আদি পিতামাতা

চতুর্থ শ্রেণি (প্রাথমিক) - খ্রিষ্টধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - NCTB BOOK

চতুর্থ অধ্যায়

আদি পিতামাতা

আমরা স্বর্গদূতদের পতন ও শাস্তি সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জেনেছি যে, তারা পতিত হওয়ার পর শয়তান হয়েছে। এর আগে তারা ভালো স্বর্গদূত ছিল। কিন্তু তাদের পতন ও শাস্তি হয়েছে তাদেরই অহংকারের কারণে। ঈশ্বর তাদের স্বর্গ থেকে দূর করে দিলেন। একটি নরক সৃষ্টি করে সেখানে তাঁদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব আমাদের আদি পিতামাতার পতন সম্পর্কে। আমরা দেখব, পাপের ফলে কীভাবে সুখের জীবন ত্যাগ করে তাঁদের আসতে হলো কষ্টের পৃথিবীতে। পৃথিবীতে আদি পিতা মাতার কী ধরনের কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছে তাও আমরা আলোচনা করব। ঈশ্বর পুরুষ ও নারী করে যে প্রথম মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁদের নাম দিয়েছিলেন আদম ও হবা। ‘আদম’ অর্থ মানুষ এবং ‘হবা' অর্থ নারী। তাঁরাই

 ছিলেন এ পৃথিবীর প্রথম পুরুষ ও নারী। তাঁদের ঈশ্বর খুব ভালোবাসতেন। সব সৃষ্টিই উত্তম হলেও অন্য সব সৃষ্টির মধ্যে মানুষ ছিল সবচেয়ে বেশি উত্তম। কারণ, একমাত্র মানুষ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি পেয়েছে। অর্থাৎ মানুষকে নিজের মতো করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর তাঁর নিজের কিছু কিছু গুণ দিয়েছেন। কাজেই ঈশ্বর তাঁর এই ভালোবাসার মানুষকে স্বর্গে অত্যন্ত সুখের ও সুন্দর একটা স্থানে রেখেছিলেন। স্থানটির নাম ছিল এদেন বাগান। এখানে তাঁদের জন্য কোনো কিছুরই অভাব ছিল না ৷

 

 

 

স্বর্গে আদি পিতামাতার সুখের দিনগুলো ছিল নিম্নরূপ

১। সকল সুখের উৎস ঈশ্বরের সাথেই আদি পিতামাতা বাস করছিলেন। ঈশ্বরের সাথে তাঁরা এক পরিবারের মতো ছিলেন। সেখানে তাঁদের কোনো কিছুর জন্যই চিন্তা করতে হতো না। তাঁদের খাদ্য উৎপাদনের জন্য কোনো কায়িক পরিশ্রম করতে হতো না । পানীয়েরও কোনো অভাব ছিল না। চাওয়ার আগেই ঈশ্বর তাঁদের সব কিছু দিয়ে রেখেছিলেন। যখন যে আনন্দ তাঁদের করতে ইচ্ছা হতো, তখনই তাঁরা তা করতে পারতেন।

২। তাঁরা ঈশ্বরের মতোই পবিত্র ছিলেন। কোনো অপবিত্রতা বা কলুষতা তাদের দেহ,মন, আত্মায় ছিল না। সেই কারণে তাঁদের মনে কোনো অপরাধবোধও ছিল না। এটা তাঁদের অন্তরের সবচেয়ে বড় একটা সুখ।

৩। আদি পিতামাতার কোনো অসুখবিসুখ বা মৃত্যু ছিল না। কাজেই রোগবালাই নিরাময়ের জন্য তাঁদের কোনো দুশ্চিন্তাও করতে হতো না। মৃত্যুর জন্য তাঁদের কোনো ভয় হতো না । কারণ তাঁরা চিরজীবন্ত ঈশ্বরের সঙ্গেই ছিলেন। যিনি তাঁদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর সঙ্গেই ছিলেন ৷

৪। স্বর্গীয় উদ্যানে অর্থাৎ ঈশ্বরের সান্নিধ্যে মানুষ ছাড়াও অন্যান্য পশুপাখি, জীবজন্তু ছিল। কারও সাথে কোনো ঝগড়াঝাটি ছিল না। সবাই একসাথেই বসবাস করত। বড় জন্তুরা ছোট জন্তুদের আক্রমণ করত না। কারণ তাদেরও খাওয়াদাওয়ার বা নিরাপত্তার কোনো অভাব ছিল না ৷

৫। ঈশ্বর আদি পিতামাতাকে দিয়েছিলেন সবকিছুর ওপর কর্তৃত্ব করার দায়িত্ব। এর দ্বারা তাঁরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে সৃষ্টিগুলো দেখাশুনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ঈশ্বরের কাছ থেকে এত সুন্দর দায়িত্ব স্বর্গের দূতেরাও পান নি ।

৬। ঈশ্বর আদি পিতামাতাকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছিলেন। এর দ্বারা নিজের ইচ্ছামতো সব কিছু করতে পারতেন। অন্য কোনো সৃষ্টিই এই দানটি পায় নি।

এসব কারণে আমরা বলতে পারি যে আমাদের আদি পিতামাতা সবচেয়ে সুখের স্থানে বসবাস করছিলেন। মানুষের পাপে পতন এদেন উদ্যানে অনেক সুমিষ্ট ফলের গাছ ছিল। ঈশ্বর প্রথম মানুষদের শুধু একটি ছাড়া অন্য সব গাছের ফল খাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই গাছটি ছিল ভালো-মন্দ জ্ঞানের গাছ। ঈশ্বর তাঁদের বলেছিলেন, তাঁরা যেদিন সেই গাছের ফল খাবেন, সেদিনই মরবেন।

 

কিন্তু শয়তান আমাদের আদি পিতামাতাকে পাপে ফেলার জন্য চেষ্টা করছিল। সে ঈশ্বরের কাজকে ঘৃণা করত। শয়তান ঈশ্বরের সেরা সৃষ্টি মানুষকে পাপে ফেলার মাধ্যমে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। একদিন সে সাপের বেশ ধরে এসে হবাকে জিজ্ঞেস করল, তাঁরা কেন ঐ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খান না। তিনি বললেন, “ঈশ্বর আমাদের এই ফল খেতে বারণ করেছেন।” শয়তান বলল, “ঈশ্বর তোমাদের এই ফল খেতে নিষেধ করেছেন, কারণ এই ফল খেলে তোমরা ঈশ্বরের মতো হয়ে যাবে।” হবা নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ঈশ্বরের সমান হওয়ার প্রলোভনে পড়ে গেলেন। স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা তিনি সেই ফল খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ও ফলটি খেলেন এবং আদমকে ও দিলেন। আদম তা নিয়ে খেলেন। এই ফল খাওয়ার পর আদম ও হবা বুঝতে পারলেন তাঁরা উলঙ্গ। তাই তাঁরা গাছের লতাপাতা দিয়ে একটি পোশাক তৈরি করে তাঁদের লজ্জা ঢাকলেন ।

ঈশ্বর তখন তাঁদের খোঁজ নেওয়ার জন্য বাগানে এলেন। ঈশ্বরের পায়ের শব্দ পেয়ে তাঁরা লুকিয়ে রইলেন। ঈশ্বর আদমকে নাম ধরে ডাকলেন। তিনি বললেন যে, তাঁরা ভয় পেয়ে লুকিয়ে আছেন। ঈশ্বর তখন বুঝতে পারলেন তাঁরা একটা অপরাধ করেছেন। তিনি আদমকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি তাঁদের যে ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন, তাঁরা তা খেয়েছে কি না। আদম বললেন, হবা তাঁকে সেই ফল দিয়েছেন, তাই তিনি খেয়েছেন। হবাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তিনি এমন কাজ করেছেন। হবা উত্তর দিলেন, সাপ তাঁকে প্রলোভন দেখিয়েছে, তাই তিনি ঐ ফল খেয়েছেন। এতে ঈশ্বর আদম, হবা ও সাপ সবার উপরই ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেন।

পাপের শাস্তি

আদম ও হবা জেনেশুনে, নিজের ইচ্ছায় ঈশ্বরের আদেশ অমান্য করেছেন। ঈশ্বর তাঁদের আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে এই ফল খেলে তাঁরা মরবেন। কাজেই তাঁদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা হলো। সাপ আদম ও হবাকে পাপে ফেলেছে বলে ঈশ্বর সাপকেও শাস্তি দিলেন।

সাপের শাস্তি: ঈশ্বর সাপকে বললেন, “তুমি এই কাজ করেছ বলে গৃহপালিত ও বন্য সব পশুর মধ্যে তুমি হবে সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত । তুমি বুকে ভর করে চলবে এবং সারা জীবন মাটি খেয়ে জীবনধারণ করবে। আমি তোমাতে ও নারীতে এবং তোমার বংশ ও নারীর বংশে পরস্পর শত্রুতা জন্মাব। সে তোমার মাথা চূর্ণ করবে এবং তুমি তার গোড়ালিতে ছোবল মারবে।”

হবার শাস্তি: হবাকে ঈশ্বর বললেন, “আমি তোমার গর্ভবেদনা ভীষণভাবে বাড়িয়ে তুলব। তুমি অনেক ব্যথার মধ্য দিয়ে সন্তান প্রসব করবে। স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকবে এবং সে তোমার ওপর কর্তৃত্ব করবে।”

আদমের শাস্তি: ঈশ্বর তাঁকে বললেন, “তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছ বলে তুমি অভিশপ্ত হয়েছ। সারা জীবন অনেক কষ্টে তুমি খাদ্য উৎপাদন করে জীবনধারণ করবে। তোমার ফসলে নানা রকম আগাছা জন্মাবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তুমি ফসল ফলাবে। তুমি ধূলি দিয়ে তৈরি, এই ধূলিতেই তোমাকে একদিন ফিরে যেতে হবে।”

আমাদের আদি পিতামাতাকে আগেই ঈশ্বর বলে দিয়েছিলেন ভালো-মন্দ জ্ঞানের গাছ থেকে ফল খেলে তাঁদের কী দশা হবে। শয়তানের প্রলোভনে পড়ে তাঁরা ঈশ্বরের কথা ভুলে গেলেন। তাঁদের নিজেদের পাপের কারণেই তাঁরা শাস্তি পেলেন। ঈশ্বর তাঁদের অন্যায়ভাবে কোনো শাস্তি দেন নি। এই শাস্তি তাঁরা পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। তাঁরা স্বর্গের এদেন বাগান থেকে বিতাড়িত হলেন।

 

প্রার্থনা

প্রিয় ঈশ্বর, তুমি পবিত্র। কিন্তু আমি অনেক দুর্বল। তাই আমিও অনেকবার পাপের প্রলোভনে পড়ে যাই ও তোমাকে দুঃখ দিই। আমি আমার সকল পাপের জন্য খুবই দুঃখিত। আমি তোমাকে আর কষ্ট দেব না, তোমাকে আর আঘাত করব না। হে প্রিয় ঈশ্বর, আমার প্রতি দয়া কর।

কী শিখলাম

স্বর্গের এদেন বাগানে আমাদের আদি পিতামাতা আদম ও হবা অত্যন্ত সুখে বাস করছিলেন। তাঁদের অবাধ্যতার কারণে তাঁরা সেই সুখের স্থান হারালেন ও শাস্তি পেলেন।

পরিকল্পিত কাজ

১। এদেন বাগানে আদম ও হবার সুখের জীবনের একটি ছবি আঁক । ২। কীভাবে প্রলোভন জয় করা যায় তার একটি তালিকা প্রস্তুত কর।

অনুশীলনী

১। শূন্যস্থান পূরণ কর

(ক) আদম অর্থ-------------।

(খ) সৃষ্টির মধ্যে মানুষ ছিল----------------বেশি উত্তম।

(গ) একমাত্র মানুষ ঈশ্বরের---------পেয়েছে।

(ঘ) ঈশ্বর-------নাম ধরে ডাকলেন ।

(ঙ) ঈশ্বর আদমকে বললেন, তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে ফল খেয়েছ বলে--------------হয়েছ।

 

৩। সঠিক উত্তরটিতে টিক (✓) চিহ্ন দাও

৩.১। ঈশ্বর আদি পিতামাতাকে কেমন ইচ্ছা দিয়েছিলেন? 

(ক) পরাধীন (খ) স্বাধীন (গ) পরার্থপর    (ঘ) স্বার্থপর

৩.২ আদি পিতামাতা কেমন স্থানে ছিলেন ?

(ক) দুঃখের (খ) কষ্টের (গ) আনন্দের (ঘ) সুখের

৩.৩ এদেন উদ্যানে কী ধরনের ফলের গাছ ছিল? 

(ক) টক            (খ) তেতো         (গ) সুমিষ্ট               (ঘ) নোনতা

৩.৪ আদি পিতামাতাকে কে পাপে ফেলেছে?

(ক) স্বর্গদূত (খ) মানুষ (গ) শয়তান (ঘ) ঈশ্বর

৩.৫ আদম ও হবা কার পাপের জন্য শাস্তি পেয়েছিলেন? 

(ক) অন্যদের (খ) বন্ধুদের (গ) প্রিয়জনদের (ঘ) নিজেদের

৪। সংক্ষেপে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

(ক) ঈশ্বরের পায়ের শব্দ পেয়ে আদম ও হবা লুকিয়েছিল কেন?

(খ) কে হবাকে প্রলোভন দিয়েছিল?

(গ) ঈশ্বর সাপকে কী খেয়ে জীবনধারণ করতে বলেছেন?

 

৫। নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও

(ক) ঈশ্বর আদমকে কী শাস্তি দিয়েছিলেন? 

(খ) আদি পিতামাতার সুখের স্থানটি কেমন ছিল?

Content added By

আরও দেখুন...

Promotion

Promotion