নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - রসায়ন - রসায়ন ও শক্তি | NCTB BOOK

তড়িৎ রাসায়নিক কোষ (Electrochemical cell)
জ্বালানি পুড়িয়ে রাসায়নিক শক্তিকে তাপশক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। এই তাপশক্তিকে আবার বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত করা যায়। এবার আমরা জানব কীভাবে রাসায়নিক শক্তিকে সরাসরি বিদ্যুৎ শক্তিতে এবং বিদ্যুৎ শক্তিকে ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায়। যে যন্ত্রের সাহায্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে রাসায়নিক শক্তিকে সরাসরি বিদ্যুৎ শক্তিতে অথবা বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয় তাকে তড়িৎ রাসায়নিক কোষ বলে। তড়িৎ রাসায়নিক কোষে একই বা দুইটি ভিন্ন তড়িৎ বিশ্লেষ্যের দ্রবণে দুইটি ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ডই আংশিক ডুবানো থাকে। অতঃপর দণ্ড দুটিকে একটি ধাতব তার দিয়ে সরাসরি বা ব্যাটারির মাধ্যমে সংযোগ দেওয়া হয়। কোষের মধ্যে ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ডকে তড়িৎদ্বার বা ইলেকট্রোড (Electrode) বলা হয়।
তড়িৎ রাসায়নিক কোষ দুই প্রকার।
 

(i) তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ (Electrolytic Cell): যে কোষে বাইরের কোনো উৎস থেকে তড়িৎ প্রবাহিত করে কোষের মধ্যে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো যায় সেই কোষকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ বলে।
(ii) গ্যালভানিক কোষ (Gavlanic Cell): যে কোষে রাসায়নিক পদার্থসমূহ বিক্রিয়া করে বিদ্যুৎ শক্তি
উৎপাদন করে সেই কোষকে গ্যালভানিক কোষ বলা হয়।
 

বিদ্যুৎ পরিবাহী: (Conductor)
যে সকল পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে তাদেরকে বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ বলে। যেমন— ধাতু, গ্রাফাইট, গলিত লবণ, লবণের দ্রবণ, এসিড ও ক্ষারের দ্রবণ প্রভৃতি বিদ্যুৎ পরিবাহীর উদাহরণ। বিদ্যুৎ পরিবহনের কৌশলের উপর নির্ভর করে বিদ্যুৎ পরিবাহী দুই প্রকার হতে পারে। যথা: (i) ইলেকট্রনীয় পরিবাহী এবং (ii) তড়িৎ বিশ্লেষ্য।
 

ইলেকট্রনীয় পরিবাহী (Electronic Conductor)
যেসব পদার্থের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয় সেসব পরিবাহীকে ইলেকট্রনীয় পরিবাহী বলে। তোমরা দেখেছো ধাতুর মধ্যে ধাতব বন্ধন বিদ্যমান। এখানে প্রচুর পরিমাণে মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। গ্রাফাইটেও মুক্ত ইলেকট্রন থাকে। এ সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে ইলেকট্রন মাধ্যমে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়। সকল পরিবাহীকে ইলেকট্রনীয় পরিবাহী বলে। যেমন- লোহা (Fe), কপার (Cu), নিকেল (Ni), গ্রাফাইট ইত্যাদি ইলেকট্রনীয় পরিবাহী।

তড়িৎ বিশ্লেষ্য (Electrolyte)
যেসব পদার্থ কঠিন অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে না কিন্তু গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে এবং বিদ্যুৎ পরিবহনের সাথে সাথে ঐ পদার্থের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটায় তাদেরকে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বলে। তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় আয়নিত অবস্থায় থাকে। এই আয়নের মাধ্যমে তড়িৎ বিশ্লেষ্য পদার্থ বিদ্যুৎ পরিবহন করে। আয়নিক যৌগ এবং কিছু পোলার সমযোজী যৌগ গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় তড়িৎ বিশ্লেষ্য পরিবাহী হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), কপার সালফেট (CuSO4), সালফিউরিক এসিড (H2SO4), পানি (H2O), ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) ইত্যাদি গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় বিদ্যুৎ পরিবহন করে।
 

তড়িৎ বিশ্লেষ্য আবার দুই প্রকার
(i) তীব্র তড়িৎ বিশ্লেষ্য (Strong Electrolyte): যে সকল তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণে বা গলিত অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে আয়নিত অবস্থায় থাকে তাদেরকে তীব্র তড়িৎ বিশ্লেষ্য বলে। যেমন—সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), কপার সালফেট (CuSO4), সালফিউরিক এসিড (H2SO4) ইত্যাদি।
(ii) মৃদু তড়িৎ বিশ্লেষ্য (Weak Electrolyte): যে সকল তড়িৎ বিশ্লেষ্য দ্রবণে খুব অল্প পরিমাণে আয়নিত অবস্থায় থাকে তাদেরকে মৃদু তড়িৎ বিশ্লেষ্য বলে। যেমন: পানি (H2O), ইথানয়িক এসিড (CH3COOH) ইত্যাদি।
 

তড়িৎদ্বার (Electrode)
তড়িৎ রাসায়নিক কোষে বিগলিত বা দ্রবীভূত তড়িৎ বিশ্লেষ্যের মধ্যে যে দুটি ইলেকট্রনীয় পরিবাহী অর্থাৎ ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ড প্রবেশ করানো হয় তাদেরকে তড়িৎদ্বার বলা হয়। তড়িৎ রাসায়নিক কোষে একটি তড়িৎদ্বারে কোনো পরমাণু বা আয়ন ইলেকট্রন ত্যাগ করে। অর্থাৎ এ তড়িৎদ্বারে জারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। অপর তড়িৎদ্বার থেকে ধনাত্মক আয়ন ইলেকট্রন গ্রহণ করে। অর্থাৎ এ তড়িৎদ্বারে বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয় এবং সম্পূর্ণ কোষের মধ্যে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। যে তড়িৎদ্বারে জারণ বিক্রিয়া ঘটে তাকে অ্যানোড তড়িৎদ্বার আর যে তড়িৎদ্বারে বিজারণ বিক্রিয়া ঘটে তাকে ক্যাথোড তড়িৎদ্বার বলে।
 

 তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ, তড়িৎ বিশ্লেষণ ও তড়িৎ বিশ্লেষণের কৌশল
তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষে (Electrolytic cell) বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটানো হয়। গলিত বা দ্রবীভূত অবস্থায় তড়িৎ বিশ্লেষ্যের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহনের সময় উক্ত তড়িৎ বিশ্লেষ্যের যে রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয় তাকে তড়িৎ বিশ্লেষণ (Electrolysis) বলা হয়।

যেমন—গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করলে অ্যানোডে ক্লোরিন গ্যাস আর ক্যাথোডে সোডিয়াম ধাতু উৎপন্ন হওয়াই সোডিয়াম ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া:
 

2NaCl(1)      2Na (s) + Cl2 (g)
 

গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণের কৌশল

একটি কাচ বা চিনামাটির পাত্রে গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইড নেওয়া হয়। গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের মধ্যে সোডিয়াম আয়ন (Na+) ও ক্লোরাইড (Cl-) আয়ন থাকে। সোডিয়াম আয়ন ও ক্লোরাইড আয়ন চলাচল ( migrate) করতে পারে। গলিত সোডিয়াম ক্লোরাইডের মধ্যে দুটি ধাতব দণ্ড বা গ্রাফাইট দণ্ড প্রবেশ করানো হয়। এ দণ্ড দুটির একটিকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তে এবং অপরটিকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করলে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত ধনাত্মক তড়িৎদ্বার বা অ্যানোড ঋণাত্মক আধান যুক্ত Cl- আরনকে আকর্ষণ করবে, অন্যদিকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত ঋণাত্মক তড়িৎদ্বার বা ক্যাথোড ধনাত্মক আধানযুক্ত Na+ আয়নকে আকর্ষণ করবে। Cl- আয়ন অ্যানোডে ইলেকট্রন ত্যাগ করে ক্লোরিন গ্যাসে পরিণত হয়।

 

লিটমাস পেপারের সাহায্যে অানোডের ক্লোরিন গ্যাস শনাক্তকরণ 

গলিত NaCl এর তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় অ্যানোডে উৎপন্ন গ্যাস একটি টেস্টটিউবে সংগ্রহ করে তার মুখে ভিজা নীল লিটমাস পেপার ধরলে লিটমাস পেপারের বর্ণ লাল বর্ণে পরিণত হবে এবং ক্লোরিন গ্যাসের উপস্থিতি প্রমাণ করবে।

 

কোনো দ্রবণে একের অধিক প্রকারের ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন উপস্থিত থাকলে ক্যাথোডে কোন ক্যাটায়ন আগে গিয়ে চার্জযুক্ত হবে বা অ্যানোডে কোন অ্যানায়ন আগে গিয়ে চার্জযুক্ত হবে তা তিনটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন:

(1) ক্যাটায়ন বা অ্যানায়নের চার্জযুক্ত হওয়ার প্রবণতা 

তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় দ্রবণে একের অধিক প্রকার ক্যাটায়ন থাকলে ক্যাটায়নসমূহের মধ্যে কোনটি আগে ক্যাথোডে পিয়ে ইলেকট্রন গ্রহণ করে চার্জযুক্ত হবে, কোনটি পরে ইলেকট্রন গ্রহণ করে চার্জযুক্ত হবে তার উপর ভিত্তি করে ক্যাটায়নসমূহকে
 

একটি সারণিতে সাজানো হয়েছে। এই সারণিকে ধাতুর সক্রিয়তা সিরিজ বা ধাতুর তড়িৎ রাসায়নিক সারি বলা হয়। এই সারির যেকোনো দুটি মৌলের মধ্যে যে ধাতুটি উপরে অবস্থিত সেই ধাতুটি অধিক সক্রির অর্থাৎ সেই ধাতুটি দ্রুত বিক্রিয়া করে। আবার, এই সারির যেকোনো দুটি মৌলের আয়নের মধ্যে যে আয়নটি নিচে অবস্থিত সেটি আগে ইলেকট্রন গ্রহণ করে আগে চার্জযুক্ত হবে অর্থাৎ আগে বিজারিত হবে। যেমন— Na+ এবং H+ এর মধ্যে H+ সারির নিচে অবস্থিত কাজেই H+ আগে ইলেকট্রন গ্রহণ করে চার্জযুক্ত হবে অর্থাৎ আগে বিজারিত হবে। আবার, Zn 2+ এবং Fe2+ এর মধ্যে Fe2+ তড়িৎ রাসায়নিক সারির নিচে অবস্থিত। কাজেই Fe2+ আগে ইলেকট্রন গ্রহণ করে আগে চার্জযুক্ত হবে অর্থাৎ আগে বিষ্ফারিত হবে।

তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় একের অধিক অ্যানায়ন থাকলে   অ্যানোডের অ্যানায়নসমূহের মধ্যে কোনটি আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে আগে চার্জমুক্ত হবে, কোনটি পরে ইলেকট্রন ত্যাগ করে চার্জমুক্ত হবে তার উপর ভিত্তি করে অ্যানায়নসমূহকেও আরও একটি সারণিতে সাজানো হয়েছে। এই সারণিকে অ্যানায়নের তড়িৎ রাসায়নিক সারি বলা হয়। এই সারির যেকোনো দুটি আয়নের মধ্যে যে আয়নটি নিচে অবস্থিত সেটি আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে আগে চার্জমুক্ত হবে অর্থাৎ আগে জারিত হবে। যেমন: SO42- এবং Cl এর মধ্যে Cl- সারির নিচে অবস্থিত। কাজেই cl- আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে চার্জমুক্ত হবে অর্থাৎ আগে জারিত হবে। আবার, cl- এবং OH এর মধ্যে OH- তড়িৎ রাসায়নিক সারির নিচে অবস্থিত। কাজেই OH— আগে ইলেকট্রন ত্যাগ করে চার্জমুক্ত হবে অর্থাৎ আগে জারিত হবে।
 

(ii) ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের ঘনমাত্রার প্রভাব 

দ্রবণে একের অধিক ক্যাটায়ন বা অ্যানায়ন থাকলে চার্জমুক্ত হওয়ার প্রবণতার চেয়ে ঘনমাত্রার প্রভাব অনেক বেশি কার্যকর হয়। যেমন— কক্ষ তাপমাত্রায় 0.1 মোলার NaCl এর জলীয় দ্রবণে অ্যানায়ন Cl- আয়নের ঘনমাত্রা হবে 0.1 মোলার। অন্যদিকে, পানির বিয়োজনে অ্যানায়ন OH- আয়নের ঘনমাত্রা হবে 107 মোলার। অর্থাৎ Cl- আয়নের ঘনমাত্রা OH- আয়নের ঘনমাত্রার চেয়ে 106 গুণ বেশি। চার্জমুক্ত হবার প্রবণতার সারিতে OH- আয়নের অবস্থান C1- আয়নের নিচে হওয়ায় OH- আয়নের আগে চার্জমুক্ত হবার প্রবণতা বেশি। কিন্তু Cl- আয়নের ঘনমাত্রা বেশি হওয়ায় cl- আয়ন আগে চার্জমুক্ত হয়।
 

(iii) তড়িৎ দ্বারের প্রকৃতি
তড়িৎবিশ্লেষ্য কোষে তড়িৎদ্বারের প্রকৃতি অনেক সময় চার্জমুক্ত হওয়ার জন্য উপরের দুইটি নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটায়। তোমরা দেখেছো NaCl এর জলীয় দ্রবণে দুই ধরনের ক্যাটায়ন থাকে। একটি Na+ আয়ন, অপরটি H+ আয়ন। যদি প্লাটিনাম তড়িৎদ্বার ব্যবহার করা হয় তবে চার্জমুক্ত হবার প্রবণতা অনুযায়ী ক্যাথোডে H+ চার্জমুক্ত হয়ে H2 গ্যাস উৎপন্ন করে। আর যদি পারদকে ক্যাথোড রূপে ব্যবহার করা হয় তবে Na+ আয়ন আগে চার্জমুক্ত হয়।
বিশুদ্ধ পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ
 

বিশুদ্ধ পানিকে তড়িৎ বিশ্লেষণ করতে তড়িৎ বিশ্লেষণ কোষে নিষ্ক্রিয় ধাতুর অ্যানোড ও ক্যাথোড ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্লাটিনাম ধাতুর পাত অ্যানোড ও ক্যাথোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পানি সামান্য পরিমাণে নিম্নরূপে আয়নিত অবস্থায় থাকে:
 

4H20              4H+ + 40H-
 

পানির বিয়োজন বৃদ্ধি করার জন্য পানিতে কয়েক ফোঁটা সালফিউরিক এসিড যোগ করা হয়।

আর ক্যাথোড হাইড্রোজেন আয়নকে (H+) আকর্ষণ করে। তড়িৎদ্বার দুইটিতে নিম্নরূপ বিক্রিয়া ঘটে।
ক্যাথোড তড়িৎদ্বারে বিক্রিয়া: 4H+ + 4e-   2H2 (বিজারণ ক্রিয়া)
 

অ্যানোড তড়িৎদ্বারে বিক্রিয়া: 40H-     02 + 2H2O + 4e  (জারণ ক্রিয়া)

অর্থাৎ ক্যাথোডে হাইড্রোজেন গ্যাস আর অ্যানোডে অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়। তোমরা হয়তো ভাবছো এখানে কয়েক ফোঁটা সালফিউরিক এসিড বা কয়েক দানা NaCl কেন ব্যবহার করা হলো? তোমরা জানো একটি পূর্ণ বর্তনী তৈরি না হলে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় না। অ্যানোড, ক্যাথোড বা ব্যাটারির মধ্যে ইলেকট্রনের মাধ্যমে বিদুৎ প্রবাহিত হয়। কিন্তু তরলের মধ্য দিয়ে আয়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। পানি খুবই অল্প পরিমাণে  আয়নিত হয়। তাই বিশুদ্ধ পানি বিদ্যুৎ অপরিবাহীর মতো আচরণ করে। বিদ্যুৎ পরিবাহিতা বাড়াতে তাই সামান্য পরিমাণ সালফিউরিক এসিড ব্যবহার করা হয়।

 

তড়িৎ বিশ্লেষণের ব্যবহার
বর্তমানে সমস্ত পৃথিবীতে শিল্পকারখানার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। আর শিল্পজগতে তড়িৎ বিশ্লেষেণের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক মূল্যবান যৌগের উৎপাদনে, আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনে, অবিশুদ্ধ ধাতুকে বিশুদ্ধ ধাতুতে পরিণত করতে, যে সকল ধাতু সহজে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় তাদের ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে, লোহার উপর মরিচা পড়া ঠেকাতে, এক ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ দিতে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় আর তড়িৎ বিশ্লেষণ করতে তড়িৎ বিশ্লেষ্য কোষ ব্যবহার করা হয়। নিচে তড়িৎ বিশ্লেষণের কিছু ব্যবহার দেখানো হলো :
 

ধাতু নিষ্কাশন: ক্ষার ধাতু, মৃৎক্ষার ধাতু, অ্যালুমিনিয়াম ধাতু প্রভৃতি সক্রিয় ধাতুসমূহ তড়িৎ বিশ্লেষ পদ্ধতিতে নিকাশন করা হয়। সাধারণত এ সকল ধাতুর যৌগের ভরলে অথবা দ্রবণে তড়িত্রার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করলে ক্যাথোডে ধাতু উৎপন্ন হয়। যেমন— গলিত সোডিয়াম

ক্লোরাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণের সময় ক্যাথোডে ধাতব সোডিয়াম পাওয়া যায় এবং অ্যানোডে ক্লোরিন গ্যাস (Cl2) পাওয়া যায়।
গলিত বিশুদ্ধ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড বা অ্যালুমিনা (Al2O3) এর তড়িৎ বিশ্লেষণ করলে ক্যাথোডে অ্যালুমিনিয়াম ধাতু ও অ্যানোডে অক্সিজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।

ধাতু বিশুদ্ধকরণ: আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের পর প্রাপ্ত ধাতুতে যথেষ্ট পরিমাণে ভেজাল দ্ৰব্য মিশ্রিত থাকে। এ সকল ধাতুকে বিশুদ্ধ করতে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর। কপার, জিংক, লেড, অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি ধাতুকে বিশুদ্ধকরণের জন্য তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। যে ভেজাল মিশ্রিত ধাতু থেকে ভেজাল অপসারণ করে আমরা বিশুদ্ধ ধাতু তৈরি করতে চাই সেই ভেজাল মিশ্রিত ধাতুর দণ্ডকে ব্যাটারির ধনাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। যে ধাতুকে বিশুদ্ধ করতে চাই ঐ ধাতুর একটি বিশুদ্ধ দণ্ড ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত করা হয়। এরপর তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ভেজাল মিশ্রিত অবিশুদ্ধ ধাতুর দণ্ড থেকে ধাতব আয়ন দ্রবণে চলে যায় এবং দ্রবণ থেকে ঐ ধাতব আয়ন বিশুদ্ধ ধাতব দণ্ডে লেগে যায়, ফলে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে যুক্ত বিশুদ্ধ ধাতব দণ্ড মোটা হতে থাকে। তড়িৎ বিশ্লেষণ চলাকালে একদিকে ভেজাল মিশ্রিত অবিশুদ্ধ ধাতব দণ্ড ক্ষয় হতে থাকে, অন্যদিকে বিশুদ্ধ ধাতব দণ্ড মোটা হতে থাকে।
 

ইলেকট্রোপ্লেটিং বা তড়িৎ প্রলেপন: তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি ধাতুর উপর অন্য একটি ধাতুর প্রলেপ দেওয়াকে ইলেকট্রোপ্লেটিং বলে। ধাতুর উজ্জ্বলতা সৃষ্টির জন্য অথবা ধাতুর ক্ষয়রোধ করতে ইলেকট্রোপ্লেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কোনো ধাতুর উজ্জ্বলতা সৃষ্টির জন্য অন্য একটি উজ্জ্বল ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। কারণ কম সক্রিয় ধাতু বাতাসের অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে না। কোনো ধাতুর ক্ষয়রোধ করতে ঐ ধাতুর উপর অপেক্ষাকৃত কম সক্রিয় অন্য ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। ইলেকট্রোপ্লেটিং এর জন্য সাধারণত নিকেল, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি ধাতু ব্যবহার করা হয়। লোহা জলীয় বাষ্প এবং বায়ুর সংস্পর্শে এলে মরিচা ধরে এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। লোহার উপর নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিলভার ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। ফলে লোহা বাতাস ও জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে আসতে পারে না এবং মরিচাও পড়ে না। লোহার তৈরি কোনো জিনিসের উপর প্রলেপ দেওয়ার কৌশল নিচে আলোচনা করা হলো।

লোহার তৈরি কোনো জিনিস যেমন, চামচ এর উপর সিলভারের প্রলেপ দিতে AgNO3 দ্রবণ একটি কাচপাত্রের মধ্যে নেওয়া হয়। যে জিনিসের উপর প্রলেপ দিতে হবে তাকে ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তে সাথে যুক্ত করে ক্যাথোড তড়িৎদ্বার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সিলভার ধাতুর পাত অ্যানোড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ব্যাটারি দ্বারা দ্রবণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করলে অ্যানোড হিসেবে যে সিলভারের পাত ব্যবহার করা হয় সেই সিলভার পাত থেকে ধাতব Ag পরমাণু একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Ag+ আয়নে পরিণত হয়ে দ্রবণে চলে যায় এবং দ্রবণের Ag+ আরন ক্যাথোড তড়িৎদ্বার থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ধাতব সিলভারে পরিণত হয়ে ক্যাথোডে লেগে যায়। এতে লোহার তৈরি জিনিসের উপর সিলভারের প্রলেপ পড়ে। 

 

তড়িৎ বিশ্লেষণে উৎপাদিত পদার্থের বাণিজ্যিক ব্যবহার
তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু করতে পারি। বিভিন্ন সক্রিয় ধাতুর নিষ্কাশন থেকে শুরু করে অনেক মূল্যবান যৌগ ও মৌলের উৎপাদন, এক ধাতুর উপর অন্য ধাতুর প্রলেপ দিয়ে তার ক্ষয় রোধ করা, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করাসহ আরও অনেক কিছু তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে আকরিক থেকে বিভিন্ন ধাতু যেমন: সোডিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি নিষ্কাশন করা হয়। এছাড়া তামা, সোনা, রূপা এর বিশুদ্ধ করতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক বিশ্বে এসব ধাতুর ব্যবহার অপরিসীম।
 

আমরা জানি, রুপা ও তামার বৈদ্যুতিক রোধ সবচেয়ে কম। কিন্তু রুপার দাম অনেক বেশি। তাই বৈদ্যুতিক তার তৈরিতে তামা ব্যবহার করা হয়। তোমরা কি চিন্তা করতে পারো সারা বিশ্বে কত বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার হচ্ছে? অ্যালুমিনিয়াম অতি প্রয়োজনীয় ধাতু। এ ধাতু দিয়ে বিভিন্ন থালাবাসন তৈরি করা হয়ে থাকে। তাছাড়া অ্যালুমিনিয়াম হালকা ধাতু বলে বিমান তৈরিতে অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করা হয়। লোহার উপর মরিচা পড়া ঠেকাতে লোহার উপর দস্তা ও ম্যাগনেসিয়ামের প্রলেপ দেওয়া হয়। এতে লোহার স্থায়িত্বও বৃদ্ধি পায়। অল্প দামী ধাতুর গয়নার উপর উজ্জ্বল ধাতু যেমন: ক্রোমিয়াম, নিকেল, সোনা, রুপা প্রভৃতি ধাতুর প্রলেপ দেওয়া হয়। এতে গয়না অনেক উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়।
 

সমুদ্রের পানির তড়িৎ বিশ্লেষণে উৎপন্ন ক্লোরিন জীবাণুনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ক্ষার ব্যবহৃত হয়।

 

 

Content added By