অন্ত্রেরর প্রথম প্রতিরক্ষার স্তর কোনটি?
১. প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর (First line of Defense)
মানবদেহের প্রতিরক্ষায় যে প্রতিরক্ষা স্তর রাসায়নিক ও ভৌত বাহ্যিকতলীয় প্রতিবন্ধক (chemical and physical surface barriers) হিসেবে বহিরাগত যে কোনো অণুজীব বা কণাকে দেহের ভিতরে প্রবেশে বাধা দেয় তাকে প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর বলে। এ স্তরটি নন-স্পেসিফিক (non-specific) স্তর নামে পরিচিত।
ক. ত্বক (skin/Integument; integere to cover): ত্বক চারভাবে একটি কার্যকর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে: গাঠনিকভাবে কেরাটিনময়, বায়ুরোধী, জলাভেদ্য (waterproof) ও অধিকাংশ পদার্থের প্রতি অভেদ্য;সবসময় প্রতিস্থাপিত হয়; এসিডিক এবং ঘামগ্রন্থি ও স্বেদগ্রন্থি থেকে উৎপন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি।
খ. লোম (Hairs): নাকের ভিতরকার লোম ধূলা-ময়লা আটকে দেহের অভ্যন্তরে ক্ষতিকর পদার্থের যাতায়াত বন্ধ করে রাখে।
গ. সিলিয়া (Cilia): দেহের প্রবেশ পথগুলো মিউকাস ঝিল্লিতে (mucous membrane) আবৃত থাকে। মিউকাস ঝিল্লিময় অনেক অংশ (যেমন- শ্বাসনালি) আণুবীক্ষণিক ও সদা বহির্মুখী আন্দোলনরত সিলিয়ায় আবৃত থাকে বহিরাগত কণা ও অণুজীব এ ঝিল্লির আঠালো মিউকাসে আটকে দলা পাকিয়ে হাঁচি-কাশি-থুথু হিসেবে বহির্গত হয় কিংবা পাকস্থলিতে এসে পৌঁছায়।
ঘ. অশ্রু ও লালা (Tears and Saliva): অশ্রু ও লালায় যে লাইসোজাইম (lysozyme) এনজাইম রয়েছে তা ব্যাকটেরিয়ানাশক হিসেবে কাজ করে। লালা মুখগহ্বরকে শুধু সিক্ত ও পিচ্ছিল রাখে না, গহ্বরের প্রাচীর যেন শুকিয়ে ফেটে না যায় সে কাজও করে। এ কারণে কেনো জীবিত ব্যাকটেরিয়া মুখের ক্ষতি করতে পারে না। বরং লালামিশ্রিত হয়ে সরাসরি পাকস্থলিতে পৌঁছে আরও শক্তিশালী এসিডের ক্রিয়ায় বিনষ্ট হয়। চোখকে বারংবার ভিজিয়ে দিয়ে অশ্রু বহিরাগত কণা ও অণুজীবের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
ঙ. সিরুমেন (Cerumen or Ear wax): বহিঃকর্ণের কর্ণকুহর নামক অংশের প্রাচীর থেকে ক্ষরিত হলদে-বাদামি রংয়ের মোমের মতো পদার্থকে সিরুমেন বলে। কানের পর্দায় যেন ময়লা ও অণুজীবের সংক্রমণে শ্রবণে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য সিরুমেনে আটকে শক্ত দলায় অর্থাৎ কানের খইল-এ পরিণত হয়।
চ. পৌষ্টিকনালির এসিড (Acid of Alimentary canal): খাদ্য ও পানির সঙ্গে অনেক ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব পাকস্থলিতে এসে জমা হয় এবং পাকস্থলির শক্তিশালী হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও প্রোটিওলাইটিক এনজাইমের ক্রিয়ায় বিনষ্ট হয়।
ছ. রেচন-জননতন্ত্রের এসিড (Acid of Excretory-reproductive system): রেচন-জননতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত অঙ্গের ক্ষরণ প্রচন্ড এসিডিক ও আঠালো হয়ে থাকে। অনুপ্রবেশিত অণুজীব সহজেই আঠালো ক্ষরণে আটকে যায় এবং পরে ফ্যাগোসাইট এগুলোকে গ্রাস করে বা মূত্রত্যাগের সময় সবেগে নিষ্ক্রান্ত হয়। যোনিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটিক এসিড ক্ষরণ করে অন্য অণুজীবের বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
২. দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Second line of Defense)
বাহ্যিকতলীয় প্রতিরক্ষা স্তর ভেদ করে দেহের অভ্যন্তরে প্রবেশকারী যে কোনো অণুজীব বা অণুকণার বিরুদ্ধে দেহাভ্যন্তরীণ কোষীয় ও রাসায়নিক প্রতিরক্ষা (internal cellular and chemical defenses) নিয়ে গঠিত যে স্তর সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাকে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর বলে। এটিও একটি নন-স্পেসিফিক প্রতিরক্ষা স্তর সংজ্ঞা দিতে হবে। নিচে বর্ণিত অস্ততঃ ৬ ধরনের নন-স্পেসিফিক প্রতিরক্ষা পদ্ধতি নিয়ে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর গঠিত।
ক. ফ্যাগোসাইট (Phagocytes): বড় আকারের শ্বেত রক্তকণিকা যা অণুজীব, অন্য কোষ ও বহিরাগত কণা ভক্ষণ করে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখে তাকে ফ্যাগোসাইট বলে। দুটি প্রধান ফ্যাগোসাইটিক কণিকা হচ্ছে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ। এগুলো অস্থিমজ্জা থেকে উৎপন্ন হয়। দেহে জীবাণুর সংক্রমণ হলে তার প্রতি সাড়াদান হিসেবে নিউট্রোফিল রক্তে, আর ম্যাক্রোফেজ নির্দিষ্ট টিস্যুতে ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু গ্রাস করে। শুধু জীবাণু গ্রাস ও হজম করাই নয়, ম্যাক্রোফেজ পুরনো রক্তকণিকা, মৃত টিস্যু-খন্ড ও কোষীয় ময়লা গ্রাস করে ধাঙ্গর কোষ হিসেবে কাজ করে।
খ. সহজাত মারণকোষ (Natural killer cells, সংক্ষেপে NK cells): এক ধরনের লিম্ফোসাইট জাতীয় বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা যা টিউমার কোষ ও ভাইরাসে আক্রান্ত কোষের প্লাজমাঝিল্লিতে কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তনকে শনাক্ত করে কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয় সেসব কোষকে সহজাত মারণকোষ (NK-কোষ) বলে। NK-কোষের আক্রমণে দ্রুত টার্গেট কোষের ঝিল্লিতে একটি রন্ধ্রের সৃষ্টি হয় এবং নিউক্লিয়াসটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।
গ. প্রদাহ (Inflammation): টিস্যুর যে কোনো ধরনের ক্ষতি হলে (যেমন- সংক্রমণজনিত দহন, যন্ত্রণাদায়ক রাসায়নিক বা আঘাতজনিত দৈহিক ক্ষত ইত্যাদি) যে ধারাবাহিক ঘটনার শুরুতে
ক্ষতস্থানটি লাল হয়ে যায়,
পরে গরম হয়,
ফুলে যায় এবং
সবশেষে ব্যথার প্রকাশ ঘটায়
তাকে সম্মিলিতভাবে প্রদাহ সাড়া (inflammatory response) বা প্রদাহ বলে।
ঘ. কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম বা কমপ্লিমেন্ট (Complement system or complement): কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম হচ্ছে অন্ততঃ ২০ ধরনের প্লাজমা প্রোটিনে গঠিত এমন একটি গ্রুপ যা রক্তে সংবহিত হয়ে অন্যান্য প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে সহায়তা করে।
স্বাভাবিক অবস্থায় এসব প্রোটিন নিষ্ক্রিয়ভাবে সংবহিত হয়। একবার যদি কোনো প্রোটিন সক্রিয় হয়ে উঠে তাহলে তা আরেকটি প্রোটিনকেও সক্রিয় করে তুলে। এভাবে সমস্ত প্রোটিন পরস্পরকে সক্রিয় করে স্পেসিফিক ও নন-স্পেসিফিক উভয় ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে উসকে দেয়। ফলশ্রুতিতে NK-কোষ দক্ষতার সঙ্গে টিউমার কোষ ধ্বংস করে; নিউট্রোল ও ম্যাক্রোফেজ দ্রুত ক্ষতস্থানে পৌছায়; অণুজীবের গায়ে কমপ্লিমেন্ট আটকে থেকে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজকে কোষভক্ষণে সহযোগিতা করে (চিনিয়ে দেয়); এবং রক্তবাহিকার প্রসারণ ঘটিয়ে প্রদাহ ত্বরান্বিত করে।
ঙ. ইন্টারফেরন (Interferon): ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটাতে আক্রান্ত কোষ থেকে যে বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্র গ্লাইকোপ্রোটিন উৎপন্ন ও ক্ষরিত হয় তাকে ইন্টারফেরন বলে। ইন্টারফেরন ব্যাপিত হয়ে আশপাশের সুস্থ কোষে ছড়িয়ে পড়ে, ঐসব কোষের ঝিল্লিতে যুক্ত হয় এবং সুস্থ কোষগুলোকে এ ধরনের প্রোটিন সংশ্লেষে উদ্দীপ্ত করে, ফলে ভাইরাসের পক্ষে অন্য সুরক্ষিত কোষগুলোতে আক্রমণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
চ. জ্বর (Fever): দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের শেষ অস্ত্র হচ্ছে জ্বর। দৈহিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের (97–99°F অর্থাৎ 36-37.2°C) চেয়ে বেশি হলে তাকে জ্বর বলে। ম্যাক্রোফেজ যখন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা বহিরাগত কণাকে শনাক্ত ও আক্রমণ করে তখন কোষগুলো রক্তপ্রবাহে পাইরোজেন (pyrogen) নামক পলিপেপটাইড ক্ষরণ করে। পাইরোজেন মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসে বিপাকীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দেহের তাপমাত্রাকে উচ্চতর মাত্রায় নির্ধারণ করায়। তখন শরীর কেঁপে উঠে ও জ্বর আসে। জ্বর হলে দেহকোষের বিপাকীয় হার বেড়ে যায়, প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ও টিস্যুর ক্ষয়পূরণ দ্রুততর হয়। জ্বরশেষে পাইরোজেনগুলো ক্ষরণ বন্ধ করে দেয়, দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসে। যে জ্বর দুদিনের বেশি স্থায়ী হয়, কিংবা ১০০°এ ছাড়িয়ে যায় তখনই চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত।
৩. তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Third line of Defense)
যে প্রতিরক্ষা স্তর দেহে অনুপ্রবেশকারী সুনির্দিষ্ট ধরনের বহিরাগত রোগসৃষ্টিকারী অণুজীব বা কণা বা ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে এবং প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর এসব নির্দিষ্ট ক্ষতিকর টার্গেটকে আজীবন মনে রেখে পরবর্তী যে কোনো আক্রমণের সময় দ্রুত ও কার্যকর সাড়া দেয় তাকে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর বলে। এ স্তরের সামগ্রিক কর্মকান্ডটি ইমিউন সাড়া (immune response) নামে পরিচিত।
এ সাড়া নিম্নোক্ত ৩টি বিশেষ বৈশিষ্ট্যযুক্ত:
ক. বহিরাগত অণুজীব বা কণা শনাক্ত করে টার্গেটে পরিণত করতে পারে। নিজের স্বাস্থ্যবান কোষকে অসুস্থ (যেমন- ক্যান্সার কোষ) বা মৃতপ্রায় বা মৃতকোষ থেকে পৃথক করতে পারে।
খ. বহিরাগত অণুজীব বা কণার সংক্রমণ স্মৃতি তে ধরে রেখে বছরের পর বছর নির্দিষ্ট বহিরাগতের অনুপ্রবেশ দ্রুত ঠেকানোর চেষ্টা করে।
গ. এটি সমগ্র দেহকে রক্ষা করে এবং অনুপ্রবেশকারী উদ্ভূত অনাক্রম্যতা দেহের নির্দিষ্ট অংশে কার্যকর না থেকে শরীরের যে কোনো অংশে কার্যকর হতে পারে।