সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - আদর্শ জীবনচরিত | NCTB BOOK

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র পাবনা জেলার হিমাইতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলা ১২৯৫ সালের ৩০ শে ভাদ্র (ইংরেজি ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর), শুক্রবার শুভ তালনবমী তিথিতে শিবচন্দ্র চক্রবর্তীর ঘরে মাতা মনোমোহিনী দেবীর কোলে জন্ম নেয় এক শিশু। শুভদিনে মাতা মনোমোহিনী দেবী নিজ পুত্রের নাম রাখেন অনুকূলচন্দ্র। অনুকূলচন্দ্রের পিতা শিবচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ আর মাতা মনোমোহিনী দেবী ছিলেন অত্যন্ত ইষ্টপ্রাণ একজন রমণী।

পাবনার হিমাইতপুরেই অনুকূলচন্দ্রের শৈশব, বাল্য ও কৈশোর অতিক্রান্ত হয়। পাঁচ বছর বয়সে ভগবান শিরোমণি আর সূর্য শাস্ত্রীর নিকট বালক অনুকূলচন্দ্রের হাতেখড়ি সম্পন্ন হয়। প্রথমে কাশীপুর-হাটতলায় কেষ্ট বৈরাগীর পাঠশালায় তিনি পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। পরে তিনি পাবনা ইন্সটিটিউশনে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। এরপরে তিনি পড়াশুনা করেন পশ্চিমবঙ্গের নৈহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয় থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য মনোনীত হন। পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতিও নেন। এর মধ্যে তিনি জানতে পারেন, তাঁরই এক সহপাঠী টাকার অভাবে পরীক্ষার ফি দিতে পারছেন না। এগিয়ে এলেন অনুকূল। নিজের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফি দিয়ে দিলেন বন্ধুকে। সেবার আর তাঁর পরীক্ষা দেয়া হলো না। অনুকূল পাশ করলেন পরের বছর। মায়ের ইচ্ছায় এরপর তিনি ভর্তি হলেন কোলকাতার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে। এখানেও তিনি স্থানীয় কুলিমজুরদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

চিকিৎসা বিদ্যা শেষ করে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। এসেই তিনি গ্রামের গরীব দুঃখী মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন, মানুষের দুঃখ দূর করতে হলে শুধু শারীরিক চিকিৎসা নয়, মানসিক ও আত্মিক চিকিৎসারও প্রয়োজন আছে। এভাবে সারাজীবন তিনি গরীব-দুঃখী মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। শৈশবকাল থেকেই অনুকূলচন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মাতৃভক্ত। মাতৃআজ্ঞা পালনে তিনি ছিলেন সদা তৎপর। তিনি তাঁর বাণীতে বলেছেন, “মাতৃভক্তি অটুট যত, সেই ছেলেই হয় কৃতী তত।”

পিতার প্রতিও ছিল তাঁর সমান শ্রদ্ধা ও কর্তব্যবোধ। একবার পিতার অসুখের সময় সংসারে খুব অভাব- অনটন দেখা দিল। বালক অনুকূলচন্দ্র তখন নিঃশঙ্কচিত্তে সংসারের হাল ধরলেন। তিনি তখন প্রতিদিন আড়াই মাইল পথ পায়ে হেঁটে শহরে গিয়ে মুড়ি বিক্রি করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে বাবার জন্য ঔষধ-পথ্য ও সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী এনে মায়ের হাতে তুলে দিতেন। এভাবে তিনি পিতামাতাকে পরম শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে নিরন্তর ভালোবেসেছেন। তিনি বলেছেন, “পিতায় শ্রদ্ধা মায়ে টান, সেই ছেলে হয় সাম্যপ্ৰাণ। ”

অনুকূলচন্দ্র ছিলেন সমাজের অসহায় অবহেলিতদের বন্ধু। তাদের নিয়ে তিনি কীর্তন দল গঠন করেন। কীর্তনের মধ্য দিয়ে তিনি তাদের মানসিক শান্তির বিধান করেন। অনেক শিক্ষিত তরুণও এগিয়ে আসেন। তার এই কীর্তন একসময় একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। সবাই তাকে তখন ডাক্তার না বলে ‘ঠাকুর’ বলে ডাকত। সে থেকে তিনি ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র নামে পরিচিত হন। তার খ্যাতি ক্রমশ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

সৎসঙ্গ আশ্রম ,পাবনা

মানুষ যাতে সৎ পথে থাকে, সৎ চিন্তা করে সেজন্য ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণের জন্য পাবনার হিমাইতপুরে গড়ে তোলেন সৎসঙ্গ আশ্রম। যজন, যাজন, ইষ্টভৃতি, সস্ত্যয়ণী ও সদাচার এই পাঁচটি সৎসঙ্গের মূলনীতি।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে অনুকূলচন্দ্র বিহারের দেওঘরে যান এবং সেখানে আদর্শ একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্যসম্প্রদায় এবং সৎসঙ্গের কর্মকাণ্ড উভয় বাংলার নানা অঞ্চলে আজও সক্রিয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর আশ্রম ও কার্যালয় আছে। এর মাধ্যমে জনগণকে সেবা দেওয়া হয়। প্রতি বছর ৩০শে ভাদ্র অসংখ্য ভক্তের মিলনে ঠাকুরের পুণ্য জন্মভূমি হিমাইতপুরে পবিত্র গঙ্গাস্নান উৎসব পালিত হয়।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বিসত্যানুসরণ, পুণ্যপুঁথি, অনুশ্রুতি, চলার সাথীসহ বহু পুস্তক রচনা করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২৭ জানুয়ারি ৮১ বছর বয়সে অমৃতলোকে গমন করেন।

শিক্ষা বিষয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের কিছু অমিয় বাণী হলো:-

১. অভ্যাস, ব্যবহার ভাল যত 

   শিক্ষাও তা’র জানিস্ তত। 

২. মুখে জানে ব্যবহারে নাই  

     সেই শিক্ষার মুখে ছাই ।

৩. ঝোঁক না বুঝে শিক্ষা দিলে 

     পদে-পদে কুফল মিলে।

৪. শিক্ষকতা করতে গেলেই 

     ছাত্রদের ধাত বুঝে নিও, 

     ভাল লাগার রকম দেখে 

     সেই পথেতে শিক্ষা দিও।

৫. শিক্ষা দিও এমনিভাবে 

    বুঝতে না পারে শিখছে সে, 

    শিক্ষা যদি ভীতি আনে 

    বুঝবে না সে তরাসে।

শিক্ষা: শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিক্ষা ছিল মানুষের কোনো ভেদাভেদ নাই। যে যে-সম্প্রদায়েরই হোক না কেন মনে রাখতে হবে ঈশ্বর এক ধর্ম এক। সংসারে থাকবে, মন রাখবে ভগবানে। শুধু লেখাপড়া করলেই বড় হওয়া যায় না, আচার ব্যবহার জানতে হয়। শিষ্টাচার, সততা, সময়ানুবর্তিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, সদাচার প্রভৃতি নৈতিকমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। সবসময় মানবসেবামূলক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের এই সব শিক্ষা স্মরণ রেখে আমরা পথ চলব এবং জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তুলব।

 

Content added By