“রাজাকার” একটি বাঙালি শব্দ যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি মূলত একটি অপবাদজনক শব্দ যা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী ও পাকিস্তানী শাসনের পক্ষের বাহিনীর সদস্যদের বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হতো। এই শব্দটির উৎপত্তি এবং ইতিহাসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখানে দেওয়া হলো:
শব্দের মূল: "রাজাকার" শব্দটি উর্দু ভাষা থেকে এসেছে। উর্দু ভাষায় “রাজাকর” (رازداری) বা “রাজা” (রাজা) এবং “কার” (যিনি করে) এর মিশ্রণে শব্দটি গঠিত। এখানে "রাজা" বলতে ইংরেজিতে “King” বা “Ruler” বোঝানো হয়, এবং “কার” মানে “করা” বা “ব্যক্তি”। কিন্তু বাংলা ভাষায়, এটি মূলত একটি পার্থিব ও নিন্দনীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
প্রথম ব্যবহারের প্রেক্ষাপট: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় "রাজাকার" শব্দটি পাকিস্তানী শাসনের প্রতি আনুগত্য ও সহযোগিতা দেখানো ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।
অভ্যন্তরীণ ভূমিকা: রাজাকাররা পাকিস্তানী বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করেছিল। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে থাকা মানুষের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও অত্যাচার পরিচালনা করেছে। তাদের কাজের মধ্যে ছিল:
- মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে "রাজাকার" শব্দটি একটি নেতিবাচক পরিভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এটি সাধারণভাবে একটি ষড়যন্ত্রকারী বা দেশদ্রোহী ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
"রাজাকার" শব্দটির উৎপত্তি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী গোষ্ঠীকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। এটি একটি বাংলা শব্দ যা মূলত "রাজ্য" এবং "আকর" শব্দের সংমিশ্রণ থেকে এসেছে, কিন্তু এটি ইতিহাসের কারণে একটি নেতিবাচক অর্থ ধারণ করে।
**রাজাকার** বাহিনী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন করেছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। মুক্তিযুদ্ধ শেষে, রাজাকারদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে, যার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ, এবং বেসামরিক মানুষের উপর নির্যাতন অন্তর্ভুক্ত।
- **যুদ্ধাপরাধের বিচার**: রাজাকারদের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের বিচার নিশ্চিত করার দাবি।
- **আত্মবিশ্বাস ও সুবিচার**: মুক্তিযুদ্ধের শিকার মানুষ এবং তাদের পরিবারের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক আন্দোলন, যা ২০১৩ সালে শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলন মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য সংগঠিত হয়েছিল।
এখানে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের বিভিন্ন দিক ও কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধের বিচার: ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী দন্ডিত না হওয়া ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা ছিল। তখন বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে।
গণজাগরণ মঞ্চের সূচনা: গণজাগরণ মঞ্চ ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার শাহবাগ চত্বরে প্রথমে তরুণ ছাত্রদের একটি সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যেসব অপরাধী ছিল, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা।
মুখ্য উদ্দেশ্য:
প্রধান কর্মসূচি:
প্রভাব:
চ্যালেঞ্জ:
সমালোচনা:
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা: গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শেষ হলেও, বাংলাদেশের সমাজে বিচারবিচার, মানবাধিকার এবং সুশাসনের বিষয়ে তাদের কাজ ও প্রভাব এখনও গুরুত্বপূর্ণ।
গণজাগরণ মঞ্চের একটি নির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না। এটি মূলত তরুণ ছাত্রদের একত্রিত একটি ভলান্টিয়ারী আন্দোলন হিসেবে কাজ করেছিল।
পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সমতার ভিত্তিতে এগিয়ে নিতে কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় সারা বিশ্বে কোটা সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রচলিত। বাংলাদেশেও মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই এই ব্যবস্থা শুরু হয়। তবে ২০১৮ সালে প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে সরকার কোটা প্রথা বাতিলও করে। তবে সম্প্রতি সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রতিবাদে আবারও শুরু হয়েছে আন্দোলন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নারী কোটা ১০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং জেলা কোটা ১০ শতাংশ বাতিল করে পরিপত্র জারি করে সরকার। ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাত জন। আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত ৫ জুন হাই কোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।
এরপর সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকায় নেমেছেন শিক্ষার্থী ও চাকরি প্রত্যাশীরা।
কোটাবিরোধী আন্দোলনে হঠাৎ করেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে রোববার (14-07-2024) দিবাগত মধ্যরাতে। এদিন বিকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার ইস্যুতে। সরকারের একটি কথার প্রতিবাদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ (ঢাবি) অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও নিজেদের রাজাকার ঘোষণা করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।
বিষয়টি একটা সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ছড়িয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের হলে হলে। রাতে হঠাৎ করেই সরকারপ্রধানের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে নিজেদের রাজাকার ঘোষণা করে স্লোগান দিতে থাকেন। একটা সময় ঢাবির হল থেকে বের হয়ে রাতে শাহবাগে মিছিল নিয়ে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় আন্দোলন। বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষার্থীরা। স্লোগান দিতে থাকেন, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার-রাজাকার’।
‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান নিয়ে উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
রাজাকার শব্দ নিয়ে সরকারি দলের নেতারা বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য করলেও ‘রাজাকার’ শব্দটি শিক্ষার্থীরা কেন বলেছেন তা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আদ্বিত্য পিয়াস নামে সাবেক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর পোস্ট নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছেন।
যেখানে বলা হয়েছে, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার।’
আমরা জানি রাজাকার শব্দটি বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ। তাহলে শিক্ষার্থীরা নিজেদেরকে রাজাকার বলছে কেন?
উত্তর : ‘কেউ একজন’ আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সমাজকে রাজাকার বলেছেন সেই প্রতিবাদে সীমাহীন দুঃখকষ্টে বুকে নিয়ে বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত, অধিকারবঞ্চিত শিক্ষার্থী সমাজের নিজেদেরকে এই ‘রাজাকার’ বলাটা যে একটা শক্তিশালী আয়রনি, অনেক বড় একটা প্রতিবাদ এই সামান্য বিষয়টি আমাদের আশপাশের অনেক বলদ বুঝবে না। এই সামান্য জিনিস বোঝার জন্য মাথায় কিছু জ্ঞানও তো থাকতে হয়!
কপিস্বত্বঃ কিছু অংশ অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এর লেখা থেকে (আরও সহায়তা নেওয়া হয়েছে সময়ের কণ্ঠস্বর দৈনিক থেকে)