সপ্তম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - হিন্দু ধর্ম শিক্ষা - আদর্শ জীবনচরিত | NCTB BOOK

স্বামী স্বরূপানন্দ ১৮৭১ সালে ৮ই জুলাই চাঁদপুরের পুরাতন আদালত পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সতীশ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও মাতা মায়াদেবী। স্বামী স্বরূপানন্দের পূর্ণ নাম ছিল অজয় হরি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর ডাক নাম ছিল বল্টু। ছোটবেলা থেকেই বল্টুর জীবনে কিছু অসাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। শৈশবে প্রায় সময়ই তিনি ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ছোটবেলায় একবার তিনি
তাঁর বন্ধুদের মাঠে নিয়ে যান খেলার কথা বলে। কিন্তু তিনি বন্ধুদের সাথে সাধারণ কোনো খেলা খেলেননি। আসনে বসে বন্ধুদের তিনি শ্রীহরির নাম জপ করতে বলেন। বন্ধুরা সবাই বল্টুর কথামতো শ্রীহরির নাম জপ করতে থাকে। একসময় তারা সকলে একে একে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেলেও বল্টু বাড়ি ফিরে যায়নি। মা-বাবা দুঃচিন্তায় বল্টুর খোঁজে বের হন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সন্ধান মেলে নির্জন এক স্থানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। জীবনের দুঃখ, সংকট ও মানবিক দুর্দশা তাঁকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে অনুপ্রাণিত করেছিল।
তাঁর ঠাকুরদা ছিলেন যোগীপুরুষ এবং পিতা স্বভাব কবি। স্বরূপানন্দ ছিলেন তাঁদের সবগুলো গুণের উত্তরাধিকারী। তাঁর জীবনে আধ্যাত্মিকতা, কাব্য, সংগীত, সাহিত্য, লোকশিক্ষা, বিজ্ঞান ও বিপ্লববাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটে।

স্বামী স্বরুপানন্দ

স্বামী স্বরূপানন্দ ১৮৯৮ সালে চেন্নাই যান। তিনি চেন্নাই থাকাকালীন শ্রীরামকৃষ্ণের আদেশে ইংরেজি ভাষায় মাসিক সাময়িকী ‘প্রবুদ্ধ ভারত' -এর সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন।

স্বামী স্বরূপানন্দ বেলুড়ে নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বাগান বাড়িতে স্বামী বিবেকানন্দের সাথে সাক্ষাৎ করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর পিতা মাতা তাঁকে স্বামী বিবেকানন্দের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিলেন। তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে বিভিন্ন দেশ ঘুরে সাধন ভজনে সিদ্ধি লাভ করেন। ফিরে এসে তিনি হয়ে ওঠেন এক নতুন মহামন্ত্রের দিশারী, ওঙ্কার সাধক শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ ।

স্বামী স্বরূপানন্দ ওঙ্কার সাধনার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সর্ব মন্ত্রের সেরা মন্ত্র ওঙ্কার সাধনার ইচ্ছা জেগেছিল। ছেলেবেলায় শত চেষ্টা করেও তাঁকে কেউ এই ওঙ্কার সাধনা থেকে বিচ্যুত করতে পারেননি। তিনি বলেন, “ওঙ্কার সর্ব মন্ত্রের প্রাণ, সর্ব মন্ত্রের সমন্বয় এবং সর্ব তত্ত্বের স্বীকৃতি।” নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র সকল শ্রেণি পেশার লোক যাতে একত্রে উপাসনা করতে পারেন সে জন্য তিনি সমবেত উপাসনার প্রবর্তন করেন। তিনি বলেন, সমবেত উপাসনায় যে যার সাধ্যমতো পূজার সামগ্রী নিয়ে আসবে। সমবেত উপাসনা সকলকে এক কাতারে নিয়ে আসে। এখানে সবাই মিলে এক হয়। সমবেত উপাসনায় কোনো সম্মান অসম্মানের প্রশ্ন থাকে না। তিনি আরো বলেন, আমরা শুধু নিজের মুক্তির জন্যই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব না ।

আমাদের তপস্যা হবে জগতের সকলের কল্যাণ এবং সকলের মুক্তির জন্য। ১৯০৬ সালের ২৭শে জুন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

স্বামী স্বরূপানন্দ শুধু আধ্যাত্মিক চর্চা ও তপস্যাই করতেন না। তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেছেন। দুর্ভিক্ষ কবলিত অসহায় মানুষকে উদ্ধার করতে তিনি ছুটে যেতেন। দরিদ্র মানুষের খাদ্য ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করেছেন সাধারণ কৃষকদের উন্নতির জন্য তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি কয়েকটি স্কুল, দাতব্য চিকিৎসালয় ও জনহিতকর প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন

স্বামী স্বরূপানন্দের বাণী

  • ভিক্ষা করো না, কর্ম করো।
  • বীজের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হবে তার ফলকে দিয়ে।
  • ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ হয় সেই ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের শ্রেষ্ঠতা দিয়ে।
  • নিখিল বিশ্বের কুশল হোক, জাতি বৈর নির্মূল হোক।
  • সাম্প্রদায়িকতার অবসান হোক।

শিক্ষা: স্বামী স্বরূপানন্দের জীবনী থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে, বিপদে আর্ত পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। সাধ্যমত তাদেরকে সবরকম সহযোগিতা করতে হবে। জীবের সেবা মানেই ঈশ্বরের সেবা করা। তাই সৰ্ব জীবের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে।

Content added By