বাংলা সাহিত্যে মুসলিম লেখক হিসেবে যাঁরা প্রথম আলো জ্বালিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭–১৯১১)। তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও সমাজসংস্কারক। তার লেখায় ফুটে উঠেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সমাজসংস্কার, কৃষকের দুঃখকষ্ট, নিপীড়িত মানুষের যন্ত্রণা এবং মানবিক চেতনা। তার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো “বিষাদ-সিন্ধু”, যা কারবালার করুণ কাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত।
মীর মশাররফ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৩ নভেম্বর ১৮৪৭ সালে কুষ্টিয়া জেলার লাহিনীপাড়া গ্রামে (বর্তমানে কুমারখালী উপজেলা)। তিনি জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি সংস্কৃত, ফারসি ও আরবি ভাষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং মাদ্রাসা ও বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন গ্রামে। পরে ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। যদিও উচ্চশিক্ষা পুরোপুরি শেষ করতে পারেননি, কিন্তু আত্মশিক্ষা ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন প্রভাবশালী সাহিত্যিক, যিনি মুসলিম সমাজকে সাহিত্যের মাধ্যমে নতুন চিন্তাভাবনার সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন।
বিষাদ-সিন্ধু (১৮৮৫-১৮৯১): তার শ্রেষ্ঠ রচনা, তিন খণ্ডে রচিত। কারবালার মর্মান্তিক কাহিনি এখানে বর্ণিত হয়েছে। এটি বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ধর্মীয় ইতিহাসভিত্তিক প্রথম মহাকাব্যিক উপন্যাস।
রত্নাবতী (১৮৬৯): তার প্রথম উপন্যাস।
জমিদার দर्पণ (১৮৭৩): নাট্যরূপে জমিদার প্রথার অন্যায় উন্মোচন।
গৌরীসঙ্কল্প (১৮৭৫): সমাজসংস্কারমূলক রচনা।
তারা সিংহ (১৮৭৭): সমাজের বৈষম্য ও দ্বন্দ্বচিত্র।
বেগম রোকেয়া-র আগে মুসলিম সমাজে নারীশিক্ষা ও সংস্কার নিয়ে তিনি কলম ধরেছিলেন।
১. ধর্মীয় আবেগ: ইসলামী ইতিহাস ও ধর্মীয় মূল্যবোধ তার সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে।
২. সমাজসংস্কার: জমিদারি শোষণ, অশিক্ষা, বৈষম্য নিয়ে তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন।
৩. মানবিকতা: নিপীড়িত ও শোষিত মানুষের কাহিনি তার রচনায় বারবার উঠে এসেছে।
৪. নাটকীয়তা: তার লেখায় নাটকীয় আবেগ ও সংলাপ ছিল যা পাঠককে আকর্ষণ করত।
জমিদারি প্রথার অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন।
কৃষকশ্রেণির মুক্তি ও শিক্ষার প্রসারে তিনি কাজ করেছেন।
তিনি মুসলিম সমাজকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার জন্য কলম ধরেছিলেন।
মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন সত্যবাদী, প্রগতিশীল ও সমাজমনস্ক। মুসলিম সমাজে যখন সাহিত্যচর্চা সীমিত ছিল, তখন তিনি কলমের মাধ্যমে নতুন পথ দেখিয়েছিলেন। এজন্য তাকে “প্রথম মুসলিম ঔপন্যাসিক” বলা হয়।
১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন শারীরিক অসুস্থতায় ভুগেছিলেন।
মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সমাজের কণ্ঠস্বর হিসেবে এক অনন্য আসন দখল করে আছেন। তার “বিষাদ-সিন্ধু” শুধু সাহিত্যকীর্তিই নয়, ধর্মীয় আবেগ ও ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। তিনি সমাজসংস্কারক, মানবিক চিন্তাবিদ ও সাহসী কথাশিল্পী হিসেবে বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয়।
আপনি আমাকে যেকোনো প্রশ্ন করতে পারেন, যেমনঃ
Are you sure to start over?