প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত আছে তা অফুরন্ত? না, মোটেও তা নয় । মজুত প্রাকৃতিক গ্যাসের পরিমাণ নির্দিষ্ট এবং সীমিত। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে একসময় তা শেষ হয়ে যাবে। তাই এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে আমাদের অত্যন্ত সচেতন হতে হবে, কোনোভাবেই এটিকে অপচয় করা যাবে না। অনেকে বাসায় বিনা প্রয়োজনে গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে এবং এতে অতি মূল্যবান এই সম্পদের অপচয় করে, যা কোনোমতেই সমীচীন নয়। এসব বিষয় নিয়ে সবাইকে যার যার নিজের বাসায় এবং এলাকার সবাইকে সচেতন করতে হবে।
পেট্রোলিয়াম হলো খনিজ তেল, অর্থাৎ খনিতে পাওয়া তরল জ্বালানি পদার্থ। সাধারণত প্রাকৃতিক গ্যাসের সাথে খনিতে পেট্রোলিয়ামও থাকে। প্রোপেন ও বিউটেন স্বাভাবিক চাপ ও তাপমাত্রায় (২৫° সেলসিয়াস) গ্যাসীয় হলেও উচ্চ চাপে তরল অবস্থায় থাকে বলে এরাও পেট্রোলিয়ামের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া গ্যাসোলিন, কেরোসিন, ডিজেল— এগুলো সবই পেট্রোলিয়াম ।
পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াকরণ
খনি থেকে প্রাপ্ত তেল মূলত নানারকম হাইড্রোকার্বন এবং অন্যান্য পদার্থের (যেমন- সনালফার) মিশ্রণ, তাই বেশিরভাগ সময়েই তা সরাসরি ব্যবহারের উপযোগী হয় না। সেজন্য অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে নিতে হয়। প্রায় ৪০০° সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আংশিক পাতন করে/ আংশিক পাতনের মাধ্যমে অপরিশোধিত তেলের উপাদানগুলোকে আলাদা করা হয়।
পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার
পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থের বড় একটি অংশ ব্যবহৃত হয় যানবাহনে জ্বালানি হিসেবে। কৃষিজমিতে সেচকাজে, ডিজেলচালিত ইঞ্জিনে জ্বালানি হিসেবে প্রচুর পরিমাণে পেট্রোলিয়াম ব্যবহৃত হয়। এছাড়া শিল্প-কারখানায় সার, কীটনাশক, মোম, আলকাতরা, লুব্রিকেন্ট, গ্রিজ ইত্যাদি তৈরিতেও পেট্রোলিয়াম ব্যবহৃত হয়।
কয়লা হলো কালো বা কালচে বাদামি রঙের একধরনের পাললিক শিলা। এতে বিদ্যমান মূল উপাদান হচ্ছে কার্বন। তবে স্থানভেদে এতে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে হাইড্রোজেন (H2), সালফার (S), অক্সিজেন (O2) কিংবা নাইট্রোজেন (N2) থাকে। কয়লা একটি দাহ্য পদার্থ, তাই জ্বালানি হিসেবে এর বহুল ব্যবহার রয়েছে।প্রাকৃতিক গ্যাস আর খনিজ তেলের মতো কয়লা একটি জীবাশ্ম জ্বালানি (Fossil Fuel) হলেও এর গঠন প্রক্রিয়া আলাদা। প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে জলাভূমিতে জন্মানো প্রচুর ফার্ন, শৈবাল, গুল্ম ও অন্যান্য গাছপালা মরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে কয়লা তৈরি হয়েছে। গাছপালায় বিদ্যমান জৈব পদার্থে থাকা কার্বন প্রথমে জলাভূমির তলদেশে জমা হয়। এভাবে জমা হওয়া কার্বনের স্তর আস্তে আস্তে পলি বা কাদার নিচে চাপা পড়ে যায় এবং বাতাসের সংস্পর্শ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরকম অবস্থায় কার্বনের স্তর আরো ক্ষয় হয়ে পানিযুক্ত, স্পঞ্জের মতো ছিদ্রযুক্ত জৈব পদার্থে পরিণত হয়, যাকে বলা হয় পিট (Peat)। পিট অনেকটা হিউমাসের মতো পদার্থ। পরবর্তীতে উচ্চ চাপে ও তাপে এই পিট পরিবর্তিত হয়ে কার্বনসমৃদ্ধ কয়লায় পরিণত হয়। কয়লা তিন রকমের হয়। যেমন: অ্যানথ্রাসাইট, বিটুমিনাস এবং লিগনাইট। অ্যানথ্রাসাইট হলো সবচেয়ে পুরোনো ও শক্ত কয়লা, যা প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে তৈরি এবং এতে শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ কার্বন থাকে। বিটুমিনাস কয়লা প্রায় ৩০০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো এবং এতে শতকরা ৫০-৮০ ভাগ কার্বন থাকে। লিগনাইট কয়লা ১৫০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো আর এতে সর্বোচ্চ শতকরা ৫০ ভাগ পর্যন্ত কার্বন থাকে।
প্রক্রিয়াকরণ
ভূগর্ভের কয়লার খনি থেকে মেশিনের সাহায্যে কয়লা উত্তোলন করা হয়। কয়লা উত্তোলনের জন্য দুটি পদ্ধতি আছে। একটি হলো ওপেন পিট মাইনিং (Open Pit Mining) আর অন্যটি হলো ভূগর্ভস্থ মাইনিং (Underground Mining)। সাধারণত কয়লার স্তর ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকে বলে ওপেন পিট মাইনিং পদ্ধতি বেশি ব্যবহৃত হয়। মেশিন দিয়ে ভূগর্ভ থেকে কয়লা তোলার পর কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে সেগুলো প্রক্রিয়াকরণ প্লান্টে নেওয়া হয়। সেখানে কয়লায় থাকা অন্যান্য পদার্থ যেমন : ময়লা, শিলা কণা, ছাই, সালফার – এগুলোকে পৃথক করে ফেলা হয়।
ব্যবহার
তোমরা কি জান, কোন কোন কাজে কয়লা ব্যবহার করা হয়? বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহৃত হয় ইটের ভাটায়। জ্বালানি হিসেবে শিল্প-কারখানায় এবং বাসাবাড়িতে জ্বালানি হিসেবেও সামান্য কিছু কয়লা ব্যবহৃত হয়। আমাদের দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখনো কয়লা ব্যবহৃত না হলেও পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার খুবই বেশি। এছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁয় কাবাব-জাতীয় খাবার তৈরিতে এবং কর্মকার ও স্বর্ণকারগণ বিভিন্ন সামগ্রী এবং অলংকার তৈরির সময় কয়লা ব্যবহার করে থাকেন।প্রাকৃতিক জ্বালানির সংরক্ষণে নবায়নযোষ্ট শক্তি: আলোচিত প্রাকৃতিক জ্বালানির সবগুলোই এক সমর নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। তাই এগুলোর ব্যবহার কমানো ও সংরক্ষণের জন্য আমরা নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে পারি। সৌরশক্তি, বায়ুপ্রবাহ, পানির স্রোত এগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা প্রাকৃতিক জ্বালানির উপর চাপ কমাতে পারি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শক্তি সংরক্ষণ করতে পারি।