নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - রসায়ন - রসায়ন ও শক্তি | NCTB BOOK

রাসায়নিক শক্তির উৎস
আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে, পদার্থের মধ্যে অণু ও পরমাণু থাকে। একটি পরমাণু আরেকটি পরমাণুর সাথে আকর্ষণ শক্তির (বন্ধন শক্তি) মাধ্যমে যুক্ত থাকে। আবার, একটি অণু অন্য অণুর সাথেও আকর্ষণ শক্তির (আন্তঃআণবিক শক্তি) সাহায্যে যুক্ত থাকে। এ শক্তিগুলোকে বলা হয় রাসায়নিক শক্তি। তোমরা এই অধ্যায়ে এসব রাসায়নিক শক্তি সম্পর্কে জানবে।
 

বন্ধন শক্তি (Bond Energy)
বন্ধনে আবদ্ধ একটি পরমাণুর সাথে আরেকটি পরমাণু যে আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকে বন্ধন শক্তি বলে। সোডিয়াম ক্লোরাইডে সোডিয়াম আয়ন ও ক্লোরাইড আয়নের মধ্যে আয়নিক বন্ধন বিদ্যমান। কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুতে কার্বন ও অক্সিজেনের মধ্যে সমযোজী বন্ধন বিদ্যমান। আবার, লোহার মধ্যে একটি আয়রন পরমাণুর সাথে অন্য আয়রন পরমাণুসমূহের মধ্যে ধাতব বন্ধন বিদ্যমান। এ সকল বন্ধনে আবদ্ধ একটি পরমাণুর সাথে আরেকটি পরমাণু যে আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকে বন্ধন শক্তি বলে।
 

আন্তঃআণবিক শক্তি
সমযোজী যৌগের অণুসমূহ একে অপরের সাথে যে আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে তাকে আন্তঃআণবিক শক্তি (Intermolecular Energy) বলা হয়। যেমন: পানি একটি সমযোজী যৌগ। একটি পানির অণুর সাথে আশপাশের অন্যান্য পানির অণুসমূহ আন্তঃআণবিক আকর্ষণ শক্তির মাধ্যমে যুক্ত থাকে।
অন্যদিকে সোডিয়াম ক্লোরাইডের আয়নিক যৌগে একটি সোডিয়াম আয়নের চারদিকে 6টি ক্লোরাইড আয়ন অবস্থান করে। এখানে একটি সোডিয়াম ও 6টি ক্লোরাইড আয়নের মধ্যে আকর্ষণ বিদ্যমান থাকে। আবার প্রত্যেকটি ক্লোরাইড আয়নের চারদিকে চটি সোডিয়াম আয়ন অবস্থান করে। এখানে প্রত্যেকটি ক্লোরাইড আয়ন ও 6টি সোডিয়াম আয়নের মধ্যে আকর্ষণ বিদ্যমান থাকে।
 

আয়নিক যৌগে আয়নসমূহের মধ্যে যে আকর্ষণ শক্তি থাকে ঐ আকর্ষণ শক্তি সমযোজী অণুর আন্তঃআণবিক শক্তির চেয়ে বেশি। এজন্য আয়নিক পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক সমযোজী পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক অপেক্ষা বেশি।

এজন্য আয়নিক যৌগসমূহ সাধারণত কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে আর সমযোজী যৌগসমূহ সাধারণত কক্ষ তাপমাত্রায় তরল বা বায়বীয় অবস্থায় থাকে। তবে অনেক সমযোজী যৌগ আছে যেগুলো কক্ষ তাপমাত্রায় কঠিন অবস্থায় থাকে। যেমন: ন্যাপথলিন।
একই পরমাণু দিয়ে উৎপন্ন সমযোজী অণুসমূহের (যেমন— H2) আন্তঃআণবিক শক্তির চেয়ে দুইটি ভিন্ন পরমাণু দিয়ে গঠিত অণুর (যেমন HCl) আন্তঃআণবিক শক্তি বেশি হয়।
 

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির রূপান্তর
প্রত্যেক পদার্থের মধ্যে কিছু শক্তি বিদ্যমান থাকে। সাধারণত কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহের শক্তি দিয়ে বিক্রিয়া ঘটাতে হয় অথবা কোনো কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটার ফলে শক্তি উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় শক্তির রূপান্তর ঘটে। বিক্রিয়া ঘটাতে যে শক্তি দিতে হয় বা বিক্রিয়া ঘটার ফলে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার বিভিন্ন রূপ হতে পারে। যেমন— তাপশক্তি, আলোক শক্তি, বিদ্যুৎ শক্তি, শব্দ শক্তি ইত্যাদি।
 

শক্তি পরিমাপের একক
পূর্বে শক্তি মাপার জন্য ক্যালরি (Calorie) বা কিলো ক্যালরি (kilo Calorie) একক ব্যবহার করা হতো। 1 গ্রাম পানির তাপমাত্রা 1°C বাড়াতে যে পরিমাণ তাপশক্তি প্রদান করতে হয় তাকে এক ক্যালরি (সংক্ষেপে Cal) বলে। 1 হাজার ক্যালরিকে 1 কিলো ক্যালরি বলে। কিলো ক্যালরিকে সংক্ষেপে kcal দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
 

বর্তমানে সকল ধরনের শক্তির একক হিসেবে জুল (Joule) কে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো বস্তুর উপর 1 নিউটন বল প্রয়োগ করলে যদি বলের দিকে 1 মিটার সরণ ঘটে তবে তার জন্য প্রয়োজনীয় কাজকে 1 জুল বলে। একে সংক্ষেপে J দিয়ে প্রকাশ করা হয়। 1 হাজার জুলকে 1 কিলোজুল (kJ) বলে।
 

জুল ও ক্যালোরির সম্পর্ক হচ্ছে: 1 Cal = 4.18 J
 

তাপের পরিবর্তনের ভিত্তিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার শ্রেণিবিভাগ
কখনো কখনো বিক্রিয়ক পদার্থে বাইরে থেকে তাপ দিয়ে বিক্রিয়া ঘটিয়ে উৎপাদে পরিণত করা হয়। আবার, কখনো কখনো বিক্রিয়ক পদার্থ নিজে নিজে উৎপাদে পরিণত হয় এবং উৎপাদে পরিণত হবার সময়ে তাপ উৎপন্ন হয়। তাপের পরিবর্তনের ভিত্তিতে রাসায়নিক বিক্রিয়া দুই ধরনের। (i) তাপোৎপাদী বিক্রিয়া (ii) তাপহারী বিক্রিয়া। তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ঋণাত্মক (negative) এবং তাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ধনাত্মক (positive)।

কোনো একটি পদার্থ একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি ধারণ করে। এই শক্তিকে অভ্যন্তরীণ শক্তি বলে। যেকোনো বিক্রিয়ার বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তিকে E দ্বারা এবং উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তিকে E2 দ্বারা চিহ্নিত করা হলে ঐ বিক্রিয়ার তাপ শক্তির পরিবর্তন 

∇H = উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি (E2) – বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি (E)

 

তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E1 উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E2 থেকে বেশি। কাজেই এ বিক্রিয়াতে বিক্রিয়ায় ভাগ শক্তির পরিবর্তন ∇H = E2 - E1 এর মান ঋণাত্মক।

যেমন: কোনো বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 50 kJ/mol এবং উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 20 kJ/mol হলে

 ∇H = (20 50) kJ/mol --30 kJ/mol

আবার, তাপহারী বিক্রিয়ায় ক্ষেত্রে বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E1 উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি E2 থেকে কম। কাজেই এ বিক্রিয়াতে বিক্রিয়ায় তাপ শক্তির পরিবর্তন ∇H = E2 - E1 এর মান ধনাত্মক।
 

যেমন: কোনো বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 70 kJ/mol এবং উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি 80 kJ/mol হলে 

∇H = (80 - 70 ) kJ/mol = +10kJ/mol

 

তাপোৎপাদী বিক্রিয়া (Exothermic Reactions ) 

যে বিক্রিয়ার ফলে তাপ উৎপন্ন হয় তাকে তাপোৎপাদী বিক্রিয়া বলা হয়। তাপোৎপাদী বিক্রিয়ার সমীকরণ লেখার সময় বিক্রিয়ার ডান পাশে তাপ লেখা যেতে পারে কিংবা ∇H দিয়ে প্রকাশ করা হলে ∇H এর মান ঋণাত্মক হতে হবে। তোমরা দেখেছো, কোনো কিছু রান্না করতে চুলাতে জ্বালানি হিসেবে যে গ্যাস ব্যবহার করি তা পোড়ালে তাপ উৎপন্ন হয়। আবার শুকনা চুলে পানি ঢাললে তা গরম হরে ওঠে। রান্নার গ্যাসের প্রধান উপাদান হলো মিথেন (CH4)। এ গ্যাস পোড়ালে প্রতি 1 মোল মিথেন গ্যাস বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন ডাই-অক্সাইড আর পানি উৎপন্ন হয়। সেই সাথে 890 kJ তাপও উৎপন্ন হয়।

তাপহারী বিক্রিয়া (Endothermic Reactions)
তাপ প্রদান করে যে বিক্রিয়া ঘটানো হয় সেই বিক্রিয়াকে তাপহারী বিক্রিয়া বলা হয়। তাপহারী বিক্রিয়াকে তাপশোষী বিক্রিয়াও বলা হয়। তাপহারী বিক্রিয়ার সমীকরণ লেখার সময় বিক্রিয়ার ৰাম পাশে তাপ লেখা যেতে পারে। কিন্তু ∇H দিয়ে লিখলে ∇H এর যান ধনাত্মক হতে হবে। গ্রামে শামুক বা ঝিনুকের খোলস থেকে চুন তৈরি করা হয়। অনেকগুলো শামুক বা ঝিনুকের খোলস একসাথে জড়ো করে জ্বালানি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেগুলোকে উত্তপ্ত করা হয়। এতে খোলসগুলো থেকে চুন তৈরি হয়। আসলে ঝিনুক বা শামুকের খোলসগুলোতে প্রায় 98% ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3) থাকে। আগুনের তাপে এ ক্যালসিয়াম কার্বনেট ভেঙে গিয়ে ক্যালসিয়াম অক্সাইড এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। ক্যালসিয়াম অক্সাইড হচ্ছে চুন, সেটি পড়ে থাকে—কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসের সাথে মিশে যায়।

 

বন্ধন শক্তি হিসাব করে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তনের হিসাব

রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাপের পরিবর্তন H এর মান দুইভাবে হিসাব করা হয়। যদি অভ্যন্তরীণ শক্তি ব্যবহার করি তবে উৎপাদসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি থেকে বিক্রিয়কসমূহের মোট অভ্যন্তরীণ শক্তি বাদ দিয়ে ∇H এর মান হিসাব করা হয়। আর যদি বন্ধন শক্তি ব্যবহার করি তবে বিক্রিয়কসমূহের মোট বন্ধন শক্তি থেকে উৎপাদসমূহের মোট বন্ধন শক্তি বাদ দিয়ে ∇H এর মান হিসাব করা হয়। এই দুইভাবে হিসাব করলেও কোনো বিক্রিয়ার ∇H এর মান একই হয়।
কোনো যৌগের যেকোনো দুইটি পরমাণুর মধ্যকার বন্ধন ভেঙে পরমাণু দুটিকে আলাদা করতে যে শক্তি দিতে হয় তাকে বন্ধন শক্তি বলে। আবার কোনো যৌগের যেকোনো দুইটি পরমাণুর মধ্যে বন্ধন তৈরি হতে যে শক্তি নির্গত হয় তাকে বন্ধন শক্তি বলে।
 

রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সময় বিক্রিয়কগুলোর মধ্যে যে বন্ধনগুলো আছে সেই বন্ধনগুলো ভেঙে যায় এবং উৎপাদগুলোর মধ্যে নতুন নতুন বন্ধন তৈরি হয়। বিক্রিয়কগুলোর বন্ধন ভাঙার জন্য শক্তি দিতে হয় এবং উৎপাদগুলোর বন্ধন তৈরি হতে শক্তি নির্গত হয়।
 

যেকোনো বিক্রিয়ায় বিক্রিয়কগুলোর মোট বন্ধন শক্তিকে B1 দিয়ে এবং উৎপাদসমূহের মোট বন্ধন শক্তিকে B2 দিয়ে চিহ্নিত করা হলে ঐ বিক্রিয়ার তাপ শক্তির পরিবর্তন:

∇H = বিক্রিয়কগুলোর মোট বন্ধন শক্তি B1 – উৎপাদগুলোর মোট বন্ধন শক্তি B2   =   (বিক্রিয়কগুলোর বন্ধন ভাঙার জন্য দেওয়া মোট শক্তি B1 ) . (উৎপাদনগুলোর বন্ধন তৈরি হওয়ার জন্য নির্গত হওয়া মোট শক্তি B2 )

 

তাপ উৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে B1 এর মান B2 থেকে কম এজন্য তাপ উৎপাদী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ঋণাত্মক। অন্যদিকে তাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে B1 এর মান B2 থেকে বেশি এজন্য ভাপহারী বিক্রিয়ার ক্ষেত্রে ∇H এর মান ধনাত্মক।

Content added || updated By