সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - আদর্শ জীবনচরিত | NCTB BOOK

প্রভু নিত্যানন্দ ১৪৭৩ সালে বীরভূম জেলার একচক্রা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হারাই পণ্ডিত এবং মাতার নাম পদ্মাবতী।তাঁর প্রকৃত নাম ছিল কুবের। গ্রামের পাঠশালায় তাঁর লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ার চেয়ে ধর্মের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল বেশি। তাঁর বয়সি ছেলেরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত তখন তিনি মন্দিরে গিয়ে বসে থাকতেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই রামায়ণ, মহাভারতের চরিত্রগুলোয় অভিনয় করতেন। সারাক্ষণ কৃষ্ণচিন্তায় মগ্ন থাকতেন। কী করলে শ্রীহরির দর্শন পাওয়া যাবে এটাই ছিল তাঁর সর্বক্ষণের ভাবনা ।

প্রভু নিত্যানন্দ ও তার ভক্তরা

কুবেরের বয়স তখন বারো বছর। একদিন এক সন্ন্যাসী তাঁদের বাড়িতে এলেন। কুবের তখন সন্ন্যাসীর সঙ্গে বৃন্দাবনে যাওয়ার বায়না ধরেন। কুবের নাছোড়বান্দা, তিনি সন্ন্যাসীর সাথে বৃন্দাবনে যাবেনই। কেননা তিনি জানতেন বৃন্দাবন শ্রীকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র। অবশেষে পিতামাতার সম্মতি মিলল। তিনি সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে গৃহত্যাগ করলেন। তাঁরা দুজনে একত্রে বহু তীর্থস্থান ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। হঠাৎ কুবের একদিন সন্ন্যাসীকে হারিয়ে ফেললেন। এরপর তিনি একাই বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। এভাবে একদিন তিনি উপস্থিত হলেন কাঙ্ক্ষিত বৃন্দাবনে। সেখানে তাঁর দেখা হয় পরম সন্ন্যাসী শ্রীপাদ মানবেন্দ্রপুরীর সাথে। তাঁর কাছ থেকে তিনি কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা নেন। তিনি কৃষ্ণচিন্তায় বিভোর থাকেন। শ্রীহরির চিন্তায় তাঁর দিন কাটতে থাকে। হঠাৎ একদিন তিনি কৃষ্ণকে স্বপ্নে দেখতে পান। স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে নবদ্বীপে যাওয়ার আদেশ দেন। এরপরেই তিনি বৃন্দাবন ছেড়ে নবদ্বীপের পথে রওনা হলেন। এখানে তাঁর সঙ্গে নিমাই পণ্ডিতের সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা দুজনে মিলে যেন এক হয়ে যান। জীবোদ্ধারের জন্য যেন দুই দেহে তাঁদের আবির্ভাব ঘটেছে। সেদিন থেকে কুবেরের নতুন নাম হলো নিত্যানন্দ। সংক্ষেপে নিতাই। আর গৌরাঙ্গের সংক্ষিপ্ত নাম গৌর। ভক্তরা সংক্ষেপে বলতেন গৌরনিতাই। নবদ্বীপে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর তাঁরা উভয়ে মিলে হরিনামে মেতে ওঠেন। তাঁরা সকল শ্রেণির মানুষের কাছে বৈষ্ণব মত প্রচার করতে থাকেন। তাঁদের প্রেমধর্মে ছিল না কোনো জাতিভেদ বা উঁচুনীচু ভেদাভেদ। যখন শুদ্ধাচরণের নিচে চাপা পড়েছিল মানবপ্রেম তখনই প্রেমভক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে দলে দলে লোক তাঁদের অনুসারী হতে লাগলেন।

নবদ্বীপে তাঁরা নেচেগেয়ে হরিনাম প্রচার করতে লাগলেন। সেই সময় নবদ্বীপে জগাই-মাধাই নামে দুই ভাই নগর কোতোয়ালের কাজ করত। তাঁরা ছিল মদ্যপ ও হরিবিদ্বেষী। যে কোনো অন্যায় কাজ করতে তারা দ্বিধা করত না। গৌরনিতাই প্রেমভক্তি দিয়ে জগাইমাধাইকে উদ্ধার করেন। এদের দুই ভাইয়ের জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তারাও তখন নবদ্বীপে কৃষ্ণনামে মাতোয়ারা হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সন্ন্যাস নিয়ে নীলাচলে চলে যান। প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নির্দেশ মতো গৌড়ে গিয়ে বিদ্বান, মূর্খ, চণ্ডাল, ধনী, দরিদ্র সকলের মধ্যে হরিনাম আর প্রেমধর্ম বিতরণ করতে লাগলেন। তিনি সকলকে এক কৃষ্ণ নামে আবদ্ধ করলেন। সার্থক হলো তাঁর প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণ নামের আন্দোলন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু গৌড়বাসীর অন্তরে চির অমর হয়ে থাকেন। ১৫৪২ সালে এই মহাসাধক ইহলোক ত্যাগ করেন।

প্রভু নিত্যানন্দ কোনো তর্কবিতর্ক ছাড়া ধর্মের কোনো বিচার-বিশ্লেষণ না করেই সকলের মধ্যে প্রেমভক্তি বিতরণ করেছেন। তিনি কখনোই ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করেননি। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করেননি। তিনি হিন্দুধর্ম ও সমাজ জীবনে এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ফলে সাধারণ মানুষ সমস্ত কিছু ভুলে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিল। যে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁর কাছে এসে পরম শান্তি লাভ করত। এমনিভাবে অসংখ্য মানুষ প্রভু নিত্যানন্দের সংস্পর্শে এসে নবজীবন লাভ করেন। সার্থক হয় প্রেমভক্তি ও কৃষ্ণনামের আন্দোলন। আমরাও তাঁর মতো সকল মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখব। মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ করব না। সকলকে সম্প্রীতির বাঁধনে বেঁধে রাখব।

প্রভু নিত্যানন্দের বাণী

  • মানুষে মানুষে কোনো উঁচু-নিচু ভেদাভেদ করবে না।
  • একমাত্র প্রেমভক্তি ও মানবপ্রেম দিয়ে মানুষকে আপন করা যায়।
  • কাউকে যদি ক্ষমা করো, তাহলে তুমিও ক্ষমা পাবে।
  • সকলকে এক কৃষ্ণনামে আবদ্ধ হতে হবে।
  • সংসারে সংসারী হয়ে কৃষ্ণনাম নিতে হবে।
     
Content added By