যেসব স্নায়ু মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ থেকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি হয়ে করোটিকার বিভিন্ন ছিদ্রপথে বেরিয়ে দেহের সেগুলোকে করোটিক স্নায়ু ( Cranial Nerves ) বলে। মানুষের মস্তিষ্কে বারো জোড়া করোটিক স্নায়ু আছে। সম্মুখ অংশ থেকে এদের রোমান সংখ্যা (I-XII) দিয়ে সূচিত করা হয়। জোড়া স্নায়ুর প্রতিটি প্রতিপাশের অনুরূপ অঙ্গে বিস্তার লাভ করে।
কাজের প্রকৃতিভেদে করোটিক স্নায়ুকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
ক. সংবেদী স্নায়ু (Sensory nerve) : যেসব স্নায়ু দেহের প্রান্তীয় অঙ্গাদী বা সংবেদী অঙ্গ থেকে স্নায়ু উদ্দীপনা বহন করে স্নায়ুতন্ত্রে নিয়ে যায় সেসব স্নায়ুকে সংবেদী স্নায়ু বলে। এ ধরনের স্নায়ু বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- অন্তর্বাহী, সংজ্ঞাবাহী, অনুভূতিবাহী ইত্যাদি।
খ. চেষ্টীয় স্নায়ু (Motor nerve) : কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র থেকে নির্দেশ বহন করে যেসব স্নায়ু নির্দিষ্ট অঙ্গে পৌছে দেয় সেগুলোকে চেষ্টীয় স্নায়ু বলে। এগুলো বহির্বাহী, আজ্ঞাবাহী ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
গ. মিশ্র স্নায়ু (Mixed nerve) : যেসব স্নায়ুর এক বা একাধিক গুচ্ছ সংবেদী স্নায়ু এবং এক বা একাধিক গুচ্ছ চেষ্টীয় স্নায়ু নিয়ে গঠিত সেসব স্নায়ুকে মিশ্র স্নায়ু বলে। এগুলো সংবেদী ও চেষ্টীয় উভয় প্রকার স্নায়ু উদ্দীপনা পরিবহন করে।
মানুষের করোটিক স্নায়ুসমূহের নাম, উৎস, শাখা, বিস্তার, প্রকৃতি ও কাজ (Name, Source, Branch, Extension, Nature and Function of Human Cranial Nerves)
ক্রমিক সংখ্যা স্নায়ুর নাম উৎস শাখা (যদি থাকে) বিস্তার প্রকৃতি কাজ
I. অলফ্যাক্টরি — অগ্রমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ(অলফ্যাক্টরি লোব)─ নাসিকার মিউকাস ঝিল্লি সংবেদী ঘ্রাণ অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছানো
II. অপটিক — অগ্রমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ (অপটিক লোব) ─ চোখের রেটিনা সংবেদী দর্শন অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌছানো
III. অকুলোমোটর — মধ্যমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ ─ অক্ষিগোলকের পেশি, উর্ধ্ব নেত্রপল্লব উত্তোলনকারী পেশি ও পিউপিল সংকোচনকারী চেষ্টীয় (motor) অক্ষি-গোলকের সঞ্চালন
IV. ট্রকলিয়ার— মধ্যমস্তিষ্কের পৃষ্ঠ-পার্শ্বদেশ ─ চোখের সুপিরিয়র অবলিক পেশি চেষ্টীয় অক্ষি-গোলকের সঞ্চালন
V. ট্রাইজেমিনাল— পনস-এর অগ্র-পার্শ্বদেশ অপথ্যালমিক— অক্ষিপল্লব, নাসিকার মিউকাস সংবেদী ম্যাক্সিলারি
ম্যাক্সিলারি —অক্ষিপল্লব, উর্ধ্ব ও নিম্নচোয়াল সংবেদী সংশ্লিষ্ট অঙ্গ থেকে সংবেদ মস্তিষ্কে প্রেরণ
ম্যান্ডিবুলার মুখবিবরের অঙ্কীয়দেশের পেশি মিশ্র (mixed) সংশ্লিষ্ট অঙ্গ সঞ্চালন এবং তাপ, চাপ ও স্পর্শ সংবেদ বহন
VI. অ্যাবডুসেন্স —পনস ও মেডুলার সংযোগস্থলের অঙ্কীয়দেশ ─ বহিঃরেক্টাস নামের চক্ষুপেশি চেষ্টীয় অক্ষিগোলকের সঞ্চালন
VII. ফ্যাসিয়াল —পনস ও মেডুলার সংযোগস্থলের পার্শ্বদেশ প্যালাটাইন মুখবিবরের ছাদ সংবেদী স্বাদ গ্রহণ
অকুলোমোটর মধ্যমস্তিষ্কের অঙ্কীয়দেশ হায়োম্যান্ডিবুলা মুখবিবর ও নিম্নচোয়াল মিশ্র চর্বন, গ্রীবা সঞ্চালন
VIII. ভেস্টিব্যুলোকক্লিয়ার বা অডিটরি —পনস ও মেডুলার সংযোগস্থলের পার্শ্বদেশ ─ অন্তঃকর্ণ সংবেদী শ্রবণ ও ভারসাম্য রক্ষা
IX. গ্লসোফ্যারিঞ্জিয়াল —মেডুলার পার্শ্বদেশ ─ জিহ্বা ও গলবিলের মিউকাস পর্দা মিশ্র স্বাদগ্রহণ, জিহ্বা ও গলবিলের সঞ্চালন
X. ভেগাস (নিউমোগ্যাস্ট্রিক)— মেডুলার পার্শ্বদেশ— ল্যারিঞ্জিয়াল স্বরযন্ত্র মিশ্র স্বরযতন্ত্রের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
কার্ডিয়াক —হৃৎপিন্ড— মিশ্র —হৃৎপিন্ডের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
গ্যাস্ট্রিক —পাকস্থলি —মিশ্র —পাকস্থলির কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
পালমোনারি —ফুসফুস— মিশ্র— ফুসফুসের কার্যকারিতা নিয়ন্ত্রণ
XI. স্পাইনাল অ্যাক্সেসরি— মেডুলার পার্শ্বদেশ ─ গলবিল, স্বরযন্ত্র, গ্রীবা ও কাঁধ চেষ্টীয় মাথা ও কাঁধের সঞ্চালন
XII. হাইপোগ্লোসাল —মেডুলার অঙ্কীয়দেশ ─ জিহ্বা ও গ্রীবা চেষ্টীয় জিহ্বার বিচলন
কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের পিছনের প্রলম্বিত অংশটি সুষুম্নাকাণ্ড । মেডুলা অবলংগাটার নিচের অংশ থেকে উদগত হয়ে এটি ফোরামেন ম্যাগনাম (foramen magnum) নামক করোটির পশ্চাৎভাগে অবস্থিত একটি বড় গোল ছিদ্রের মধ্য দিয়ে ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে মেরুদণ্ডের নিউরাল নালির মাধ্যমে পিছনে লাম্বার কশেরুকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। সুষুমাকাণ্ড মস্তিষ্কের মতো মেনিনজেস দিয়ে আবৃত থাকে। এর বাইরের আবরণকে ড্যুরা ম্যাটার এবং ভিতরের আবরণকে পায়া ম্যাটার বলে। উভয় পর্দার মাঝখানে তৃতীয় আরেকটি পর্দাকে অ্যারাকনয়েড ম্যাটার বক্সে মস্তিষ্কের মতো সুষুমাকাণ্ডের অভ্যন্তরেও গহ্বর আছে। মস্তিষ্কের গহ্বরকে ভেন্ট্রিকল বলা হলেও সুষুমাকাণ্ডের গহ্বরকে কেন্দ্রীয় নালি (central canal) বলা হয়। এ কেন্দ্রীয় নালির নিচের প্রান্তে একটু স্ফীত অংশ থাকে যা টারমিনাল ভেন্ট্রিকল নামে পরিচিত। গহ্বরের মধ্যে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড নামক তরল পদার্থ থাকে। কেন্দ্রীয় নালির চারদিকে নিউরনের কোষদেহ, ডেনড্রাইট এবং সিন্যাপসে গঠিত ইংরেজি ‘H’ আকৃতির বা প্রজাপতি আকৃতির গ্রে ম্যাটার (grey mater) অঞ্চল অবস্থিত । বস্তুত স্নায়ুকোষ দিয়ে গঠিত হওয়ায় এমন ধূসর বর্ণের হয়। গ্রে ম্যাটার অঞ্চল হোয়াইট ম্যাটার (white matter) অঞ্চল দিয়ে পরিবেষ্টিত থাকে। বাইরের হোয়াইট ম্যাটার স্তরে কোন কোষবস্তু নেই, শুধু স্নায়ুসূত্র (অ্যাক্সন) রয়েছে। সুষুমাকাণ্ড থেকে ৩১ জোড়া সুষুম্নাস্নায়ু (spinal nerves) উৎপন্ন হয়। পৃষ্ঠীয় মূল প্রত্যেক স্নায়ুর দুটি করে মূল থাকে, যথা- পৃষ্ঠীয় মূল (dorsal root) এবং অঙ্কীয় মূল (ventral root)। পৃষ্ঠীয় মূলে পৃষ্ঠীয় মূল গ্যাংগ্লিয়া (dorsal root ganglia) থাকে যা সংবেদী নিউরনের সংবেদী নিউরনের কোষদেহ নিয়ে গঠিত।
কাজ :
* সুষুমাকান্ড সরল স্পাইনাল প্রতিবর্ত (simple spinal reflex) সমূহের সমন্বয় কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, যেমন- হাঁটু ঝাঁকুনি প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি।
* মূত্রথলির সংকোচনের মতো স্বয়ংক্রিয় প্রতিবর্ত সুষুমাকাণ্ডের সাহায্যে এত হয়।
* সুষুমা স্নায়ু ও মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে সুষুমাকাণ্ড।
Read more