মিশ্র চাষে ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি

এসএসসি(ভোকেশনাল) - শ্রিম্প কালচার এন্ড ব্রিডিং-২ - প্রথম পত্র (নবম শ্রেণি) | | NCTB BOOK

মিশ্র চাষের ক্ষেত্রে চাষ পদ্ধতি ৩ ধরনের হতে পারে; যথা- ব্যাপক পদ্ধতির চাষাবাদ, আধানিবিড় পদ্ধতির চাষাবাদ ও নিবিড় পদ্ধতির চাষাবাদ। গলদা চিংড়ি-কার্প ব্যবস্থাপনাকে প্রধানত ৩টি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে; যথা- মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা, মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা ও মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা।

Content added By

মজুদপূর্ব ব্যবস্থাপনা

পোনা মজুদের আগেই পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যবেক্ষণ করা উচিত। সাধারণভাবে পুকুরের প্রাকৃতিক খাদ্য পর্যবেক্ষণের কাজটি কয়েকভাবে করা যায়। বাদামি সবুজ পানি মিশ্র চাষের জন্য ভালো তবে ঘোলা, ঘন সবুজ তামাটে লাল বা স্বচ্ছ পানি মিশ্র চাষের জন্য ভালো নয়। পানির রং ঠিক আছে কিনা তা নিজের চোখ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

পুকুরে পোনা মজুদের ১-২ দিন আগে পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখতে হবে। পানিতে কোন প্রকার বিষক্রিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য পুকুরে একটি হাপা টাঙ্গিয়ে তার মধ্যে ১০-১৫ টি পোনা ছেড়ে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদি এই সময়ের মধ্যে পোনা মারা না যায়, তবে বুঝতে হবে পানি বিষক্রিয়া মুক্ত এবং এভাবে বালতি বা হাড়িতেও পানির বিষক্রিয়া পরীক্ষা করা যায়।

খোলস পরিবর্তন করে চিংড়ি বড় হয়। খোলস পরিবর্তনের সময় চিংড়ি দুর্বল থাকে বলে এ সময় চিংড়ির আশ্রয়স্থলের প্রয়োজন হয়। পুকুরের তলায় কিছু উদ্ভিদ থাকলে সেগুলো চিংড়ির আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া এসব আশ্রয়স্থল চিংড়ি ও মাছকে চোরের উপদ্রব থেকে রক্ষা করতেও সাহায্য করে থাকে। পুকুরের তলায় উদ্ভিদ না থাকলে আশ্রয়স্থল হিসেবে পুকুরে তাল, নারিকেল বা খেজুর গাছের শুকনো পাতা, বাঁশ, গাছের ডালপালা আশ্রয়স্থলের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। চিংড়ির আশ্রয়স্থলের উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিকের টুকরা, ইটের টুকরা, ভাঙা কলস ইত্যাদিও ব্যবহার করা যায়।

Content added By

মজুদকালীন ব্যবস্থাপনা

পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনা মূলত ৬টি পর্যায়ে বিভক্ত। এই কাজগুলো সঠিকভাবে করতে পারলে পোনার মৃত্যুহার বহুলাংশে কমানো সম্ভব। এর ফলে সন্তোষজনক উৎপাদন নিশ্চিত হয়। পোনা মজুদ ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কাজগুলো নিচে বর্ণনা করা হল-

ক) প্রজাতি ও পরিমাণ নির্ধারণ: নিম্নোক্ত বিষয়গুলির ভিত্তিতে পোনার মজুদ ঘনত্ব ও প্রজাতি নির্ধারণ করা হয়।
পোনার প্রাপ্যতা: এলাকাগত প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে কার্পের পোনার জাত নির্বাচন করা উচিত। একইভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে এবং যেখানে গলদা চিংড়ির হ্যাচারি আছে সেখানে গলদার পোনা পাওয়া যায় অর্থাৎ পোনার প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করেই মিশ্র চাষের জন্য প্রজাতি নির্বাচন করতে হবে।

পোনার আকার ও ঘনত্ব:

সারণি: মাছ ও গলদা চিংড়ির পোনা মজুদ ঘনত্ব (শতাংশ প্রতি)

খ) পোনা শনাক্তকরণঃ চাষযাগ্যে নতুন প্রজাতি হিসেবে গলদা চিংড়ির পোনা শনাক্তকরণে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। তাই গলদা চিংড়ির পোনার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার। গলদা চিংড়ির রোস্টামের উপরের দিকে ১২-২৫টি এবং নিচের দিকে ৮-১৪ টি খাঁজ থাকে। মাথার ক্যারাপেস অঞ্চলের খোলসে ২-৫টি কালচে আড়াআড়ি দাগ থাকে। এছাড়া প্রাকৃতিক উৎস থেকে গলদা চিংড়ির পোনা চেনার আরেকটি উপায় হচ্ছে গলদা চিংড়ির রেণু স্রোতের বিপরীত দিকে সাঁতার কাটতে থাকে এবং কখনও কখনও চিৎ হয়ে সাঁতার কাটতে থাকে। এই রেণু পোনার পিঠে কালো দাগ বা ফোঁটা থাকে।

গ) পোনা শোধন: রোগজীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য পুকুরে মজুদ করার আগে পোনাগুলো জীবাণুমুক্ত করা দরকার। একটি পাত্রের মধ্যে ১০ লিটার পানিতে ১ চা চামচ পরিমাণ পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বা ২০০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ প্রস্তুত করতে হবে। প্যাকিং করার আগে উক্ত দ্রবণে পোনাগুলোকে ১ মিনিট গোসল করাতে হবে। পোনাকে গোসল করানোর আগে পাত্রটির মধ্যে একটি ঘন জাল রেখে তার ওপর পোনা ছাড়তে হয়। উক্ত দ্রবণে প্রতিবার ৩০০-৫০০ টি করে পোনা প্রায় ৫ বার গোসল করানো যায়।

ঘ) পোনা ছাড়ার সময়: মৃদু ঠান্ডা আবহাওয়ায় অর্থাৎ সকাল বা বিকেল বেলায় পুকুরে পোনা মজুদ করা ভালো। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে, মেঘলা দিনে বা ভ্যাপসা আবহাওয়ায় পোনা ছাড়া উচিত নয়। চিংড়ির পোনা সাধারণত সন্ধ্যার পর ছাড়া সবচেয়ে নিরাপদ।

Content added By

মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা

পুকুরে পোনা মজুদের পর বেশ কিছু কাজ করতে হয় যা মিশ্র চাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পোনা মজুদের পর এই সমস্ত কাজকে ৬টি ধাপে ভাগ করা যায়। যথা-

ক) পোনার বেঁচে থাকা পর্যবেক্ষণ: পরিবহন পীড়নের কারণে দুর্বল বা রোগাক্রান্ত হয়ে পোনা মারা যেতে পারে। পোনা মারা গেলে পুকুরের তলদেশে পড়ে যায় আবার অনেক সময় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মড়া পোনা পানির ওপরে ভেসে উঠে। এসব মৃত পোনা ঢেউ এর ধাক্কায় পাড়ের কাছাকাছি চলে আসে। পুকুরে পোনা মজুদের ৬-৮ ঘণ্টা পর পাড়ের কাছাকাছি পোনার চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এভাবে মৃত পোনার পরিমাণ বের করে সমসংখ্যক পোনা মজুদের ব্যবস্থা করতে হবে।

খ) সার প্রয়োগ:
সারণিঃ মজুদ পরবর্তী দৈনিক সার প্রয়োগের মাত্রা (শতাংশে) প্রয়োগের

সারমাত্রা
কম্পোষ্ট৩০০-৪০০ গ্রাম
ইউরিয়া৪-৫ গ্রাম
টিএসপি৩ গ্রাম

গ) সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ: খাদ্য দানির মাধ্যমে খাদ্য প্রয়োগ করে খাদ্যের অপচয় কমানো সম্ভব। কার্পের খাদ্য দেয়ার সময় খাদ্যদানি পানির উপরিভাগের ৩০ সেমি নিচে এবং গলদার খাদ্য দেয়ার সময় তা পুকুরের তলায় ৩০ সেমি ওপরে স্থাপন করা ভালো।
গ্রাস কার্প ও সরপুঁটির খাদ্য বাঁশের তৈরি আয়তকার ভাসমান ফ্রেমের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। ভাসমান ফ্রেমটি পুকুরের পাড় থেকে ১-২ মিটার দূরত্বে পুকুরের অভ্যন্তরে স্থাপন করতে হয়। পাতা জাতীয় উদ্ভিদ টুকরো করে কেটে ফ্রেমের মধ্যে সরবরাহ করতে হয়। এই ফ্রেমের মধ্যে সরবরাহকৃত খাদ্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে আবার খাদ্য দিতে হয়। মিশ্র চাষে কার্পের খাদ্য দিনের বেলায় সকাল ১০-১১ টার মধ্যে এবং চিংড়ির খাদ্য সন্ধ্যা ও রাতে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে পুকুরের নির্দিষ্ট জায়গায় খাদ্য সরবরাহ করা উচিত।

ঘ) মাছ ও চিংড়ির স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ: প্রজাতিভেদে সাধারণত মাছের গড় দৈনিক বৃদ্ধির হার ২-৫ গ্রাম এবং গলদা চিংড়ির বৃদ্ধি ০.৫-১%। মাছ ও চিংড়ির নমুনা সংগ্রহ করা ভালো। মোট মজুদকৃত মাছ ও চিংড়ির ৮০% বেঁচে থাকার হার ধরে তাকে নমুনার জন্য সংগৃহীত মাছ ও চিংড়ির গড় ওজন দিয়ে গুণ করে মোট পড় ওজন বের করতে হবে। এই গড় ওজনের ভিত্তিতে খাদ্য প্রয়োগ করতে হয়।

ঙ) আহরণ: একই সময় একই আকারের মাছ ও চিংড়ির পোনা মজুদ করলেও এদের বৃদ্ধি একই রকম হয় না। পোনা মজুদের ৩-৪ মাসের মধ্যে কিছু মাছ ও চিংড়ি অন্যান্য গুলির চেয়ে বড় হয়ে যায়। যেমন- চিংড়ির পোনা মজুদের ৩-৫ মাসের মধ্যে কিছু চিংড়ির ওজন ৮০-১০০ গ্রামে পৌঁছে যায়। আবার ৪-৬ মাসের মধ্যে কিছু মাছের ওজন ৫০০ গ্রামের উপরে পৌঁছে যেতে পারে। এজন্য একসাথে সব মাছ ও চিংড়ি না ধরে বড় আকারের মাছ ও চিংড়িগুলো ধরা লাভজনক। এর ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট মাছ ও চিংড়ি পরবর্তীতে দ্রুত বাড়ার সুযোগ পায়। মিশ্র চাষের ফসল দুইভাবে আহরণ করা যায়, যথা- (১) আংশিক আহরণ, ও (২) সম্পূর্ণ আহরণ।

চ) বাজারজাতকরণ: চিংড়ি আহরণের পরও চিংড়ি বেশ কিছু সময় বেঁচে থাকে। চিংড়ি আহরণের পর বাজারজাত করতে দেরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে চৌবাচ্চার পানিতে এদেরকে কয়েকদিন রাখা যায়। এতে চিংড়ির ক্ষতির কোনো আশঙ্কা থাকে না। তবে আহরণের পরপরই এদের বাজারজাত করা উত্তম। চিংড়ির গুনগতমান বজায় রাখা এবং ভালো বাজার দর পাওয়ার জন্য স্বল্প পরিমাণে চিংড়ি আহরণ করে মাথাসহ চিংড়ি পরিবহন করতে হবে। চিংড়ি ধরার পরপরই এদের ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে এবং টিউবওয়েলের পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে বরফজাত করতে হবে। 

Content added By
Promotion