সবুজ উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এরা সূর্যালোকের উপস্থিতিতে CO, ও পানি থেকে কার্বোহাইড্রেট জা প্রস্তুত করতে পারে। উদ্ভিদে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত হওয়ার এ প্রক্রিয়ার নাম সালোকসংশ্লেষণ (Photosynt গ্রিক Photo = আলো + synthesis = সংশ্লেষ)। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বার্নেস (Charles Reid Bames, 1858- Photosynthesis শব্দের প্রচলন করেন।
যে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদকোষে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলের সাহায্যে পরিবেশ চ শোষিত পানি ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সরল শর্করা (গ্লুকোজ) সংশ্লেষিত হয় এবং সৌরশক্তির আবদ্ধকরণ ঘটে তাকে সালোকসংশ্লেষণ বলে। এ প্রক্রিয়ায় উপজাত হিসেবে O2 নির্গত হয়।
সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ১ অণু হেক্সোজ শর্করা প্রস্তুত করতে ৬ অণু CO ১২ অণু HO প্রয়োজন পড়ে এ ৫০-৬০ ফোটন কণা ব্যবহৃত হয়। এছাড়া সালোকসংশ্লেষণকে একটি জটিল জারণ-বিজারণ প্রক্রিয়া বলা হয়।
আলোর উপস্থিতিতে পানি (H2O) ভেঙ্গে অক্সিজেন (O2), হাইড্রোজেন বা প্রোটন (2H) ও ইলেকট্রন উৎপন্ন হওয়াকে পানির সালোকবিভাজন (phorolysis of water) বলে।
সালোকসংশ্লেষণের অঙ্গ (Photosynthetic Organs) ক্লোরোফিলযুক্ত সকল উদ্ভিদকোষে সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। সালোকসংশ্লেষণকারী ব্যাকটেরিয়া, শৈবাল ও এককোষী সবুজ শৈবালের সম্পূর্ণ কোষদেহ সালোকসংশ্লেষণে অংশ গ্রহণ করে। উন্নত উদ্ভিদে। মেসোফিল টিস্যুর প্যালিসেড ও স্পঞ্জি প্যারেনকাইমা কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট অধিক সংখ্যায় থাকে। তাই এই আশে সংব সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। পাতা ছাড়া কচি কান্ড, সবুজ কান্ড, ফুলের বৃন্ত, বৃত্তি, অর্কিডের সবুজ মূল, কাঁচা সংস্থার সালোকসংশ্লেষণ ঘটে। ব্যাকটেরিয়া, নীলাভ সবুজ শৈবালে কোন ক্লোরোপ্লাস্টিড থাকেনা, এদের মধ্যে chromatophore নামে সরল অঙ্গাণু থাকে যাতে রঞ্জক পদার্থ বিদ্যমান। ক্রোমাটোফোর এদের সালোকসংশ্লেন অঙ্গাণু। উন্নত উদ্ভিদের ক্ষেত্রে ক্লোরোপ্লাস্ট-কে সালোকসংশ্লেষণকারী অঙ্গাণু বলা হয়। ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমা অংশে সালোকসংশ্লেষণের অন্ধকার বিক্রিয়াগুলো ঘটে এবং গ্রানা (grana)-র থাইলাকয়েড পর্দার ভিতর ক্ষুদ্র মতো অংশ- কোয়াস্টোজোম (quantosome)-এ আলোক বিক্রিয়াগুলো সংঘটিত হয়। কোয়ান্টোজোমের মধ্যে ২৫০টি ক্লোরোফিল অণু, এনজাইম ও একাধিক ইলেকট্রন বাহক এবং অন্যান্য রঞ্জক থাকে।
সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জক (Photosynthetic Pigments )
সালোকসংশ্লেষণকারী রঞ্জকগুলো প্রধানত নিচেবর্ণিত তিন প্রকারের-
i. ক্লোরোফিল (Chlorophyll)
ক্লোরোফিল-a,ক্লোরোফিল-b
ii. ক্যারোটিনয়েড (Carotinoids)
ক্যারোটিন,জ্যান্থোফিল
iii. ফাইকোবিলিন
ফাইকোএরিথ্রিন,ফাইকোসায়ানিন
ফটোসিস্টেম : ক্লোরোফিল অণুসমূহ এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট ইলেক্ট্রন গ্রহীতাগুলো এক সাথে একটি ইউনিট হিসেবে অবস্থান করে। এই ইউনিটকে ফটোসিস্টেম বলে। ফটোসিস্টেম থাইলাকয়েড ঝিল্লিতে অবস্থান করে এবং এতে ৪০০ পর্যন্ত ক্লোরোফিল অণু থাকতে পারে।
১. ফটোসিস্টেম-1 (PS-I) : এতে ch'a' ৬৮৩, ক্যারোটিন, জ্যান্থোফিল এবং P700 নামক একটি বিআরিত পিগমেন্ট (reactive pigment = এক বিশেষ ধরনের ক্লোরোফিল-এ) থাকে যা ৭০০ nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকরশি সর্বাধিক শোষণ করে, তাই একে বলা হয় P700 PS-I ক্লোরোপ্লাস্টের গ্রানা ল্যামেলীর বাইরের দিকে অবস্থিত এবং NADPH গঠনে সাহায্য করে।
২. ফটোসিস্টেম-II (PS-II) ; এতে ch'a' ৬৭৩, ch'b' এবং P680 নামক রিঅ্যাক্টিভ পিগমেন্ট (এটিও বিশেষ ধরনের ক্লোরোফিল-এ) থাকে যা ৬৮০nm তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাল আলোকরশ্মি সর্বাধিক শোষণ করে, তাই একে বলা হয় P680. PS-II ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতরে স্ট্রোমার দিকে অবস্থিত এবং NADPH গঠনে সাহায্য করে। উপরোক্ত দুটি ফটোসিস্টেম ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেইন দিয়ে যুক্ত থাকে।
থাইলাকয়েড ইলেক্ট্রন ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম বা TETS এর মধ্যে নিম্নোক্ত বাহক উপস্থিত থাকে। এদের পর্যায়ক্রম হচ্ছে : -
১. ফিয়োফাইটিন (Pheophytin, Ph) : একটি রূপান্তরিত ক্লোরোফিল অণু। পরবর্তী বাহক প্লাস্টোকুইনোনের এটি সংযোগ সৃষ্টি করে।
২. প্লাস্টোকুইনোন (Plastoquinone. PQ) : লিপিড জাতীয় উপাদান যা প্রথম ইলেক্ট্রন বাহক হিসেবে সক্রিয় থেকে সাইটোক্রোমের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করে।
৩. সাইটোক্রোম (Cytochrome, Cyt): লৌহযুক্ত প্রোটিন যার লৌহ অণুটি ইলেক্ট্রন গ্রহণ করে। এখানে সাইটোক্রোমটি bgf প্রকৃতির এক যৌগ (Cytbgf)। সাইটোক্রোম পরবর্তীতে গৃহীত ইলেকট্রনটিকে হস্তান্তরের জন প্লাস্টোসায়ানিনের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করে।
৪. প্লাস্টোসায়ানিন (Plastocyanin, PC) : এক ধরনের প্রোটিন; এর মধ্যে রয়েছে একটি কপার অণু যা ইলেকট্রন গ্রহণ করে এবং ফেরিডক্সিনের কাছে হস্তান্তর করে।
৫. ফেরিডক্সিন (Ferredoxin, Fd) লোহা ও সালফার অণুযুক্ত প্রোটিন যার লোহা ইলেক্ট্রন গ্রহণ ও স্থানান্তর করে।
৬. NADP রিডাক্টেজ (NADP-reductase) : এটি এক ধরনের ফ্লাভোপ্রোটিন যা এক প্রকার সংযুক্ত কো- এনজাইম FAD (ফ্লাভিন অ্যাডিনিন ডাইনিউক্লিওটাইড) এর ফ্লাভিন গ্রুপ ইলেকট্রন গ্রহীতা।
১৯০৫ সালে ইংরেজ শরীরতত্ত্ববিদ ব্ল্যাকম্যান সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াকে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন। সালোকসংশ্লেষণের পর্যায় দুটি হলো, আলোক পর্যায় (Light dependent phase) এবং অন্ধকার পর্যায় (Light independent phase)।
আলোকনির্ভর পর্যায়
সালোকসংশ্লেষণের আলোকনির্ভর পর্যায়ের জন্য আলো অপরিহার্য। এ পর্যায়ে সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় ATP (অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট), NADPH (বিজরিত নিকোটিনামাইড অ্যাডনিন ডাইনিউক্লিওটাইড ফসফেট) এবং H+ (হাইড্রোজেন আয়ন বা প্রোটন) উৎপন্ন হয়। এই রুপান্তরিত শক্তি ATP- এর মধ্যে সঞ্চিত হয়। এই বিক্রিয়ায় ক্লোরোফিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্লোরোফিল অণু আলোকরশ্মির ফোটন শোষণ করে এবং শোষণকৃত ফোটন থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ADP (অ্যাডিনোসিন ডাইফসফেট) অজৈব ফসফেটের সাথে মিলিত হয়ে ATP তৈরি করে। ATP তৈরির এই প্রক্রিয়াকে ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
সূর্যালোক এবং ক্লোরোফিলের সাহায্যে পানি বিয়োজিত হয়ে অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ও ইলেকট্রন উৎপন্ন হয়। এ প্রক্রিয়াকে পানির ফটোলাইসিস বলা হয়।
আরনন (Arnon) ও তাঁর সহকর্মীবৃন্দ ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ফটোফসফোরাইলেশন সম্বন্ধে ধারণা দেন। সালোকসংশ্লেষণের সময় দুধরনের ফটোফসফোরাইলেশন পরিলক্ষিত হয় । যথা : অচক্রীয় এবং চক্রীয় ।
ক. অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন (Noncyclic Photophosphorylation)
যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় ক্লোরোফিল অণু থেকে উৎক্ষিপ্ত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার পর NADP-এর সাথে যুক্ত হয়, কিন্তু ইলেকট্রন যে ক্লোরোফিল থেকে নির্গত হয়েছিল সেই ক্লোরোফিলে পুনরায় ফিরে যায় না তাকে অচক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলা হয়।
খ. চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন (Cyclic Photophosphorylation) যে ফটোফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়ায় আলোকশক্তি শোষণের ফলে উদ্দীপ্ত ক্লোরোফিল অণু থেকে নির্গত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন ইলেকট্রন বিভিন্ন বাহকের মাধ্যমে নিস্তেজ অবস্থায় পুনরায় ঐ ক্লোরোফিল অণুতে ফিরে আসে এবং একবার পরিভ্রমণ শেষে একটি ATP অণু তৈরি করে, তাকে চক্রীয় ফটোফসফোরাইলেশন বলে।
আলোক নিরপেক্ষ বা অন্ধকার পর্যায়
সালোকসংশ্লেষণের আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়ে আলোর প্রত্যক্ষ প্রয়োজন পড়ে না। তবে আলোর উপস্থিতিতেও এই প্রক্রিয়া চলতে পারে। বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই-অক্সাইড পত্ররন্ধ্রের মধ্য দিয়ে কোষে প্রবেশ করে। আলোক পর্যায়ে তৈরি ATP, NADPH এবং H+ এর সাহায্যে আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বিজরিত হয়ে কার্বোহাইড্রেটে পরিণত হয়। সবুজ উদ্ভিদে কার্বন ডাই-অক্সাইড বিজারণের তিনটি গতিপথ শনাক্ত করা হয়েছে। যথা- ক্যালভিন চক্র, হ্যাচ ও স্ল্যাক চক্র এবং ক্রেসুলেসিয়ান এসিড বিপাক।
Read more