নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - পৌরনীতি ও নাগরিকতা - জাতীয় চেতনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় | NCTB BOOK

ব্রিটিশ শাসন আমলে অবিভক্ত ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও স্বশাসনের চেতনা জাগ্রত হয় । মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ । ১৯৩০ সালে কবি আল্লামা ইকবাল মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র চৌধুরী রহমত আলী ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের মুসলিম এলাকাগুলো নিয়ে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা অঙ্কণ করেন ৷ ১৯৩৯ সালে মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের মুসলমানদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ঘোষণা করেন । যার ফলে পরবর্তীকালে মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে আলাদা আবাসভূমির চিন্তা জাগ্রত হয় ।

এই চিন্তাধারার আলোকেই ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ পাঞ্জাবের লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থ-সম্বলিত একটি প্রস্তাব পেশ করেন। জিন্নাহর সভাপতিত্বে সভায় প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । এই প্রস্তাবই ঐতিহাসিক ‘লাহোর প্রস্তাব' বা 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে পরিচিত।

লাহোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য বা বৈশিষ্ট্য ছিল নিম্নরূপ-

১. ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন এলাকাগুলোকে পৃথক অঞ্চল বলে গণ্য করতে হবে ।

২. এসব অঞ্চলের ভৌগোলিক সীমানা প্রয়োজনমত পরিবর্তন করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের যে সকল স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ” প্রতিষ্ঠা করতে হবে ।

৩. এ সমস্ত স্বাধীন রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হবে সার্বভৌম ও স্বায়ত্ত্বশাসিত ।

৪ . ভারতের ও নবগঠিত মুসলিম রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক, শাসনতান্ত্রিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা করা হবে ।

৫. দেশের যেকোনো ভবিষ্যৎ শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনায় উক্ত বিষয়গুলোকে মৌলিক নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

 

লাহোর প্রস্তাবের কোথাও ‘পাকিস্তান' কথাটি না থাকলেও এটি 'পাকিস্তান প্রস্তাব' নামে পরিচিতি লাভ করে । লাহোর প্রস্তাবে কার্যত ভারতের সন্নিহিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো নিয়ে পৃথক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করা হয় ।

১৯৪৬ সালে জিন্নাহর নেতৃত্বে 'দিল্লি মুসলীম লেজিসলেটরস কনভেনশন'-এ মুসলমানদের একাধিক রাষ্ট্র- পরিকল্পনাকে বাদ দিয়ে এক পাকিস্তান পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় । ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর- পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল নিয়ে সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও বাকি অংশ নিয়ে ভারত ইউনিয়ন ।

১৯৪০ সালের ‘লাহোর প্রস্তাব' ও জিন্নাহর ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ পাকিস্তান সৃষ্টির মূলভিত্তি ছিল। এর উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভব। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশ প্রায় এক হাজারের অধিক মাইল ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা বিভক্ত ছিল। রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা । পশ্চিম পাকিস্তানি বিশেষ করে পাঞ্জাবিরা মনে করত, তাদের পূর্ব পুরুষেরা ভারতবর্ষের বাইরে থেকে আগত এবং তাদের ধমনিতে রয়েছে অভিজাতের রক্ত। এই ধরনের মানসিকতার কারণে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালি মুসলমানদের অবহেলার চোখে দেখত ৷ 

ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এক ধরনের অভ্যন্তরীণ বৈষম্যমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। এই শাসনকালে বাঙালিদের অবস্থা ছিল অনেকটা নিজ দেশে পরবাসীর মতো । পূর্ব বাংলার বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ভাষা বাংলার পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের ভাষা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।