কম্পনশীল বস্তুর আঘাতে এর সংলগ্ন মাধ্যমের কণা নিজ মধ্য অবস্থানের দুদিকে এদিক-ওদিক (to and fro) সরল দোলন গতিতে কাপতে থাকে। ঐসব বায়ুকণা তাদের পাশের কণাকে একই জাতীয় কম্পনে কম্পিত করে। এভাবেই পরপর কণা থেকে কণাতে কম্পন স্থানান্তর হতে থাকে, অর্থাৎ শব্দ উৎস থেকে তরঙ্গ বিস্তারের অভিমুখে কম্পনরত কণার একটি শৃঙ্খল তৈরি হয় এবং শেষ পর্যন্ত শ্রোতার কানে কম্পন আঘাত করে। সুতরাং শব্দ উৎস হতে প্রাপ্ত শক্তি কণা থেকে কণাতে স্থানান্তরিত হয়ে অবশেষে শ্রোতার কানে পৌঁছায়; কিন্তু কোনো স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের কণাগুলোর স্থানান্তর ছাড়া যে পর্যাবৃত্ত আন্দোলনের দ্বারা এক স্থান মাধ্যমের কণার কোনো স্থায়ী স্থানচ্যুতি ঘটে না।
জড় মাধ্যমের ভেতর দিয়ে তরঙ্গের বিস্তারের সময় মাধ্যমের কণাগুলি আন্দোলিত হয়, ফলে শক্তির স্থানান্তর ঘটে। ঐ শক্তির কিছু অংশ গতিশক্তি ও বাকী অংশ স্থিতিশক্তি, যদিও মোট শক্তি সর্বত্র সমান। তরঙ্গ মাধ্যমের মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হলে মাধ্যমের কণাগুলো সরল দোলন গতি লাভ করে [চিত্র ১.৪]। শক্তি সঞ্চালনে কণাগুলো সরাসরি ভূমিকা পালন করে না এবং কণাগুলো স্থায়ীভাবে স্থানচ্যুতও হয় না। পক্ষান্তরে তরা সঞ্চালনে মাধ্যমের প্রয়োজন না হলে শক্তি স্থানান্তরে কণার কোনো ভূমিকাই থাকে না। পানির উপর একটি শোলা বা পাটকাঠি থাকলে দেখা যাবে যে, শোলা বা কাঠিটি একই স্থানে থেকে উপরে-নিচে উঠানামা করছে। এর অর্থ হলো মাধ্যমের কণাগুলো স্থান ত্যাগ করে না, যদি করত তবে শোলা বা কাঠিটি সরে পাড়ে চলে আসত। মাধ্যমের কণাগুলোর মধ্যে সংসক্তি বলের কারণে এগুলো স্থান ত্যাগ করে না; তবে আন্দোলনের দ্বারা পার্শ্ববর্তী কণাগুলোতে শক্তি সঞ্চালিত হয় বলে পাশের কণাগুলো আন্দোলিত হয়। এভাবে শক্তি তরঙ্গাকারে এক স্থান হতে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়। সুতরাং তরঙ্গের নিম্নরূপ সংজ্ঞা দেয়া যায় :
কোনো স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের কণাগুলোর স্থানান্তর ছাড়া যে পর্যাবৃত্ত আন্দোলনের দ্বারা এক স্থান হতে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চালিত হয় তাকে তরঙ্গ বলে। তরঙ্গ শক্তির এক প্রকার রূপ তাই পানিতে ডিল নিক্ষেপের সময় হাত থেকে শক্তি ঢিলে স্থানান্তরিত হয়। আবার যখন টানা দেয়া তারে একটি তরঙ্গকে স্থাপন করা হয় তখন প্রকৃতপক্ষে তারে তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্য শক্তি সরবরাহ করা হয়। সুতরাং দেখা যায় যে, মাধ্যমে আন্দোলনের ফলে মাধ্যমের কণাসমূহে যে যান্ত্রিক শক্তির সৃষ্টি হয়। তা কম্পনের মাধ্যমে এক স্থান হতে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়। তরঙ্গ দ্বারা শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়। এই তরঙ্গ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলাচলের সময় গতিশক্তি ও স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি স্থানান্তরিত হয়।
মনে করি তারের একটি কণার ভর dm, যা আড় তরঙ্গরূপে সরল ছন্দিত গতিতে কম্পিত হচ্ছে। যখন তরঙ্গ এই কণাকে অতিক্রম করে তখন তা গতিশক্তি প্রাপ্ত হয় যার বেগ v। y = 0 অবস্থানে কণার অবস্থানের জন্য আড় কম্পনের বেগ তথা গতিশক্তি সর্বাধিক হয় [চিত্র ৯.৪]। আবার কণাটির চূড়ান্ত অবস্থান y = ym অবস্থানে আড় কম্পনের বেগ তথা গতিশক্তি শূন্য বা সর্বনিম্ন হয়।
এখন একটি সাইন তরঙ্গ পূর্বের টানা তারে সঞ্চালনের জন্য প্রয়োগ করা হলে তা তারটিতে চাপ (stretch) প্রয়োগ করে। (১-৪) চিত্র অনুযায়ী ধরি তারের ক্ষুদ্র dx অংশ আড়াআড়িভাবে কম্পিত হচ্ছে; কাজেই এই দৈর্ঘ্য dx বরাবর পর্যায়ক্রমিকভাবে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়।
সেক্ষেত্রে বলা যায় তারটি স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি লাভ করার জন্য দৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হচ্ছে যেমনটি লক্ষ করা যা একটি স্প্রিং এর ক্ষেত্রে। যখন তারে কণার অবস্থান y = ym হয় তখন ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্য dx অপরিবর্তিত থাকে এবং এই অবস্থানে স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি শূন্য হয়। আবার y = 0 অবস্থানে স্থিতিস্থাপক স্থিতিশক্তি সর্বাধিক হয়। এভাবে কম্পিত তার গতিশক্তি ও স্থিতিশক্তি লাভ করে।
আমরা যখন কথা বলি তখন উৎপন্ন শব্দ তরঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে, একটি শব্দসৃষ্টিকারী উৎসের কম্পনে পর্যায়ক্রমে মাধ্যমে সংকোচন ও প্রসারণ সৃষ্টি হয় এবং তরঙ্গ সমবেগে চারদিকে ছড়িয়ে যায়। একটি পূর্ণ কম্পনকালের মধ্যে মাধ্যমের কোনো কণার সরণ-সময় লেখচিত্র কিংবা তরঙ্গের বিস্তারের অভিমুখে নির্দিষ্ট সময় বিভিন্ন কণার সরণ-দূরত্ব লেখচিত্র অঙ্কন করলে লেখচিত্রগুলি তরঙ্গ আকারের হবে।