চিংড়ির পোস্ট লার্ভা উৎপাদনে রুড বা মা চিংড়ির গুরুত্ব অপরিহার্য। প্রাকৃতিক উৎস থেকে রুড সংগ্রহ করলে তার গুণগতমান অনেক ভালো হয়। ব্রুড সংগ্রহের সময় স্বাস্থ্যবান এবং রোগমুক্ত চিংড়ি নির্বাচন করতে হবে। ব্লুড যেন সবল, কর্মতৎপর, উজ্জ্বল বর্ণের এবং যতটা সম্ভব বড় ও পরিপক্ক হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। ভালো মানের ব্রুড হলে পোনার মান ভালো হবে এবং অধিক পরিমাণে পোনা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
কৃত্রিমভাবে বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্রুড চিংড়ির গুণগতমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত ব্রুড চিংড়ির গুণগতমান ভালো হয়। বাগদা চিংড়ি উপকূল থেকে বহুদুরে সমুদ্রের তলদেশ থেকে শুরু করে লবণাক্ততা আছে এমন মোহনা বা উপকূলীয় নদীতেও বসবাস করে।
প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়ি মার্চ থেকে নভেম্বর এর মধ্যে সমুদ্র থেকে সংগ্রহ করা যায়। ডিমওয়ালা চিংড়ি দুই প্রকার যথাঃ সম্পূর্ণ পরিপক্ক ও পূর্ণবয়স্ক চিংড়ি। সম্পূর্ণ পরিপক্ক চিংড়ি হ্যাচারিতে এনে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করলে আপনা আপনি ডিম ছেড়ে দেয় কিন্তু পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী চিংড়ির চক্ষু দন্ড কর্তন ছাড়া ডিম দেয় না। গভীর সমুদ্রে মাছ বা চিংড়ি ধরার কাজে নিয়োজিত ট্রলার থেকে পরিপক্ক চিংড়ি সংগ্রহ করা যায়। অন্যদিকে টেকনাফের উপকূলবর্তী এলাকায় অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কিছু কিছু পরিপক্ক চিংড়ি পাওয়া যায়। স্ত্রী চিংড়ির জন্য সর্বনিম্ন ওজন ৮০-১৫০ গ্রাম এবং পুরুষ চিংড়ির জন্য ওজন ৫০-১২০ গ্রাম হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে পরিপক্ক চিংড়ি পাওয়া না গেলে খামার থেকে পূর্ণ বয়স্ক চিংড়ি সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগৃহীত চিংড়ি হতে তুলনামূলক অনেক বেশি পরিমাণে পোনা উৎপাদন করা যায়।
বাগদা চিংড়ি মজুদের জন্য সরাসরি সামুদ্রিক পানি ব্যবহার করা হয় না। প্রথমে পানি মজুদ বা স্টোরেজ ট্যাংকে থিতানোর জন্য জমা করে রাখা হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যে মজুদ ট্যাংকের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবেঃ-
ক) মজুদ ট্যাংকের পানির গভীরতা ১ মিটার রাখতে হবে।
খ) মজুদ ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা সাধারণত ৮-১৬ টন পর্যন্ত হতে পারে।
প) প্রতিদিন সকালে ও বিকালে ৪০% থেকে ৫০% পানি পরিবর্তন করতে হবে।
ঘ) পানি মজুদের পর বালি ছাকুনি (sand filtration) ব্যবহার করে পানিতে ভাসমান বা ঝুলন্ত ( suspended) পদার্থসমূহ দূর করা হয়। সামুদ্রিক পানিতে প্রচুর জীবাণু থাকতে পারে। এদের ছাকুনির মাধ্যমে সর্বাংশে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তাই রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে পানিকে জীবাণুমুক্ত করা হয়। ব্রুড চিংড়িকে প্লাস্টিকের বালতি বেসিন (bucket), চৌবাচ্চা, রেজিফোম বাক্স (regifoam box), ফাইবার গ্লাস বা গ্লাস ট্যাংকের ভেতরে মজুদ করা যায়। সাধারণত প্রতি ঘন মিটারে ১২-৩৬ টি ব্রুড চিংড়ি মজুদ করা হয়ে থাকে।
মজুন ট্যাংকের পানির গুণাগুন নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে পানির ভাপমাত্রা, লবণাক্ততা, পিএইচ (pH), দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা, অ্যামোনিয়া, নাইট্রাইট ইত্যাদি অনুকূলে রাখতে হবে।
প্যারামিটার | পরিমাণ |
---|---|
তাপমাত্রা লবনাক্ততা দ্রবীভূত অক্সিজেন পিএইচ (pH) জ্যামোনিয়া নাইট্রাইট | ২৭ ডিগ্রি সে.-৩২ ডিগ্রি সে. ২৮-৩৩ পিপিটি ৩-৪ মিলিগ্রাম/লিটার ৮.০-৮.৫ ০.৫-১৩.০ মিলিগ্রাম/ লিটার ০.৪৮-০.৯৮ মিলিগ্রাম/লিটার |
রুক্ত চিংড়িকে মজুদ ট্যাংকে কয়েক ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ পর্যন্ত রাখা হয় যতক্ষণ না পরিবহণের জন্য প্রভুত হয়ে থাকে। মজুদ ট্যাংকের পানির গুণাগুণের আকস্মিক পরিবর্তন হলে ব্রড চিংড়ি মারা যেতে পারে এবং এ থেকে সৃষ্ট পীড়নের ফলে ডিমের উৎপাদন কমে যেতে পারে। তাই পানির গুণাগুন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।
ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ পদ্ধতি পূর্ণবয়স্ক চিংড়ির পরিবহণের অনুরূপ হলেও চিংড়ির উপরে ডিমের অবস্থানের কারণে ডিমওয়ালা চিংড়ি পরিবহণে কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। কেননা একই পাত্রে অনেকগুলো চিংড়ি পরিবহণ করার সময় চিংড়ির পায়ের আঘাতে ডিম বেরিয়ে আসতে পারে।
যদি একটি পিকআপ ভ্যানের ধারণ ক্ষমতা ১ টন পিডিসি ট্যাংক বা এর সমপরিমাণ হয় তাহলে ১ ঘন্টা বা তার কম সময়ের জন্য ৪০০টি ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ করা যেতে পারে। যদি পরিবহণ দূরত্ব ৪ ঘণ্টা বা তার অধিক হয়ে থাকে তাহলে ২০০ টির বেশি রুড চিংড়ি পরিবহণ করা যাবে না। ৩০ সেমি লম্বা এবং ৬ থেকে ৮ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট প্লান্টিক পাইপের মধ্যে ব্রুড চিংড়ি প্রবেশ করিয়ে পরিবহণ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। পাইপের গায়ে অবশ্যই ৪০ থেকে ৫০টি ছিদ্র থাকতে হবে এবং পাইপের সুখ মশারির কাপড় দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।
চিত্র-১-১: ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ
পরিবহণের সময় পানির তাপমাত্রা অনুকুল অবস্থায় রাখার জন্য পিকআপ ভ্যানে পানি ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ব্লুড চিংড়িকে পরিবহণের সময় প্লাস্টিক ব্যাগে অক্সিজেন যুক্ত পানি পূর্ণ করে পরিবহণ করা যেতে পারে। প্লাস্টিক ব্যাগের পানির তাপমাত্রা অনুকুল অবস্থায় রাখার জন্য প্রতি ২ লিটার পানির জন্য ১০০ গ্রাম ওজনের বরফের টুকরা প্লাস্টিক ব্যাগের পানির মধ্যে ভাসিয়ে দিতে হবে। বরফ সংরক্ষণের জন্য পিক আপ ভ্যানের মধ্যে আইস বক্স অথবা ছোট রেফ্রিজারেটর রাখা যেতে পারে। বরফের টুকরা ব্যবহারের সময় চিংড়ির রোস্ট্রামটিতে স্পঞ্জ জাতীয় পদার্থ লাগিয়ে দিতে হবে যেন আঘাতজনিত কারণে রোস্টামটি ভেঙ্গে না যায় ।
সাধারণভাবে বাগদার ক্ষেত্রে স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়ি হাতে না নিয়ে শনাক্ত করা সম্ভব নয়। মোটামুটিভাবে ৫ গ্রাম দৈহিক ওজনের পর এদের দেহের বুকের অংশ ( vertical side) পরীক্ষা করে সহজেই স্ত্রী ও পুরুষ শনাক্তকরণ করা সম্ভব। পূর্ণবয়স্ক বাগদার সব থেকে কাছাকাছি সাঁতারের পা জোড়া যদি বুকের কাছাকাছি সংযুক্ত থাকে তবে বুঝতে হবে এরা পুরুষ। এছাড়া স্ত্রী বাগদার ৪র্থ ও ৫ম জোড়া পায়ের (walking leg) মাঝামাঝি প্রজনন অঙ্গ (genital organ) চ্যাপ্টা ও গোলাকার আকৃতির বা হৃৎপিন্ড আকৃতির (heart shape) হয়ে থাকে।
পূর্ণবয়স্ক ও ডিম্বাশয় বৃদ্ধি প্রাপ্ত স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে আলোর বিপরীত দিকে উঁচু করে ধরলে এদের পিঠের অংশে লম্বা ডিম্বাশয় দৃষ্টিগোচর হয়। স্ত্রী বাগদার পরিপক্ক ডিম্বাশয় মাথা থেকে লেজের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। তাই প্রজনন মৌসুমে পূর্ণবয়স্ক ও বয়ঃপ্রাপ্ত চিংড়ি শনাক্তকরণ করা খুবই সহজ।
হ্যাচারিতে ব্রুড চিংড়ি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও এককোষী প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে যা চিংড়ি পোনায় সংক্রমিত হয়ে থাকে। হ্যাচারি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত না রাখলে হ্যাচারিতে রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।
হ্যাচারি জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের ওপর গুরুত্ব দিলে সাধারণত পোনা রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
ক) হ্যাচারিতে ব্যবহৃত পানি ও যন্ত্রপাতি নিয়মিত জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে।
খ) প্রতিটি ট্যাংক হতে সঠিক পরিমাণে পানি পরিবর্তন করতে হবে।
গ) প্রতিটি ট্যাংকের তলদেশ নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
ঘ) ট্যাংকে গুণগতমান সম্পন্ন খাদ্য সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।
ঙ) পোনা উৎপাদন কার্যক্রম শেষে ট্যাংকসমুহ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্তকরণ করতে হবে।
চ) পানিতে সবসময় বায়ু সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
ছ) পানির তাপমাত্রা সঠিক পর্যায়ে রাখতে হবে।
সারণি প্রজনন ট্যাংকে ব্রুড চিংড়ির স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য
ক্রম | পরীক্ষনীয় বিষয় | শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯ | সংগৃহীত ব্রুড চিংড়ি রোগাক্রান্ত কি না চিংড়ির ফুলকা বিকৃত, নোংরা বা অপরিচ্ছন্ন কি না চিংড়ির ত্বকের উপর রক্তের দাগ বা সাদা দাগ আছে কি না সাঁতারের উপাঙ্গগুলো ফোলা আছে কি না সঠিকভাবে চিংড়ি খোলস পরিবর্তন করছে কি না চিংড়ির দেহাবরনীর উপর কালো দাগ বিদ্যমান কি না চিংড়ির উপাঙ্গ বা এন্টেনা ভেঙ্গে গেছে কি না দেহের আকৃতি অস্বাভাবিক কি না দেহের বর্ণ স্বাভাবিক কি না | চিংড়ির শরীরের গঠন ও চলাচল স্বাভাবিক নয়। চিংড়ির খোলস পরিবর্তন এবং বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় না। চিংড়ির খোলস পরিবর্তনে পীড়নের সৃষ্টি হয় এবং খোলস পরিবর্তনের মাধ্যমে দুর্বল চিংড়ির রূপান্তর চিংড়ির দেহের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ লক্ষ্য করা যায় এবং আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। চিংড়ির দেহাবরনীর উপর শেওলা বিদ্যমান থাকে। স্থানীয়ভাবে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত। ত্রুটিপূর্ণ পরিবহণ পদ্ধতি বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত। ডিম দেয়ার উপযুক্ত ছোট আকৃতির মাদার শ্রিম্প সাধারণত কম ডিম দিয়ে থাকে। উজ্জ্বল বর্ণের চিংড়ি সাধারণত রোগমুক্ত হয়। |
ব্রুড চিংড়ি প্রাকৃতিক উৎস থেকে সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে এনে ২৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিনে ১৫-২০ মিনিট রেখে জীবাণুমুক্তকরণ করে নিতে হবে। যদি স্ত্রী ব্রুড চিংড়িতে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক পিগমেন্টেশন অথবা ক্ষত দেখা দেয় তাহলে ৫০ পিপিএম মাত্রায় অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অথবা এরিথ্রোমাইসিন দ্রবণে ১০ মিনিট চুবিয়ে রাখতে হবে। চিংড়িকে প্রজনন ক্ষেত্র ৩-৪ দিন পরিচর্যা করা হয়। এরপর স্বাস্থ্যবান ব্লুডকে ম্যাচুরেশন ট্যাংকে স্থানান্তর করা হয়।
মা চিংড়িকে হ্যাচারিতে আনার পর হ্যাচারির পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে হয়। খাপ খাওয়ানোর জন্য হ্যাচারিতে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে চৌবাচ্চায় সমুদ্রের পানি ব্যবহার করা হয়। আশ্রয়স্থল স্থাপনের জন্য ট্যাংকে ঝরনার ব্যবস্থা রাখা উচিত। ট্যাংকের তলদেশে রুডের আশ্রয়ের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে এবং ট্যাংক ঘরের মধ্যে স্থাপন করা হয়। এখানে প্রাথমিকভাবে ব্লুড চিংড়িকে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া বা স্কুইড প্রভৃতির মাংস খাওয়ানো হয়।
ক. পানির ইনলেট পাইপ
খ. পিভিসি পাইপ
গ. পরিশোষক পাত (filter sheet)
ঘ. বালি স্তর (sand layer)
ঙ. নুড়ি পাথর স্তর (gravel layer )
চ. সমকেন্দ্রিক পিভিসি পাইপ (concentric PVC Pipe )
ছ. জীবাণু অপসারণকৃত পাইপ (removable waste pipe)
জ. আউটলেট পাইপ
সাধারণত বৃত্তাকার আকৃতির ট্যাংক আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বৃত্তাকার ট্যাংকের আয়তন ৪ মি×১.২ মি হতে হবে। বৃত্তাকার ট্যাংকটি ব্ল্যাক ফাইবার গ্লাস সিট দিয়ে নির্মাণ করা হয়। ট্যাংকের তলদেশে ১০ সেমি পুরুত্বের নুড়িপাথরের স্তর দেওয়া হয় এবং এর উপরে সিনথেটিক কাপড় রাখা হয়। সিনথেটিক কাপড়ের উপর ৫ থেকে ১০ সেমি পুরুত্বের বালির স্তর দেওয়া হয়। নুড়িপাথর স্তরে ছিদ্রযুক্ত পাইপগুলো ৯০ মিমি পুরুত্বের পিভিসি পাইপের মধ্যে বসানো হয়। এই পিভিসি পাইপ ভার্টিকাল পাইপের সাথে সংযুক্ত করা হয় যা দিয়ে সমুদ্রের পানি সরবরাহ করা হয়। পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত পাইপ ট্যাংকের কেন্দ্রে রাখা হয়। ট্যাংকের মধ্যে ইনলেট পাইপের মাধ্যমে পানি প্রবেশ করে তারপর ভার্টিক্যাল টিউবের মধ্য দিয়ে যায়। এরপর পানি ছিদ্রযুক্ত পাইপের মধ্যে, পরবর্তীতে নুড়ি পাথরের মধ্যে, পরবর্তীতে সিনথেটিক এর স্তরে এবং এরপর বালির স্তরে যায়।
৪ মি×১.২ মি আয়তনের বৃত্তাকার ট্যাংকে ৫০ থেকে ৭০টি ব্রুড চিংড়ি রাখা যায়। এক্ষেত্রে ১টি স্ত্রী চিংড়ির জন্য ১টি পুরুষ চিংড়ি রাখা উচিত। সাধারণত প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম ওজনের ৪ থেকে ৬টি ব্লুড চিংড়ি মজুদ করা হয়।
পরিপক্ক চিংড়ি মজুদের পূর্বে ব্রুড চিংড়িকে অভ্যস্তকরণ করে নেয়া হয়। ব্লুড চিংড়িকে যথাযথভাবে অভ্যস্তকরণ না করে পুকুরে মজুদ করলে চিংড়ির বেঁচে থাকার হার হ্রাস পায়। এছাড়া চিংড়ির উৎপাদিত ডিমের সংখ্যাও হ্রাস পায়। তাই চিংড়ি মজুদকালে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
বৈদ্যুতিক মোটরের সাহায্যে বাহিরের অক্সিজেন মিশ্রিত বাতাস পানির গভীরে প্রবেশ করানোর মাধ্যমে পানির ভিতরে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখার যন্ত্রের নাম এ্যারেটর। এ্যারেটর পুকুরের পরিবেশগত সামগ্রিক উন্নতির জন্য বড় ভুমিকা পালন করে থাকে।
একটি ভালো গুণসম্পন্ন এ্যারেটর নির্বাচনের জন্য যেসব সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য রাখতে হবে সেগুলো নিম্নরূপ:
চিংড়ি চাষের অগ্রগতির সাথে সাথে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিও উন্নত হচ্ছে। একটি এয়ার পাম্প ট্যাংকের বাইরে থেকে বাতাস শুষে ট্যাংকের ভিতরে নিমজ্জিত যন্ত্রপাতিতে পাম্প করে। তাই সঠিক দিক এবং সঠিক চাপে বায়ু প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়ে একটি এয়ার পাম্পের আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের বর্ণনা দেওয়া হলো-
১. এয়ারলাইন টিউবিং- এয়ার পাম্প থেকে ট্যাংকের পানিতে নিমজ্জিত সরঞ্জামে বায়ু প্রবাহকে নির্দেশ করে ভালভ চেক করতে হবে। যদি পাম্প বন্ধ হয়ে যায় বা শক্তি হারায় তবে চিংড়ির ট্যাংক থেকে পানি বের হওয়াকে বাধা দেয়।
২. এয়ার ভালভ- এয়ার পাম্প থেকে ট্যাংকে আসা বায়ু প্রবাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. টি স্প্রিটার- একটি এয়ারলাইনকে দু'টি গতিপথে বিভক্ত করে, একটি একক এয়ার পাম্পকে দু'টি ডিভাইস চালানোর অনুমতি দেয়।
৪. গ্যাং ভালভ- একটি এয়ার পাম্প থেকে চারটি ভিন্ন ট্যাংকে বায়ু প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।
৫. এয়ারলাইন হোল্ডার- ট্যাংকের ভিতরে বা বাইরে এয়ারলাইন টিউবিংকে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে একটি সাকশন কাপ ব্যবহার করে।
৬. এয়ারলাইন সংযোগকারী- দীর্ঘ দূরত্বে পৌঁছানোর জন্য এয়ারলাইন টিউবিংয়ের দু'টি টুকরো একসাথে সংযুক্ত করে।
এয়ার পাম্প, ট্যাংক ডিভাইস এবং প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক উপকরণ কিনতে এবং এয়ার পাম্প স্থাপন করতে নিম্নের মৌলিক নির্দেশাবলী অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি-
১। এয়ার পাম্পটিকে ট্যাংকের বাইরে রাখা উচিত এবং তারপরে এয়ারলাইন টিউবিংটি সঠিক দৈর্ঘ্যে কেটে দিতে হবে যাতে এটি ট্যাংকের ভিতরে এর আনুষঙ্গিক সরঞ্জামের সাথে বায়ু পাম্প সংযোগ করার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ হয়।
২। এয়ারলাইন টিউবিংয়ের এক প্রান্ত ট্যাংকের ভিতরের সরঞ্জামের সাথে সংযুক্ত করতে হবে এবং ডিভাইসটিকে ট্যাংকের ভিতরে রাখতে হবে। তারপর এয়ারলাইন টিউবিংয়ের অন্য প্রান্তটি এয়ার পাম্পের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
৩। স্পঞ্জ ফিল্টার এবং ট্যাংক ডিভাইসের মাঝখানে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় এয়ারলাইন টিউবিংটি কেটে এর মধ্যে চেক ভালভটি সংযুক্ত করতে হবে যাতে ফ্ল্যাপারসহ চেক ভালভের শেষ অংশ বায়ু পাম্পের মুখোমুখি হয়।
৪। যদি চেক ভালভটি পিছনের দিকে স্থাপন করা হয় তবে এয়ার পাম্প চালু করার সময় কোনও বায়ু প্রবাহিত হবে না, তাই চেক ভালভটির চারপাশে আলতোভাবে টোকা দিতে হবে।
৫। এয়ার পাম্পের পাওয়ার ক্যাবল দিয়ে একটি ড্রিপ লুপ তৈরি করতে হবে তারপর বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে হবে। অতঃপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ট্যাংকের ডিভাইস থেকে বুদবুদ পরিলক্ষিত হবে।
এ্যারেটর হল বায়ু চলাচলের যন্ত্র যা পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হয়। এটি দ্রবীভূত গ্যাস (যেমন- কার্বন ডাই অক্সাইড) অপসারণের জন্য পানি এবং বায়ুকে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে নিয়ে আসে এবং লোহা, হাইড্রোজেন সালফাইড এবং উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিকের মতো দ্রবীভূত ধাতুগুলিকে জারিত করে। চিংড়ি চাষিদের লক্ষ্য হল ঝুঁকি কমিয়ে সর্বোচ্চ উৎপাদন এবং মুনাফা অর্জন করা। এ্যারেটর হলো পানির গুণগত মানের ব্যবস্থাপনা এবং অক্সিজেন ঘাটতি হ্রাসের জন্য সবচেয়ে দ্রুত সমাধান প্রক্রিয়া। এটি অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড, আয়রন এবং ম্যাঙ্গানিজের মতো রাসায়নিক পদার্থগুলিকে অপসারণ করে ফলে চিংড়ি চাষের পানির গুণগতমান উন্নয়নে প্রভাব ফেলে।
এ্যারেটরের মূল উদ্দেশ্য হল অক্সিজেন সরবরাহ করা এবং পানিতে অক্সিজেন ছড়িয়ে দেওয়া। এ্যারেটর নির্বাচন করার সময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল অক্সিজেন বিচ্ছুরণ। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি বাগদা চিংড়ির বৃদ্ধি, বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এ্যারেটর অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে পানির প্রাথমিক খাদ্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। পুকুরের তলদেশে বসবাসকারী চিংড়ির মতো প্রজাতির জন্য পানির নীচের স্তরে অক্সিজেন সরবরাহ করা আবশ্যক। এ্যারেটর ব্যবহারের ফলে স্রোতের বিপরীতে চিংড়ি সাঁতার কাটে। ফলে চিংড়ির শরীরে কোনো ময়লা বা ক্ষতিকর প্রাণী লেগে থাকতে পারে না। পানিতে অক্সিজেন মেশানো ও সরবরাহের ফলে খাদ্যের অপচয় কম হয়, পানির তলদেশ পরিষ্কার হয় এবং চিংড়ি রোগমুক্ত থাকে।
কাজের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে বাজারে বিভিন্ন ধরনের এ্যারেটর পাওয়া যায়। সেগুলো হল:
ক) প্যাডেল হইল এ্যারেটর
খ) ফিস পন্ড এ্যারেটর
গ) টারবাইন এ্যারেটর
ঘ) ডিফিউজার এ্যারেটর
ঙ) সাবমারসিবল পাম্প
প্যাডেল হুইল এ্যারেটর পুকুরের উপরের স্তরে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মোটর-এর শক্তি ভেদে ২ ইঞ্চি থেকে ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত পানির নিচে ডুবানো থাকে। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ আরপিএম এ এই হুইলগুলো ঘুরে থাকে। তবে বাণিজ্যিক প্যাডেলগুলো ৯০ আরপিএম এর মতো ঘুরে থাকে যেখান থেকে প্রতি অশ্বক্ষমতার (HP) জন্য ঘন্টায় ৩ কেজি পর্যন্ত অক্সিজেন তৈরি হতে পারে। প্যাডেল হুইল এ্যারেটর এর অসুবিধা হল এ ধরনের এ্যারেটর পুকুরের তলদেশে তেমন কাজ করতে পারে না। আমাদের দেশের পুকুরের পরিবেশগত দিক বিবেচনা করলে সাবমারসিবল পাম্প সব থেকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। কারণ এটি পানির তলদেশ থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন উপরের স্তরে আসে তখন প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন পানিতে মেশাতে মেশাতে আসে এবং অধিক অক্সিজেনের কারণে পুকুরের সমগ্র পরিবেশের উন্নতি ঘটে।
চিত্র-৫.২ (ক) এ্যারেটর পাম্প, (খ) প্যাডেল হইল এ্যারেটর
বর্তমানে বেশিরভাগ চিংড়ি চাষিদের কাছে কম বিদ্যুৎ খরচের অত্যন্ত দক্ষ বৈদ্যুতিক মোটরসহ এ্যারেটর রয়েছে। সমস্ত এ্যারেটর সিস্টের এর জন্য একটি নির্দিষ্ট শক্তির উৎস প্রয়োজন। হ্যাচারি বিদ্যুতের লাইনের কাছাকাছি থাকলে খুব ভালো হয়। প্রতি ৩০০- ৫০০ কেজি অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য ১ অর্থক্ষমতার (HP) এ্যারেটর প্রয়োজন। এক অশ্বক্ষমতা বিশিষ্ট একটি এ্যারেটর এক ফটা চালু থাকলে প্রায় ১ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হয়। হেন্টর প্রতি চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রতি হেক্টরে বিদ্যুৎ খরচের পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাৰে।
ব্রুডস্টক ব্যবস্থাপনার জন্য অভ্যস্তকরণ অত্যন্ত জরুরি। ব্রুড চিংড়ি পরিবহণের পর যে পরিবেশে রাখা হবে তার নিয়ামকগুলোকে সর্বোত্তম রাখা উচিত যাকে বাগদা চিংড়ির সর্বোচ্চ বেঁচে থাকার হার নিশ্চিত করা যায়। এর ফলে চিংড়ির পরিপককরণ এবং উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের অভ্যন্তকরণের ফলে চিংড়ির টেকসই উৎপাদন, উৎপাদিত ডিমের সংখ্যা ও গুণগতমান বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও চিংড়ির পরিপক্ষতা ও প্রজননের সময় নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যদি অভান্তকরণ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে পালন না করা হয় তাহলে চিংড়ির উর্বরতার হার হ্রাস পেতে পারে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
০১ | পিভিসি ট্যাংক | মাঝারি মাপের | ১টি |
০২ | প্লাস্টিক পাইপ | পরিমাণমত | |
০৩ | মশারির কাপড় | পরিমাণমত | |
০৪ | ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিক পাইপ | পরিমাণমত | |
০৫ | বরফের টুকরো | পরিমাণমত | |
০৬ | বাগদা চিংড়ির ব্রুড | পরিপক্ক | ৪ টি |
০৭ | প্লাস্টিক ব্যাগ | মাঝারি মাপের | ৫ টি |
০৮ | আইস বক্স বা ছোট রেফ্রিজারেটর | মাঝারি মাপের | ২টি |
০৯ | স্কুপ নেট | মাঝারি মাপের | ১টি |
১০ | এয়ার/অক্সিজেন টিউব | ছোট | পরিমাণ মত |
(গ) কাজের ধারা
১। পিক-আপ ভ্যান যথাযথভাবে প্রস্তুত করো এবং তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখ। যাতে চিংড়ির ব্রুড ময়লা বা কোনো জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত না হয়।
২। ব্রুড চিংড়ি পরিবহণের পূর্বে বাছাই কর কাজটি সকাল বেলা করতে হবে কারণ বেলা বাড়ার সাথে সাথে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায় এতে পীড়নের সৃষ্টি হয়।
৩। কত দূরত্বে রুড চিংড়ি পরিবহণ করা হবে তার ওপর রুডের টেকসইকরণ নির্ভর করে। দূরবর্তী স্থানে পরিবহণের পূর্বে ব্রুড চিংড়িকে ৪৮ ঘন্টা অভুক্ত রাখ।
৪। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির ব্রুড পরিবহণের ক্ষেত্রে পাত্রের উপরের দিক বা মুখ খোলা রাখ যাতে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। এক্ষেত্রে সময়ে সময়ে পানি বদল করো। ব্রুড চিংড়ি পরিবহণের সময় পরিবহণ ট্যাংকের ভিতর পলিথিনের ব্যাগ ঢুকিয়ে তার মধ্যে চিংড়ির ব্রুড পরিবহণ করা উচিত।
৫। এছাড়া মোটা কাপড় বা ত্রিপলের তৈরি বিভিন্ন আকারের উন্মুক্ত পাত্র বিশেষ ধরনের ধাতব নির্মিত ফ্রেমে আটকিয়ে রেখে ব্রুড পরিবহণ করো। এসময় ব্যাটারি চালিত এ্যারেটর এর সাহায্যে পানিতে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করো। এতে পানিতে ছোট ছোট বুদ বুদ তৈরি হয় ফলে রুডগুলো একে অপরকে আঘাত করার কোনো সুযোগ থাকে না।
৬। স্বল্প দূরত্বে ব্রুড চিংড়ি পরিবহণের ক্ষেত্রে বদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করো। সাধারণত মোটা পলিথিন ব্যাগে ব্রুড পরিবহণ করা হয় এবং অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। পলিথিন ব্যাগ যাতে না ফেটে যায় সেজন্য কাঠের বা মোটা কাগজের তৈরি বক্সে রাখ।
৭। ব্রুড পরিবহণের সময় পিক-আপ ভ্যান ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দাও যাতে সূর্যের আলো পানিতে পৌছাতে না পারে। এতে পানির তাপমাত্রা ঠিক থাকবে এবং বাইরের ধুলাবালি ভেতরে কম প্রবেশ করবে।
৮। পিকআপ ভ্যানের আকার অনুসারে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ করো। পিকআপ ভ্যানের ধারণক্ষমতা ১ টন পিডিসি ট্যাংক এর সমপরিমাণ হলে ১ ঘন্টা বা তার কম সময়ের জন্য ৪০০ টি ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ করো। যদি দূরত্ব ৪ ঘন্টা বা তার অধিক হয়ে থাকে তাহলে ২০০ টির বেশি ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ করো না। ৩০ সেমি লম্বা এবং ৬-৮ সেমি ব্যাস বিশিষ্ট ছিদ্রযুক্ত প্লাস্টিক পাইপের মধ্যে ব্লুড চিংড়ি প্রবেশ করিয়ে পরিবহণ করো। পাইপের মুখ মশারির কাপড় দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা নাও।
৯। পরিবহণের সময় পানির তাপমাত্রা অনুকুলে রাখার জন্য পিক-আপ ভ্যানের পানি ঠান্ডা রাখার ব্যবস্থা করো। এক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যাগে অক্সিজেনযুক্ত পানি পূর্ণ করে পরিবহণ করো। পানির তাপমাত্রা অনুকুলে রাখার জন্য প্রতি ২ লিটার পানির জন্য ১০০ গ্রাম ওজনের বরফের টুকরা প্লাস্টিক ব্যাগের পানির মধ্যে ভাসিয়ে দাও। বরফ সংরক্ষণের জন্য পিকআপ ভ্যানের মধ্যে আইস বক্স অথবা ছোট রেফ্রিজারেটর রাখ।
সতর্কতা
১। পরিবহণ পাত্রের তাপমাত্রা যেন কোনক্রমেই বেশি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ২। পরিবহণকালে ব্রুড চিংড়ি যেন কোনরকম আঘাত প্রাপ্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ৩। বাগদা চিংড়ির ব্রুডগুলোকে সাবধানে হ্যান্ড গ্লোভস পরে ধরতে হবে। ৪। ব্রুড পরিবহণের তাপমাত্রা ২০-২৫ ডিগ্রি সে. এর মধ্যে রাখা উচিত। ৫। বরফের টুকরা ব্যবহারের সময় চিংড়ির রোস্ট্রামটিতে স্পঞ্জজাতীয় পদার্থ লাগিয়ে দিতে হবে যেন আঘাতজনিত কারণে রোস্ট্রামটি ভেঙ্গে না যায়। ৬। পরিবহণকৃত ব্রুড চিংড়ি হ্যাচারিতে এনে অভ্যস্তকরণ করতে হবে যাতে তাপমাত্রার ব্যবধানজনিত কোনো পীড়ন না পড়ে। |
আত্মপ্রতিফলন
বাগদা চিংড়ির ব্রুড পরিবহণ কৌশল সম্পর্কে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | প্লাস্টিকের বালতি | মাঝারি মাপের | ২টি |
০২ | প্লাস্টিকের গামলা | মাঝারি মাপের | ২টি |
০৩ | পাতিল | মাঝারি মাপের | ২টি |
০৪ | জীবাণুনাশক দ্রবণ | পরিমাণমত | - |
০৫ | মিটার স্কেল | ১ মিটার | ১ টি |
০৬ | টিস্যু পেপার | সাধারণ | ৫ টি |
০৭ | ফরমালিন | পরিমাণমত | ২ টি |
০৮ | পামছা | মাঝারি মাপের | ১ টি |
গ) কাজের ধারা
১। ব্রুড চিংড়ি সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে এনে একটি পাত্রে ২৫ পিপিএম মাত্রার ফরমালিন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করো।
২। ফরমালিনের পরিবর্তে মা চিংড়িকে হ্যাচারিতে এনে ৫ পিপিএম মাত্রার জীবাণুনাশক দ্রবণে নিয়ে জীবাণুমুক্ত করো।
৩। চিংড়িকে জীবাণুনাশক দ্রবণে ১ ঘন্টা রেখে দাও।
৪। ব্রুড চিংড়িকে শোধন এর সময় কোনো ধরনের অস্বাভাবিক ক্ষত দেখা গেলে ৫০ পিপিএম মাত্রার অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অথবা এরিথ্রোমাইসিন দ্রবণে ১০ মিনিট রাখ।
৫। চিংড়ি শোধন এর পর প্রজননক্ষম চিংড়িকে ৩-৪ দিন ব্রিডিং গ্রাউন্ড এ পরিচর্যা করো।
৬। গৃহীত কার্যপ্রণালী ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করো।
সতর্কতা
১। ব্রুড চিংড়ি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট মাত্রার রাসায়নিক দ্রবণে চুবাতে হবে। ২। রাসায়নিক দ্রবণের মাত্রা যেন কোন ক্রমেই প্রয়োজনের থেকে বেশি না হয় এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ৩। রুড শোধন এর সময় পানির তাপমাত্রা সঠিক রাখার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। |
আত্মপ্রতিফলন
ব্রুড শোধন করার কৌশল অনুশীলন করার বিষয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাক্ষ | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | ট্যাংক | মাঝারি মাপের | ২ টি |
০২ | স্কুপ নেট | মাঝারি মাপের | ২ টি |
০৩ | পাইপ | মাঝারি মাপের | ২ টি |
০৪ | বাগদা চিংড়ির ব্রুড | পরিমাণমত | - |
০৫ | বাগদা ব্রুড এর খাবার | কুচো চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, স্কুইড, কাঁকড়ার মাংস, গরু বা খাসির কলিজা ইত্যাদি | পরিমাণমত |
গ) কাজের ধারা
১। বাগদার ব্রুড চিংড়িকে জীবাণুমুক্ত করে রেস্ট ট্যাংকে ৩ থেকে ৪ দিন পরিচর্যা করে অভ্যস্তকরণ করো।
২। এ সময় স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়িকে আলাদা করে রাখ।
৩। অভ্যস্তকরণ ট্যাংকে ব্রুড চিংড়িকে পুষ্টিকর খাবার হিসেবে কুচো চিংড়ি, শামুক, ঝিনুক, স্কুইড বা কাঁকড়ার মাংস অথবা গরু বা খাসির কলিজা সরবরাহ করা উচিত।
৪। অভ্যস্তকরণ ট্যাংকের পানি প্রতিদিন সকালে ও বিকালে ৪০% থেকে ৫০% পরিবর্তন করা উচিত।
৫। ট্যাংকের পানির গভীরতা ১ মিটার রাখা উচিত এবং ট্যাংকের তলদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করো।
৬। রেন্ট ট্যাংকে এ্যারেশন নিশ্চিত করতে হবে ফলে চিংড়ি যৌন কার্য সম্পাদনে বেশি তৎপর হয়।
৭। রেস্ট ট্যাংকে এ্যারেশন হিসেবে এয়ার অক্সি টিউব ব্যবহার করা যেতে পারে।
৮। বাগদা চিংড়ির ব্রুডকে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক ও এককোষী প্রাণির আক্রমণ হতে রক্ষার জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
৯। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার পরে চিংড়িকে ম্যাচুরেশন ট্যাংকে অবমুক্ত করো। এসময় স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়িকে ১:১ অনুপাতে রাখ। ম্যাচুরেশন ট্যাংকের প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম চিংড়ি মজুদ করা যায়।
১০। এরপর ব্যবহৃত সরঞ্জামসমূহ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করো।
১১। গৃহীত কার্যপ্রণালী ব্যবহারিক খাতায় লিপিবদ্ধ করো।
সতর্কতা
১। হ্যাচারিতে ব্যবহৃত পানি ও ট্যাংক জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। ২। ট্যাংকের তলদেশ নিয়মিত পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ৩। চিংড়ি অভ্যস্তকরণ এর সময় পানিতে সবসময় বায়ু সরবরাহ ব্যবস্থা রাখতে হবে। ৪। ট্যাংকে পানির তাপমাত্রা সঠিক পর্যায়ে রাখতে হবে। ৫। চিংড়ি অবমুক্তকরণ করার সময় পুরুষ এবং স্ত্রী চিংড়ি এর অনুপাতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। |
আত্মপ্রতিফলন
ব্রুড অভ্যস্তকরণ এবং অবমুক্তকরণ করার কৌশল সম্পর্কে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন:
১। ব্রুড স্ত্রী ও পুরুষ চিংড়ির ওজন কত হওয়া উচিত?
২। এ্যারেটর কী?
৩। মজুদ পুকুরে প্রতিদিন কত শতাংশ পানি পরিবর্তন করা উচিত?
৪। আশ্রয়স্থলে চিংড়ি মজুদের হার কত?
৫। মজুদ ট্যাংকের পানির গভীরতা কত থাকা উচিত?
৬। বালি ছাকনির কাজ কী?
৭। ব্রুড চিংড়ি জীবাণুমুক্তকরণে কী কী এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন:
১। রুড চিংড়ি বলতে কী বোঝায়?
২। একটি ভালো গুণসম্পন্ন এ্যারেটর এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
৩। এ্যারেটর কত প্রকার ও কী কী?
৪। চিংড়ি অভ্যস্তকরণ বলতে কী বোঝায়?
৫। আশ্রয়স্থল তৈরির উপকরণগুলোর নাম লেখ।
৬। চিংড়ির অভ্যস্তকরণ বলতে কী বোঝায়?
রচনামূলক প্রশ্ন :
১। ব্রুড চিংড়ির পরিবহণ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
২। ব্রুড শনাক্তকরণ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
৩। রুডের স্বাস্হ্য পরিচর্যা সম্পর্কে বর্ণনা করো।
৪। প্রজনন ট্যাংকে ব্লুড মজুদের পূর্বে যে সকল বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত তা সংক্ষেপে বর্ণনা করো।
৫। আশ্রয়স্থল স্থাপনের কৌশল বর্ণনা করো।
৬। এ্যারেটর সম্পর্কে বর্ণনা করো।
গ্রীনীয় নাভিতোর উভয় পরিবেশের সামুদ্রিক পানিতে চাষের জন্য সবচেয়ে পছন্দের প্র হলো দিনাই চিংড়ি। এটি আন্তর্জাতিকভাবে ৰাব চিংড়ি (Tiger shrimp) নামে পরিচিত। অত্যন্তরীণ এবং রপ্তানি বাজারে বাগদা চিংড়ি ভালো চাহিদা রयেছে। চর চাষ উত্তের বৃদ্ধির ফলে বর্ণি চিংড়ি গোনা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হ্যাচারি প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে মা চিংড়ি সংগ্রহের পর পরিপকরণ থেকে শুরু করে পোনা উৎপাদন পর্যন্ত যাবতীয় কার্যক্রম হ্যাচারিতে সম্পন্ন করা হয়। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হ্যাচারিতে বাগদা চিংড়ির অধিক পোনা উৎপাদন ও চিংটির সর্বোচ্চ পরিমাণ ফলন নিশ্চিত করা যায়।
- এ অধ্যায়ে পাঠ শেষে আমরা-
একটি হ্যাচারি তৈরির ক্ষেত্রে তিনটি নির্ধারক রয়েছে। এগুলো হলো- অভীষ্ট প্রজাতি (Target species), উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা (Production target), এবং আর্থিক যোগান (Financial investment)।
হ্যাচারি নির্মাণের পূর্বে অভীষ্ট প্রজাতি চিহ্নিত করতে হবে ও বাজারের চাহিদা এবং আর্থিক যোগানের ওপর ভিত্তি করে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে, যা হ্যাচারির নকশা তৈরির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। হ্যাচারির প্রকারভেদ সাধারণত হ্যাচারির কার্যকরী প্রয়োজনীয়তা এবং অর্থনৈতিক দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। হ্যাচারির আকার বা আয়তনের ওপর ভিত্তি করে তিনভাগে ভাগ করা হয়।
এটি এমন একটি হ্যাচারি যা চাষি তার নিজের পরিবারের চাহিদা মেটাতে বা অতিরিক্ত শ্রমের জন্য নিজ পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় পরিচালনা করে। মূল লক্ষ্য হলো হ্যাচারিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোনা উৎপাদন করা যা দিয়ে নিজের চাহিদা মিঠানোর পাশাপাশি প্রতিবেশি চাষিদের কাছে বিক্রি করা। এটি সাধারণত ১০০০ বর্গমিটারের মধ্যে হয়ে থাকে। পোনা উৎপাদনের পরিমাণও কম হয়। বছরে ৪০-৫০ লক্ষ পোস্ট লার্ভার বেশি হয়না এবং ২ জন কারিগরী কর্মী দ্বারা হ্যাচারি পরিচালিত হয়। এ ধরনের হ্যাচারির মূলধন বিনিয়োগের জন্য সাধারণত ২০-২৫ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হয়। হ্যাচারিতে ব্যবহৃত চৌবাচ্চার আয়তন ১০ টনের কম হয়। কম ঘনত্বে অপরিশুদ্ধ পানি ব্যবহৃত হয়। তাই পোনা বাঁচার সম্ভাবনা ০- ৯০%। দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোতে এ ধরনের হ্যাচারির অনেক জনপ্রিয়তা রয়েছে।
এইসব হ্যাচারি বিনিয়োগকৃত মূলধন, হ্যাচারির আকার, হ্যাচারির উৎপাদন ক্ষমতা এবং পরিচালনার পরিপ্রেক্ষিতে ছোট আকারের হ্যাচারির চেয়ে তুলনামূলকভাবে বড়। তবে হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা ছোট আকারের হ্যাচারির মতই। বছরে পোস্ট লার্ভা উৎপাদনের পরিমাণ ১.০-২.০ কোটি এবং তিনজন কারিগরী কর্মী, ৩-৪ জন শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে পরিশোধিত পানি বেশি ঘনত্বে ব্যবহার করা হয়। পোনা বাঁচার হার প্রায় ৪০% বা তার কম। ছোট সমবায় সমিতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এ ধরনের হ্যাচারিগুলো সাধারণত তাদের সদস্য চাষিদের প্রয়োজনীয় বাগদা চিংড়ির পোনা সরবরাহ করে থাকে।
বড় আকারের হ্যাচারি পরিচালনার জন্য বড় কর্পোরেশন, সরকারি সংস্থা বা সমবায় প্রকল্পের সহায়তা প্রয়োজন হয়। এ হ্যাচারিগুলো বাণিজ্যিকভাবে পোনা উৎপাদন এবং সরবরাহ করে। এক্ষেত্রে মূলধন কয়েক লক্ষ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চিংড়ি পোনা উৎপাদন করা হয়। সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা থাকে এবং সর্বোচ্চ ৬ জন কারিগরী কর্মী এবং ৬-১০ জন শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত হয়। বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ ২.০ কোটির বেশি হতে পারে। এখানে পোনা বাঁচার হার সর্বোচ্চ প্রায় ৬০ শতাংশ।
বাগদা চিংড়ির হ্যাচারি সফলভাবে পরিচালনার জন্য স্থান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্যিকভাবে বাগদা হ্যাচারি পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে লোনাপানির প্রয়োজন তাই সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী স্থানে বাগদা হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত। নির্বাচিত স্থানে যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা থাকতে হবে। বাগদা চিংড়ি হ্যাচারির স্থান নির্বাচনের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া উচিত -
ব্রুড চিংড়ি বাগদা হ্যাচারির প্রাণ। তাই যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে রুড চিংড়ি পাওয়া যাবে সেখানে বাগদা চিংড়ির হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত।
সমুদ্রের পার্শ্ববর্তী স্থানে বাগদা চিংড়ির হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত কারণ পোনা উৎপাদনের জন্য ২৮-৩২ পিপিটি লবণাক্ত সমৃদ্ধ লোনাপানি প্রয়োজন। ব্রুড চিংড়ি প্রতিপালন ও বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের জন্য লোনাপানির নিম্নোক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভৌত-রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার।
সারণি: বাগদা হ্যাচারির পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ
হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করার জন্য স্বাদুপানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। তাই হ্যাচারি স্থাপনের সময় স্বাদুপানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এমন জায়গায় হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে যেখানে কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য পদার্থ, শহরের নর্দমার দূষিত পানি, কৃষি জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ঔষধ, রাসায়নিক দ্রব্যাদি ইত্যাদি যাতে হ্যাচারির পানি দূষিত করতে না পারে।
অত্যধিক বৃষ্টির কারণে হ্যাচারির পানির গুণাগুণ যেমন- পানির তাপমাত্রা, পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং বিশেষ করে লবণাক্ততার তারতম্য হতে পারে যা চিংড়ির পোনা উৎপাদনে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করতে পারে তাই হ্যাচারি স্থাপনের ক্ষেত্রে অতি বৃষ্টিজনিত এলাকা পরিহার করতে হবে।
হ্যাচারি নির্মাণের পূর্বে এবং স্থান নির্বাচনের সময় মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ পানির ভৌত-রাসায়নিক গুণাগুণ সরাসরি মাটির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করে। তাই যেখানে হ্যাচারি স্থাপন করা হবে সেই এলাকার ভূ-প্রকৃতি বিবেচনায় নিতে হবে। এছাড়া ভূ-প্রকৃতির ওপর হ্যাচারির নির্মাণ খরচ অনেকাংশে নির্ভর করে।
হ্যাচারি নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের উপকরণ পরিবহণ, হ্যাচারিতে উৎপাদিত রেণু ও পোনা সরবরাহ, ব্রুড চিংড়ি পরিবহণ এবং খাবার সরবরাহের জন্য ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এমন স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত।
সুষ্ঠভাবে হ্যাচারি পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ থাকা জরুরি। তাই বিদ্যুতের সুব্যবস্থা রয়েছে এমন স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে। হ্যাচারি পরিচালনার জন্য বিদ্যুৎ সবচেয়ে সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক।
দক্ষ জনশক্তি ছাড়া লাভজনকভাবে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন সম্ভব নয়। তাই দক্ষ জনশক্তির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে হ্যাচারি স্থাপন করা উচিত।
হ্যাচারির উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য হ্যাচারিতে ব্যবহৃত ঔষধ, যন্ত্রপাতি, ব্রুড চিংড়ি, পোস্ট লার্ভা, খাদ্য, আর্টিমিয়া ইত্যাদি সহজেই পাওয়া যায় এমন স্থানে হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সহজেই সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকতে হবে।
এমন এলাকায় চিংড়ি হ্যাচারি স্থাপন করতে হবে যেখানে কৃষি বা অন্যান্য ফসলের ফলন বা চাষ হয় না। অন্যথায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা বা পরিবেশগত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হতে পারে।
হ্যাচারির কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য জনবলের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা অতীব জরুরি। এতে চুরিসহ অন্যান্য বিপদের আশঙ্কা থাকে না।
বাগদা চিংড়ির কৃত্রিম প্রজনন থেকে শুরু করে চিংড়ি চাষ পর্যন্ত লোনা পানির সুব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ অতি জরুরি। তাই প্রতিটি হ্যাচারির পানি ব্যবস্থাপনা এবং খরচ কমানোর জন্য একটি নির্ভরযোগ্য এবং দক্ষ সেচযন্ত্র বাধ্যতামূলকভাবে থাকা উচিত। হ্যাচারিতে লোনা এবং মিঠাপানি উত্তোলন করে নির্দিষ্ট ট্যাংকে মজুদ করা হয়। পরবর্তীকালে মজুদকৃত ট্যাংক থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়।
হ্যাচারিতে যন্ত্রপাতি পরিচালনা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন উপকরণ সচল রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ অপরিহার্য। এয়ার ব্লোয়ার, পাম্প, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি চালু রাখার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুতের উৎস থাকতে হবে। এছাড়াও যেসব এলাকায় ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে সেসব এলাকার হ্যাচারিতে নিজস্ব জেনারেটর থাকা প্রয়োজন।
পানিতে পর্যাপ্ত দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব বজায় রাখার জন্য সর্বদা বায়ু চলাচল অপরিহার্য। প্রজননক্ষম চিংড়িকে বাঁচিয়ে রাখা, জীবন্ত খাবার (live food) উৎপাদন, লার্ভার লালন-পালন প্রভৃতি কাজের জন্য কৃত্রিম বায়ু প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ব্যাসের পিভিসি পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি ট্যাংকে কৃত্রিমভাবে বায়ু সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। পিভিসি পাইপের মুখে সরু প্লান্টিকের পাইপ ও এয়ার স্টোন ব্যবহার করে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এতে পানির তাপমাত্রা ও অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাগদা হ্যাচারিতে লোনাপানি সংগ্রহের পর নির্দিষ্ট ট্যাংকে মজুদ রাখা হয়। ট্যাংকের আকার ও আয়তন নির্ভর করে পোনা উৎপাদনের পরিমাণের ওপর। উত্তোলিত পানি সরাসরি ব্যবহার না করে প্রথমে জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করা হয়।
মজুদকৃত লোনা পানিতে প্রচুর পরিমাণে বালি এবং ভাসমান ও ঝুলন্ত (suspended) পদার্থ থাকে। এজন্য পরিস্রাবক (filter) স্থাপন করা জরুরি। পরিস্রাবক হলো এমন এক ধরনের সূক্ষ যন্ত্র যা রাসায়নিক প্রক্রিয়া বা জৈবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পানির মধ্যে বিদ্যমান দূষিত পদার্থ ও জীবাণু অপসারণ করে। পানি পরিস্ফুত করতে বিভিন্ন ধরনের পরিস্রাবক ব্যবহার করা যায়। যেমন-
ক) বালি, কংকর দিয়ে তৈরি পরিস্রাবক
খ) চাপ প্রয়োগকৃত বালি দিয়ে নির্মিত পরিস্রাবক
গ) কার্টিজ পরিস্রাবক
ঘ) ইউভি পরিস্রাবক
ঙ) কার্বন পরিস্রাবক ইত্যাদি।
চিংড়ির হ্যাচারিতে একটি বালি ছাকুনি স্থাপন করা প্রয়োজন। ছাকুনি ব্যবস্থাটি মজুদ ট্যাংক সংলগ্ন স্থানে নির্মাণ করা যেতে পারে। সামুদ্রিক পানিতে প্রচুর জীবাণু থাকে যা ছাকুনির মাধ্যমে নির্মূল বা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করে পানিকে সম্পূর্ণভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয় এবং মজুদ ট্যাংকে জমা রাখা হয়।
পরিপক্ককরণ ট্যাংক হলো এমন এক ধরনের কংক্রিটের তৈরি চৌবাচ্চা যেখানে প্রজননক্ষম স্ত্রী এবং পুরুষ বাগদা চিংড়িকে প্রজনন ক্ষেত্র থেকে সংগ্রহের পর সংরক্ষণ করা হয়। এখানে স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়িকে প্রজননক্ষম করে তোলার চেষ্টা চালানো হয়। প্রথমদিকে এদেরকে শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া ও স্কুইডের মাংস খেতে দেয়া হয়। এতে চিংড়ির প্রজনন ক্ষমতা বাড়ে। চিংড়ির ডিমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অনেক সময় স্ত্রী চিংড়ির একটি চোখ অপসারণের কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে। এসময় স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়িকে একসাথে রাখা হয়। প্রজননক্ষম বাগদা চিংড়িকে পীড়নমুক্ত রাখতে ট্যাংকটি কালো শীট দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। এসময় ট্যাংকে পরিষ্কার পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কৃত্রিম বায়ু প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। ট্যাংকের ধারণক্ষমতা সাধারণত ৮-১৬ টন পর্যন্ত হতে পারে।
প্রজনন ট্যাংক হলো এমন এক ধরনের চৌবাচ্চা যেখানে প্রজননক্ষম স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে প্রজনন না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে ধরে রাখতে ব্যবহৃত হয়। তবে প্রজননক্ষম চিংড়ি প্রজনন ট্যাংকে স্থানান্তরের পূর্বে লক্ষ্য রাখতে হবে যে স্ত্রী চিংড়ি খোলস পাল্টিয়েছে কি-না। এ ট্যাংকের আকার সাধারণত ১.৫ টন পর্যন্ত হতে পারে।
সদ্য ডিম ফোটানো লার্ভা পালনের জন্য যে ট্যাংক ব্যবহার করা হয় তাকে লার্ভি পালন ট্যাংক বলে। হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের পরিমাণের ওপর এ ট্যাংকের আকার ও আয়তন নির্ভর করে। ট্যাংকের আকার বর্গাকার, গোলাকার বা আয়তাকার হয়ে থাকে। এ ট্যাংকে পিএল-১ থেকে পিএল-১৫ পর্যন্ত পালন করা যায়। তবে অনেক সময় কোন কোন হ্যাচারিতে বিভিন্ন স্তরের লার্ভি প্রতিপালনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আয়তনের ট্যাংক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত লার্ভি প্রতিপালন ট্যাংকের আয়তন ২ থেকে ৪০ টন পর্যন্ত হতে পারে।
প্লাংকটন হলো পানিতে থাকা এক ধরনের জীব যা স্রোতের বিপরীতে নিজেদেরকে চালিত করতে অক্ষম। প্লাংকটন অনেক ছোট বড় জলজ প্রাণির খাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিটোসেরাস (Chaetocerus), স্কেলোটোমা (Skeletoma), নাভিকুলা (Navicula), রটিফেরা (Rotifera) প্রভৃতি এই ট্যাংকে চাষ করা হয়। এসব প্লাংকটন বাগদা পোনার জীবনচক্রের প্রথম পর্যায়ে খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়। এটি চিংড়ির খাদ্য হিসেবে একটি চমৎকার সংযোজন এবং পোনার বিকাশের জন্য সর্বোত্তম উৎস।
আর্টিমিয়া চিংড়ির জন্য দ্রুত বর্ধনশীল খাদ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এদের ডিমগুলো লবণাক্ত হ্রদ থেকে সংগ্রহ করার পর শুকনো করে মৎস্য খামারে পাঠানো হয়। শুষ্ক আর্টিমিয়ার ডিম কয়েক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। প্রয়োজনের সময় ডিম ফুটে নগ্নি উৎপাদন করা হয়। নগ্নি উৎপাদনের জন্য কোণাকৃতির ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। এসময় মৃদু লবণাক্ত পানিতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ডিম দিয়ে প্রচন্ড বায়ু প্রবাহ চালু করা হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে নগ্নি বের হয়। যা বাগদা চিংড়ির পোনার খাবার হিসেবে সরবরাহ করা হয়।
হ্যাচারি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। এসব যন্ত্রপাতি যন্ত্রের সাথে সংরক্ষণ করা দরকার। হ্যাচারির উৎপাদন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিম্নলিখিত যন্ত্রপাতি প্রয়োজন
অণুবীক্ষণ যন্ত্ৰ (Microscope)
টিস্যু হোমোজিনাইজার (Tissue homogenizer)
ক্যামেটর (Catheter)
থার্মোমিটার (Thermometer)
রিফ্লাক্টোমিটার (Reflactometer)
ডিসেন্ডিং বক্স (Dissociating box)
ডিপ ফ্রিজার (Deep freezer)
এ্যামেটর (Aemator)
অক্সিজেন সিলিন্ডার (Oxygen cylinder)
মাপন যন্ত্র (Balance)
সেন্ট্রিফিউজ (Centrifuge)
সিরিজ (Syringe)
পিএইচ মিটার (pH meter)
অক্সিজেন মিটার (Oxygen meter)
রেফ্রিজারেটর (Refrigerator)
জেনারেটর (Generator)
বৈদ্যুতিক চুলা (Electric heater)
দ্য সেক্কি ডিস্ক (Secci disc)
প্লাংকটন গণনাকারী এস আর সেল (Plankton counting S.R. cell)
ব্লেন্ডার (Blender)
ডেসিকেটর (Dedicator)
হেক করাত (Hack saw)
ক্যালকুলেটর
আগুন নিভানোর যন্ত্র
বিভিন্ন মেসের জাল
হেক কীট (Hack kit)
ট্রলি/পিক আপ ভ্যান
কম্পিউটার
হাত জাল
আসবাবপত্র
অফিস সরঞ্জামাদি
এছাড়াও গবেষণাগারে ব্যবহৃত বিভিন্ন কাঁচের সামগ্রী যেমন- বিকার, বিভিন্ন ধরনের পেট্রিডিস, কনিক্যাল ফ্লাস্ক, ওয়াচ গ্লাস, ম্যাগনিফাইং গ্লাস, টেস্টটিউব, পিপেট ইত্যাদি থাকা অত্যন্ত দরকার।
হ্যাচারিতে পোনার উৎপাদন সচল রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকারের খাদ্য সামগ্রী ও রাসায়নিক দ্রব্যাদির সরবরাহ সবসময় থাকা দরকার-
ক) আর্টিমিয়া
খ) আর্টিমিয়া ফ্লেক
গ) প্লাংকটন বীজ
ঘ) প্লাংকটন উৎপাদক সারসমূহ
ঙ) এনক্যাপসুলেটেড খাদ্য
চ) স্পিরুলিনা খাদ্য
ছ) ফরমালিন
জ) পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট
ঝ) ব্লিচিং পাউডার
ঞ) ম্যালাকাইট গ্রিন
ড) কৃত্রিম প্লাংকটন
ট) আয়োডিন পলিমার
ঢ) এ-৩০-জুমসাইড
ঠ) সোডিয়াম থায়োসালফেট
ণ) এন্টিবায়োটিকস ইত্যাদি
প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়ি সংগ্রহের উপযুক্ত সময় হলো মার্চ থেকে নভেম্বর মাস। চিংড়ি সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে আনার পর এগুলোকে প্রথম ৪-৭ দিন নির্দিষ্ট ট্যাংকে রেখে অভিযোজিত করা হয়। হ্যাচারিতে আনার পর ২৫-৫০ পিপিএম পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট দ্রবণে এদের জীবাণুমুক্ত করা হয়। পরিপক্ক ট্যাংকের প্রতি বর্গমিটারে ১০০-২০০ গ্রাম ওজনের ২-৭টি চিংড়ি ১:১ (স্ত্রী: পুরুষ) অনুপাতে মজুদ করা হয়। স্ত্রী চিংড়ির ওজন কমপক্ষে ৬৩-৬৮ গ্রাম এবং পুরুষ চিংড়ির ওজন কমপক্ষে ৩৫-৪০ গ্রাম হওয়া উচিত। ট্যাংকের ৬০% পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হয়। এসময় চিংড়ির দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা হয়।
পরিপক্ক ট্যাংকে ৭-৮ দিন রাখার পর সন্ধ্যায় পানি কমিয়ে স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বকোষের উন্নতি লক্ষ্য করা হয় যা বাইরে থেকেই দেখা যায়। অন্যদিকে পরিপক্ক পুরুষ চিংড়ির পঞ্চম চলনপদের পোড়ায় পুংজনন ছিদ্রে শুক্রকীটের মোড়ক (spermatophores) দেখা যায়। ডিম্বাশয়ের পূর্ণতা নির্ভর করে ডিম্বাশয়ের আকার, রং ও ডিম্বানুর মাপের ওপর। পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়কে ৫টি দশায় ভাগ করা যায়।
ক) অপরিণত/অপরিপক্ক পর্যায় (Immature stage): এ অবস্থায় ডিম্বানু খুব ছোট থাকে। ডিম্বাশয় পাতলা ও স্বচ্ছ থাকে। তবুও পিঠের খোলসের ভিতর নিয়ে ডিম্বানু দেখা যায় না। ভিমের গড় আকার ০.০২৮ মিমি হয়।
খ) উন্নয়নশীল পর্যায় (Early developing stage): এ পর্যায়ে ডিম্বাশয় এর পরিপক্কতা শুরু হয়। ডিম্বাশয়ে স্বচ্ছ থেকে হালকা জলপাই রঙের লম্বা ফিতার মত ডিম্বানু দেখা যায় যা খোলসের বাইরে থেকে পরিলক্ষিত হয়। এসময় ডিমের গড় আকার ০.০৭৮ মিমি হয় ।
গ) প্রায় পরিপর পর্যার (Nearly ripe stage): ডিম্বাশয় এর রং ঘন হতে থাকে এবং হালকা নীল বর্ণ ধারণ করে। ডিম্বাশয়ের দুই পার্শ্ব বর্ধিত হয়ে কিছুটা ডায়মন্ড বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে। ভিমের গড় আকার ০১৮৮ মিমি হয়।
ঘ) পরিপক্ক পর্যায় (Ripe stage): এ সময় ডিম্বাশয় সম্পূর্ণরূপে পরিপক্কতা লাভ করে। উদর অঞ্চল প্রার সম্পূর্ণ স্থান দখল করে ডিম্বাশয় বর্ষিত হয়। গাঢ় সবুজ রঙের পরিপূর্ণ ভায়ন বা প্রজাপতির আকার ধারণ করে। ডিমের গড় আকার হয় ০.২৩১ মিমি।গ
ঙ) পরিপক্ক পরবর্তী পর্যায় (Spent ripe stage): এ পর্যায়ে ডিম ছেড়ে ডিম্বাশয় পুনরায় প্রথম দশার জাকার ধারণ করে। তবে অনেক সময় আংশিক ডিম ছেড়ে দ্বিতীয় দশার মতো দেখায়। এ পর্যায়ে সাদা রং পরিলক্ষিত হয় তবে স্বচ্ছ নয়। একটি পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ির বছরে ভিন্ন ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩.০ থেকে ৭.৫ লক্ষ।
বাগদা চিংড়ির প্রজনন ক্রিয়া: সম্পূর্ণরূপে পরিপক্ক বাগদা চিংড়ির প্রজনন গভীর সমুদ্রে রাত্রিকালে সম্পন্ন হয়। প্রথমে পুরুষ চিংড়ির ওপর স্ত্রী চিংড়ি সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। এরপর একে অপরকে অক্ষীয়দেশ বরাবর আকড়ে ধরে এবং পুরুষ চিংড়ি স্ত্রী চিংড়ির দেহের নিচে সমাপ্তরালভাবে অবস্থান করে। শেষ পর্যায়ে পুরুষ চিংড়ি তার উদরের অংশ বাকিয়ে “ট” আকৃতির বেষ্টনী তৈরি করে। এভাবে তাদের মিলন সংঘটিত হয় যা ৩-৪ মিনিট স্থায়ী হয়।
বাগদা চিংড়ির প্রজনন ক্রিয়া সম্পন্ন হলে স্ত্রী বাগদাকে আলাদা ট্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। সাধারণত একটি ট্যাংকে একটি স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে অথবা ৩০০ লিটার এর ট্যাংকে ২-৩ টি স্ত্রী বাগদা চিংড়িকে রাখা হয়। স্থানান্তরের পূর্বে নিশ্চিত করতে হয় যে মিলন ঘটেছিল কি-না। স্ত্রী চিংড়ির থেলিকামে স্পার্মাটোফোরের উপস্থিতি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়। এসময় স্পনিং ট্যাংকের পানির তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি রাখা হয়। পানির লবণাক্ততা সাধারণত ২৮-৩০ পিপিটি রাখা হয়। সর্বক্ষণের জন্য একটি বায়ু সঞ্চালন যন্ত্র, তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র এবং পানি গরম করার যন্ত্র সংযুক্ত রাখা হয় এবং উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা হয়।
সাধারণত রাত ১.০ থেকে ২.০ টার মধ্যে স্ত্রী বাগদা চিংড়ি ডিম ছাড়ে। স্ত্রী চিংড়ি তার তৃতীয় ভ্রমণ পদের গোড়ায় অবস্থিত জননেন্দ্রিয় পথে ডিম ছাড়ে এবং একই সাথে থেলিকাম থেকে শুক্রকীট মুক্ত করে এবং সাঁতারের মাধ্যমে ডিমগুলো ছড়াতে সাহায্য করে। ডিম ছাড়তে ২-৭ মিনিটের মতো সময় লাগে। এরপর স্ত্রী বাগদাকে তুলে অন্য ট্যাংকে স্হানান্তর করা হয় এবং ডিম ফুটতে সময় দেয়া হয়। ১২-১৫ ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়। প্রাথমিকভাবে এসব লার্ভাকে খাবার দেয়া হয় না। এরা ১০-১৫ মিমি আকার ধারণ করার পর এদেরকে লার্ভা ট্যাংকে স্থানান্তরিত করা হয় এবং সেখানে বিভিন্ন ধরনের ফাইটোপ্লাংকটন ও জুপ্লাংকটন খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করা হয়।
লার্ভা হলো চিংড়ির ডিম ফুটে বের হবার পর প্রাথমিক দশা। লার্ভা তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায় অতিক্রম করে। যথা- নপ্রির ৬টি ধাপ, প্রোটোজোয়াল ৩টি ধাপ এবং মাইসিসের ৩টি ধাপ। নগ্নি থেকে প্রোটোজুইয়া হতে ৪৮ ঘন্টা সময় লাগে এবং মাইসিস হতে ৬ দিন সময় লাগে। এরপর মাইসিস থেকে পোস্ট লার্ভা হতে আরও ৩ দিন সময় লাগে। অর্থাৎ ডিম ফোঁটা থেকে পোস্ট লার্ভা হতে ৯ দিনের মতো সময় ব্যয় হয়। এ পর্যায়ে এদেরকে খাদ্য হিসেবে ফাইটোপ্লাংকটন এবং জুপ্লাংকটন সরবরাহ করা হয়।
ডিমের নিষিক্তকরণ এর পর লার্ভা হয় এবং লার্ভা পরবর্তী দশাকে পোস্ট লার্ভা বলে। প্রজননের সময় থেকে পোস্ট লার্ভা পর্যন্ত পৌছাতে এক মাসেরও বেশি সময় প্রয়োজন। এদেরকে নার্সারি ট্যাংকে প্রতিপালন করা হয়। পিএল-৬ বা পোস্ট লার্ভা ষষ্ঠ দিনে পৌঁছে গেলে এদেরকে কোকুন, ঝিনুক এর মাংসের কিমা খাওয়ানো হয়। দিনে ৩-৪ বার কৃত্রিম খাদ্যের সাথে এসব খাবারের মিশ্রণ তৈরি করে খাওয়ানো হয়। এসময় পানির গুণগত মান বজায় রাখার জন্য ৩০-৪০% পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করা আবশ্যক। এতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের ঘনত্ব এবং অ্যামোনিয়ার কম ঘনত্ব (০.১ পিপিএম) এর সম্পৃক্ততা বজায় থাকে। অতিরিক্ত খাদ্য, বিপাকীয় বর্জ্য এবং মৃত শৈবাল অপসারণের জন্য ট্যাংকের নিচে নিয়মিত সাইফনিং এর ব্যবস্থা করা হয়। লবণাক্ততার পার্থক্য ৩-৪ হলে পোস্ট লার্ভা মারা যেতে পারে। তাই লবণাক্ততা ৩০-৩২ পিপিটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
সাধারণত চিংড়ির লার্ভাকে ফাইটোপ্লাংকটন, জুপ্লাংকটন, ডেট্রিটাস, পলিকেট, ছোট ক্রাস্টেসিয়ান সরবরাহ করা হয়। তবে নগ্নি অবস্থায় এরা খাবার গ্রহণ করে না কেননা তাদের নিজেদের শরীরের কুসুম থলি থেকে তারা পুষ্টি গ্রহণ করে। প্রোটোজোয়া পর্যায়ে খাবার গ্রহণ শুরু হয়। তবে বয়সের সাথে সাথে এদের খাদ্য পছন্দ পরিবর্তিত হয়। প্রাথমিকভাবে এরা ফাইটোপ্লাংকটন পছন্দ করলেও পরবর্তীতে অন্যান্য খাবারের প্রতি আকৃষ্ট হয়। লার্ভার বিভিন্ন খাদ্য তালিকা নিম্নরূপ-
ক) জমাট শুকনো খাদ্য- Spirulina পাউডার (Freeze dried feed)
খ) Microparticulate বা ক্ষুদ্রকণায় পরিণত যৌগিক খাদ্য।
গ) Microencapsulated diet (অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড সমৃদ্ধ আর্টিমিয়া)।
প্রাণিজ জীবন্ত খাদ্য চিংড়ির লার্ভার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক খাদ্য উপাদান কারণ লার্ভার পাচনতন্ত্র অসম্পূর্ণ এবং এতে এনজাইমের অভাব রয়েছে। তারা লার্ভা অবস্থায় নিজস্ব প্রয়োজনীয় পুষ্টি তৈরি করতে সক্ষম নয়। তাই জীবন্ত খাবার সরবরাহের মাধ্যমে লার্ভার পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা হয়। তাই হ্যাচারিতে জীবন্ত খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা রাখা হয়। এতে খরচও কমে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যেরও যোগান হয়। রটিফার, আর্টিমিয়া, কপিপোডসহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিজ খাদ্যের উৎপাদন করা হয়। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণিজ খাদ্য চাষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চৌবাচ্চা বা পরিবেশ দরকার। লোনা ও মিঠা উভয় পানির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব ট্যাংক সাধারণত ১-২০ টন পর্যন্ত হয়ে থাকে। হ্যাচারির প্রয়োজন অনুযায়ী এসব ট্যাংক নির্মাণ করা হয়। জীবন্ত খাদ্য চাষের পর এগুলোকে সংরক্ষণ করার মত সুযোগ সুবিধা রাখা হয় যেন পরবর্তীতে ব্যবহার করা যায়। তবে আর্টিমিয়ার ব্যবহার সুপরিচিত এবং সহজবোধ্য হিসেবে বিবেচিত। এসব প্রাণিজ খাদ্য পুষ্টিমান সমৃদ্ধ। হ্যাচারিতে চিংড়ির সর্বোত্তম ফলন নিশ্চিত করার জন্য মাইক্রোএলজি, ডায়াটম, ডেট্রিটাস সহ অন্যান্য প্রজাতির খাদ্যও চাষ করা হয়।
পরিবেশের সর্বোত্তম অবস্থা বজায় রাখতে চাষকৃত বাগদা চিংড়ির বেঁচে থাকার জন্য এবং ফলনের সর্বাধিক বৃদ্ধির জন্য দৈনন্দিন পরিচর্যা আবশ্যকীয়। যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিচর্যা করা হয় সেগুলো নিম্নরূপঃ
ক) পানির গুণগতমান পর্যবেক্ষণ
খ) খাদ্য ও খাদ্য পরিকল্পনা
প্রথম পর্যায়ে প্রোটোজোয়ার পরিপূর্ণ বিকাশ হয় না এবং তারা খাদ্যের সন্ধান করতে পারে না। এসময় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। প্রোটোজোয়ার খাদ্য হিসেবে ট্যাংকে ডায়াটম চাষ করলে অনেক সময় এদের অধিক ফলন হয় যা লার্ভার চলাচলে বাধা হয়ে দাড়ায়। অন্যদিকে ডায়াটমগুলো পরেরদিন সহজেই নষ্ট হয়ে যায় এবং পানির গুণগত মানকে নষ্ট করে। অক্সিজেনের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। তাই নিয়মিত ডায়াটমের ঘনত্ব পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ডায়াটমের রং বাদামী হয়ে গেলে, নতুন ডায়াটম যোগ করতে হয় যাতে লার্ভার পর্যাপ্ত খাবারের ঘাটতি না থাকে। পোস্ট লার্ভার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্টিমিয়াসহ আরও অন্যান্য খাদ্য উপাদান যোগ করা হয়। এতে লার্ভার বৃদ্ধি দ্রুত হয়। প্রতি ১০,০০০ পোস্ট লার্ভার জন্য ৫০ গ্রাম আর্টিমিয়া নিশ্চিত করতে হয়। গ্রীষ্মকালে ডায়াটমের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে ট্যাংকের ওপর ছায়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা ট্যাংকের কিছু অংশের পানি অপসারণ করে পুনরায় নতুন লবণাক্ত পানি দিয়ে ট্যাংক পূর্ণ করা হয়। এভাবে বাগদা চিংড়ির খাদ্য প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করা হয়।
অন্যান্য পরিচর্যা
যেসব রোগের সংক্রমণে বাগদা চিংড়ির চাষ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয় সেগুলো হলো ভাইরাল, ব্যকটেরিয়াল ও ফাংগাল সংক্রমণ। রোগ সংক্রমণের প্রধান কারণগুলো হলো-
উপরোক্ত কারণগুলোর সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করলে হ্যাচারিতে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকে। হ্যাচারিতে যেসকল রোগ দেখা দেয় তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
চিংড়ি চাষের সবচেয়ে ক্ষতিকর জীবাণুগুলোর মধ্যে আলোকদায়ক জীবাণু একটি। চিংড়ির বহিত্বক বা অস্ত্রে অথবা অন্যান্য অঙ্গে হয়ে থাকে। চিংড়ি বেশি মাত্রায় এ রোগে আক্রান্ত হলে ধীরে ধীরে মৃত্যু মুখে পতিত হতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া প্রথমে যকৃত ও অগ্নাশয় গ্রন্থিকে আক্রান্ত করে এবং পরিশেষে দেহের বিভিন্ন স্থানে গর্ত তৈরির মাধ্যমে আক্রান্ত করে। Vibrio harveyi, V. splendidus প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়া এ রোগের জন্য দায়ী।
লক্ষণ
১) যকৃত ও অগ্নাশয় গ্রন্থি বাদামী বর্ণ ধারণ করে।
২) অগ্নাশয় গ্রন্থি ছোট হয়ে যায়।
৩) দেহে গর্ত দেখা যায় এবং পরিশেষে উপাঙ্গের উপরের অগ্রভাগ পচন ধরে।
প্রতিকার
১) Quinoline antibiotic ব্যবহার করা হয়।
২) মাইক্রোএলজি, ব্যাকটেরিওফাজ ও প্রোবায়োটিক এর ব্যবহার ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ কমাতে পারে।
৩) প্রতিদিন ৮০% পানি পরিবর্তন করে নতুন পানি যোগ করতে হবে।
হ্যাচারিতে ভাইরাসের আক্রমণ বেশি হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোনা মারা যায়। সংক্রমণ রোধে সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। বাগদা চিংড়ির ভাইরাসজনিত রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার নিম্নরূপ:
ব্যাকুলো (Baculovirus penaei) ভাইরাস
এ ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে রিপোর্ট করা এবং ভালভাবে বর্ণিত একটি ভাইরাস। এটি তাইওয়ানে প্রথম শনাক্ত করা হয়। এটি চিংড়িকে প্রথমে প্রোটোজুইয়্যা ধাপে এবং পরে মাইসিস ধাপে আক্রান্ত করে। বেশিরভাগ সময় ৯০% পোনা মারা যায়।
লক্ষণ
১) হেপাটোপ্যানক্রিয়াস এবং মিডগাট এপিথেলিয়াল কোষে একাধিক গোলাকার ছোট সাদা পাইপের মত দেখা যায়।
২) চিংড়ি খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দেয়।
প্রতিকার
১) এ রোগের কোনো নির্দিষ্ট বা সঠিক চিকিৎসা নেই। তবে আক্রান্ত পোনাকে কিমা করা ওয়েস্টার (oyester) এর মাংস খাওয়ানো হয়।
২) পর্যাপ্ত পরিমাণে বায়ু সঞ্চালক ব্যবহার করে তাদের পরিচর্যা করা হয়।
৩) হ্যাচারি ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে হবে।
৪) সংক্রমণ রোধ করতে ডিম এবং নগ্নিকে ৩ ঘন্টা যাবৎ পরিষ্কার লবণাক্ত পানিতে ধৌত করে তারপর ট্যাংকে স্থানান্তর করতে হবে।
এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ যা প্রায় সব বাগদা চিংড়ির হ্যাচারিতে আক্রমণ ঘটায়। সংক্রামক জীবাণু হলো Phycomycetus fungi, Lagenidium sp., Sirolpidium sp., Phythium; Leptolegonia mania প্রভৃতি।
লক্ষণ
১) আকস্মিক মৃত্যু ঘটে এবং মৃত্যুর হার ২০-১০০%।
২) লার্ভার দেহে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিকার
১) লার্ভার ট্যাংক জীবাণুমুক্তকরণ, পানি পরিস্রাবণ, ক্লোরিনেশন করা উচিত।
২) বিভিন্ন ধরনের এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যায়। যেমন: ০২ পিপিএম (ইফান (Treflan)।
৩) ১-১০ পিপিএম ফরমালিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪) NaCl, KCI, MgCl এর মিশ্রণে ব্যবহৃত ঔষধ Legenidium এর আক্রমণকে হ্রাস করে।
৫) ২০ পিপিএম পরিষ্কারক সাবান গুড়া (Detergent) দিয়ে ডিম জীবাণুমুক্তকরণ করা যেতে পারে।
ক্লোরামফেনিকল, সারাফ্লক্সাসিন, অক্সিটেট্রাসাইক্লিন ও এনরোফ্লক্সাসিন প্রায়শই বাগদা চিংড়ির এন্টিবায়োটিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তবে অধিক পরিমাণে ব্যবহারে প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়। ক্লোরামফেনিকল ব্যবহার না করাই উত্তম এতে লার্ভার ক্ষতি হয়। প্রতিষেধক ঔষধ এবং এদের প্রয়োগ মাত্রা নিম্নরুপ:
ঔষধ | মাত্রা |
---|---|
অক্সিটেট্রাসাইক্লিন অক্সোলিনিক এসিড ফিউরাসল (Furasol ) জেনটিন ভায়োলেট (Gentin violet) ফরমালিন (Formalin ) | ১০-২০ পিপিএম ০.১-০.৫ পিপিএম ১.০-২.৫ পিপিএম ০.১-০.২ পিপিএম ২৫-৫০ পিপিএম |
জৈব নিরাপত্তা হলো পানিতে চাষযোগ্য সকল মাছ, চিংড়ি, অন্যান্য জলজ প্রাণির রোগ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে হ্যাচারি, খামার এসব জায়গা থেকে নির্দিষ্ট জীবাণুগুলো বাদ দেয়ার কৌশল। বাগদা চিংড়ি চাষে প্রাসঙ্গিক ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে, সেগুলো হ্রাস করার জন্য উপযুক্ত জৈব নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর করা উচিত।
ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি
যে কোনো হ্যাচারি তৈরির সময় প্রাথমিকভাবে যে ট্যাংকগুলো নির্মাণ করা হয় সেগুলো হলো- প্রজনন ট্যাংক, মজুদ ট্যাংক, লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক, পোস্ট লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক, মিঠা ও লবণাক্ত পানির ট্যাংক, পরিশুদ্ধ পানির ট্যাংক, ব্রুডস্টক প্রতিপালন ট্যাংক ইত্যাদি।
ডিমওয়ালা চিংড়ি প্রতিপালন ট্যাংক: সংগৃহীত চিংড়ি হ্যাচারিতে আনার পর এই ট্যাংকে এদের প্রতিপালন করা হয়। ট্যাংকের আকৃতি গোলাকার, বর্গাকার বা আয়তাকার হতে পারে। উচ্চতা সাধারণত ১.২-২.০ মিটার এবং ধারণ ক্ষমতা ৫-৪০ টন হয়। হ্যাচারির পোনা উৎপাদনের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে ট্যাংকের আকার ও আয়তন বিভিন্ন হয়ে থাকে। প্রতিটি ট্যাংকে পানি অপসারণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে করে নিয়মিত পানি পরিবর্তন করে পুনরায় নতুন পানি যোগ করা যায়।
প্রজনন ট্যাংক: এ ট্যাংকগুলো সমতল বিশিষ্ট অথবা কোণাকার তল বিশিষ্ট হতে পারে। ফাইবার গ্লাস, প্লাস্টিক, প্লাস্টিক গ্লাস সিট ইত্যাদি দ্বারা তৈরি করা হয়। এদের পানি ধারণ ক্ষমতা ৫০ লিটার থেকে ১.৫ টন পর্যন্ত হতে পারে। লবণাক্ততা ২৮-৩২ পিপিটি এবং তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সে. এর কাছাকাছি রাখতে হয় এবং সবসময় পর্যবেক্ষণ করতে হয়।
লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক: সদ্য ডিম ফোটানো লার্ভা প্রতিপালনের জন্য দুই ধরনের ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। একটি ছোট আয়তনের অন্যটি বড় আয়তনের। তবে আমাদের দেশে সাধারণত ৩ টন ধারণ ক্ষমতার লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক ব্যবহার করা হয়। নগ্নিকে খাবার প্রদান করা হয় না। তবে প্রোটোজোয়া পর্যায়ে পৌঁছানোর পর থেকে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইটোপ্লাংকটন, ঈষ্ট, এলজি, ডায়াটম এসব সরবরাহ করা হয়। ডায়াটমের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা অপসারণের ব্যবস্থাও করতে হয়। নিয়মিত পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা রাখতে হয়। পানির নিয়ামকগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকা উচিত এতে পানির গুণগতমান বজায় থাকে।
পোস্ট লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংক: পোন্ট লার্ভা প্রতিপালনের ট্যাংকগুলোতে একটি স্তর হিসেবে পলিথিন জাল প্রদান করা হয়। লার্ভা পালনের এই পর্যায়ে পানির গুণগতমান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময় ৩০- ৪০% পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করা হয়, এতে অক্সিজেনের ঘনত্ব, অ্যামোনিয়ার ঘনত্ব (০.১ পিপিএম এর কম) নিশ্চিত করা যায়। অতিরিক্ত খাদ্য, বিপাকীয় বর্জ্য ও মৃত শৈবাল অপসারণের জন্য ট্যাংকের নিচের পানি সাইফনিং করা হ্যাচারির একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নিয়মিত কাজ। লালন পুকুরের ৫০% পানি নিষ্কাশন হয়ে গেলে ২-৩ ঘন্টার জন্য সমুদ্রের পানির অবিরাম প্রবাহ বজায় রাখা হয়। এতে আটকে থাকা কঠিন কণাগুলো নিষ্কাশন হয় এবং পানির স্বচ্ছতা বজায় থাকে। যখন ট্যাংকের নিচে পলি জমে পুরু স্তর হয় তখন পোস্ট লার্ভাগুলোকে অন্য ট্যাংকে স্থানান্তরিত করা হয়। পোস্ট লার্ভাকে রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত।
জীবন্ত খাদ্য চাষ ট্যাংক: এই ট্যাংকগুলো সাধারণত ১-২০ টনের মধ্যে হয়ে থাকে। তবে হ্যাচারির চিংড়ি চাষের পরিমাণের ওপর এই ট্যাংকগুলোর আয়তন নির্ভর করে। এগুলো ফাইবার গ্লাস, পলিথিন, পাতলা কাঠ, কংক্রিট প্রভৃতি দিয়ে নির্মাণ করা হয়। চাষের প্রাণিগুলোকে নিয়মিত খাবার প্রদান করা হয় এবং ট্যাংকগুলোতে পানি সরবরাহ ও অপসারণের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী এগুলো পরিষ্কার করা হয়, এতে ফলন বৃদ্ধি পায়।
লার্ভার সর্বশেষ ধাপ হলো পোস্ট লার্ভা। এসময় বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভাগুলোকে আলাদা আলাদা চৌবাচ্চায় স্থানান্তর করা হয় এবং এসব চৌবাচ্চার আকার ও আয়তন লার্ভা প্রতিপালন ট্যাংকের সদৃশ হয়ে থাকে। পোস্ট লার্ভাকে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক, কৃত্রিম ও জীবন্ত খাদ্য সরবরাহ করা হয়। দ্রুত বৃদ্ধির জন্য আর্টিমিয়া জাতীয় প্রাণিকণা দেয়া হয়। এছাড়াও ডায়াটম, মাইক্রোএলজি, জমাট শুকনো খাদ্য ( Spirulina powder), মাইক্রোএনক্যাপসুলেটেড আর্টিমিয়া, শামুক, উচ্ছিষ্ঠ মাছের কিমা ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে বাগদা চিংড়ির পোনার দ্রুত বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। নিয়মিত নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি পরিবর্তন করে নতুন পানি যোগ করতে হয়। ফলে ট্যাংকের পানির তাপমাত্রা, অক্সিজেনের ঘনত্ব, অ্যামোনিয়ার ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে থাকে।
পানির গুণগতমান রক্ষা করতে সার্বক্ষণিক বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। এছাড়াও রোগ জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে নিয়মিত প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ বাধ্যতামূলক। উপরোক্ত ব্যবস্থাপনাগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের মাধ্যমে বাগদা চিংড়ির সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব।
নিকটতম একটি বাগদা চিংড়ির হ্যাচারি পরিদর্শন কর। হ্যাচারির বিভিন্ন অংশ শনাক্ত ও হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি চিহ্নিত করে নিম্নোক্ত ছক পুরণ কর-
পরিদর্শনকৃত চিংড়ি হ্যাচারির নাম | |
ঠিকানা | |
১. চিংড়ি উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণের নাম | ১. ২. ৩. |
২. হ্যাচারিতে কর্মরত জনবলের সংখ্যা | ১. |
৩. কর্মীগণ কর্তৃক কাজের সময় ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামগুলোর নাম | ১. ২. ৩. |
৪. বাগদা চিংড়ি হ্যাচারির বিভিন্ন অংশের নাম | ১. ২. ৩. |
৫. হ্যাচারিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতির নাম ও পরিচালনা পদ্ধতি সংক্ষেপে লিখ | ১. ২. ৩. |
৬. দৈনন্দিন হ্যাচারি পরিচর্যা, রোগ ও তার প্রতিকার পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ কর | ১. ২. ৩. ৪. |
নাম | |
শ্রেণি | |
রোল নং | |
প্রতিষ্ঠানের নাম | |
শ্রেণি শিক্ষকের নাম | |
প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শ্রেণি শিক্ষকের স্বাক্ষর |
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | প্লাস্টিকের বালতি | ১০ লিটার | ২ টি |
০২ | প্লাস্টিকের গামলা | মাঝারি মাপের | ২ টি |
০৩ | বাগদা চিংড়ি | পরিপক্ক স্ত্রী ও পুরুষ | ২ টি |
০৪ | ওজন মাপার যন্ত্র | সুক্ষ ও ইলেকট্রিক | ১ টি |
(গ) কাজের ধারা
প্রজননক্ষম স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়ি সংগ্রহের পর হ্যাচারিতে এনে এদের মধ্যে যাদের প্রজননের জন্য বাছাই করা হবে তাদের শনাক্ত করতে হবে। স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়ি শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া নিম্নরূপ:
স্ত্রী বাগদা চিংড়ি | পুরুষ বাগদা চিংড়ি |
১। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী বাগদা চিংড়ি আকারে ছোট এবং দ্বিতীয় হাঁটার পা তুলনামূলকভাবে ছোট এবং চিকন বা সরু হয় । ২। এদের ঘাড়ের অংশ ছোট থাকে তবে পেট বড় আকারের। ৩। তৃতীয় হাঁটার পা এর গোড়ায় যৌনাঙ্গের ছিদ্র থাকে। ৪। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের প্লুরা লম্বা এবং এরা ডিম ধারণের প্রকোষ্ঠ গঠন করে। ডিম ফুটে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত ডিম ধারণ করে রাখা এ প্রকোষ্ঠের কাজ। ৫। পেটের প্রথম খন্ডের নিচের দিকে কোনো পিন্ড থাকে না। ৬। স্ত্রী বাগদা চিংড়ির পায়ে প্রজননে ব্যবহৃত সিটা (ছোট লোম) থাকে যা ডিমের পরিপক্ককরণে সাহায্য করে। ৭। শেষ তিন জোড়া হাঁটার পা এর মাঝে ডিম্বাণু ধারণের জন্য ফাঁপা অংশ থাকে। | ১। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাগদা চিংড়ির দ্বিতীয় হাঁটার পা অনেক বড় ও মোটা। এরা আকারেও বড় হয়। ২। ঘাড়ের অংশ বড় কিন্তু পেট সরু থাকে। ৩। পঞ্চম হাঁটার পা এর গোড়ায় যৌনাঙ্গের ছিদ্র থাকে। ৪। পুরুষ বাগদা চিংড়ির পেটে অবস্থিত প্লুরা আকারে ছোট। ৫। পেটের প্রথম খন্ডের নিচের দিকে একটি পিন্ড রয়েছে যার কেন্দ্রে একটি শক্ত অংশ থাকে এবং আঙ্গুল দিয়ে অনুভব করা যায়। ৬। পুরুষ বাগদা চিংড়ির দেহের নিচের অংশে প্রজনন সিটা অনুপস্থিত। ৭। শেষ তিন জোড়া হাঁটার পা এর মাঝখানে শুক্রাণু ধারণের কোন ফাঁপা অংশ থাকে না । |
সতর্কতা
১। শনাক্তের সময় যেন বাগদা চিংড়ির কোন উপাঙ্গ ভেঙ্গে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ২। ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিসপত্র জীবাণুমুক্ত করতে হবে। তা নাহলে চিংড়িতে রোগজীবাণু ছড়াবে ও রোগাক্রান্ত হবে। |
আত্মপ্রতিফলন
প্রজনন উপযোগী স্ত্রী ও পুরুষ বাগদা চিংড়ি শনাক্তকরণ কৌশল সম্পর্কে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | বায়ু সঞ্চালক যন্ত্র | ছোট | ২ টি |
০২ | প্লাস্টিক বা কাঁচের পাত্র | মাঝারি মাপের | ৪ টি |
০৩ | পরিষ্কার মিঠা ও লোনা পানি | পরিমাণমত | |
০৪ | পলিভিনাইল টিউব | পরিমাণমত | |
০৫ | আর্টিমিয়া ডিম | পরিমাণমত |
(গ) কাজের ধারা
১। আর্টিমিয়া ডিম ফুটানোর জন্য একটি কোণাকৃতির পাত্র জীবাণুমুক্ত করে নাও।
২। ডিম ফুটানোর আগে প্রায় ১৫-২০ মিনিটের জন্য পরিষ্কার সমুদ্রের পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নাও।
৩। ডিম ভালোভাবে ফোটানোর জন্য প্রায় ৩.৬ গ্রাম ডিমকে এক লিটার পানিতে ভিজিয়ে রাখ।
৪। আর্টিমিয়ার নগ্নি সাধারণত আলো প্রতিবেদনশীল হয় তাই আলোর মাধ্যমে এদেরকে একটি কোণে আকৃষ্ট করো।
৫। ডিম থেকে নল্লি বের হওয়ার পর বায়ু চলাচল বন্ধ করে ৫-১০ মিনিট অপেক্ষা করো যাতে করে ডিমের খোসাগুলো ডুবে যায় এবং সদ্য ফোটা নগ্নি আলোর দিকে সাঁতার কাটতে থাকে।
৬। একটি পলিভিনাইল টিউব দিয়ে নগ্নিগুলোকে সাইফনিং করো বা হেঁকে নাও।
৭। সদ্য সংগ্রহকৃত পরিষ্কার সামুদ্রিক পানি দিয়ে নল্লিগুলোকে ধুয়ে নাও এবং প্রায় ২০ লিটার ধারণক্ষমতার একটি পরিষ্কার পাত্রে রাখ।
৮। এরপর এই আর্টিমিয়া নগ্নি চিংড়ির লার্ভাকে সরবরাহ করো।
সতর্কতা
১। আর্টিমিয়ার ডিম সংগ্রহের পর খুব ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে যাতে কোন রকম জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। ২। আর্টিমিয়ার ডিম ফুটানোর জন্য সার্বক্ষণিক বায়ু সঞ্চালনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ৩। আর্টিমিয়ার ডিমে এক ধরনের গন্ধ লক্ষ্য করা যায়। এ গন্ধ দূর করার জন্য ভালোভাবে ধৌত করতে হবে। |
আত্মপ্রতিফলন
লার্ভার খাদ্য হিসেবে আর্টিমিয়া চাষের প্রক্রিয়া সম্পর্কে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে চিংড়ি চাষ করা হয়। তবে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে পোনা সংগ্রহের সময় অন্যান্য জলজ প্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই হ্যাচারিতে চিংড়ির পোনা উৎপাদনকে উৎসাহিত করা হয়। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উভয় উৎস থেকে সংগৃহীত পোনার পরিবহণ ও প্যাকিং প্রক্রিয়া প্রায় একই রকমের হয়ে থাকে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
|
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | শেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
১. বালতি
২. ওজন মাপার যন্ত্র
৩. গামলা
৪. স্কুপনেট
৫. থার্মোমিটার
৬. প্লাস্টিকের ব্যাগ
৭. বাগদা চিংড়ির পোনা
৮. রাবার ব্যান্ড
৯. কাগজের/কাঠের/স্টিলের বাক্স
১১. পরিষ্কার পানি
১২. বায়ু সঞ্চালক
১৩. বরফ
(গ) কাজের ধারা
১। প্রাকৃতিক উৎস বা হ্যাচারি থেকে বাগদা পোনা সংগ্রহ করো।
২। সংগ্রহের পর পোনার পরিমাণ সঠিকভাবে গণনা করো।
৩। দুটি পলিথিন ব্যাগের (৩ × ২ ফুট) একটিকে আরেকটির মধ্যে ভরে নাও এবং পানি দিয়ে দেখে নাও পলিথিন ব্যাগে কোনো ছিদ্র আছে কি-না।
৪। এরপর ব্যাগে ৪-৫ লিটার পানি ভরে নাও এবং পানি ভর্তি ব্যাগে ২-২.৫ হাজার পোনা স্থানান্তর করো।
৫। পোনা স্থানান্তরের পর পরই পলিথিন ব্যাগের বাকি অংশ অক্সিজেন দিয়ে পূর্ণ করে ব্যাগের মুখ রাবার ব্যান্ড দ্বারা ভালভাবে বন্ধ করো ।
৬। পুনরায় আরেকটি পলিথিন ব্যাগে কয়েক টুকরো বরফ দিয়ে তার ভিতর পোনাসহ পলিথিন ব্যাগটি প্রবেশ করাও।
৭। সবশেষে ইনসুলেটেড বাক্সে পোনাসহ পলিথিন ব্যাগগুলো বসিয়ে বাক্সটিতে আরও কয়েক টুকরো বরফ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে দাও যাতে করে পানির তাপমাত্রা কমে যায়। ফলে পোনার অক্সিজেনের পরিমাণ কম লাগে এবং শারীরতাত্ত্বিক কাজও হ্রাস পায়। এতে পোনার মৃত্যুহার কমে এবং এভাবে পোনা পরিবহণ কাজ সম্পন্ন করা হয়।
সতর্কতা
১। পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ২। পানির লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ৩। সকাল অথবা বিকালে পোনা পরিবহণ করা উচিত। ৪। পরিবহণের আগে পোনাকে খাদ্য সরবরাহ করা যাবে না। ৫। মেঘলা দিনে বা অতিরিক্ত রৌদ্রে পোনা পরিবহণ করা উচিত নয়। ৬। পোনা এমনভাবে পরিবহণ করতে হবে যাতে এর উপাঙ্গগুলো ভেঙ্গে না যায়। |
আত্মপ্রতিফলন
বাগদা চিংড়ির পোনা প্যাকিং ও পরিবহণ কৌশল সম্পর্কে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন :
১। বাগদা চিংড়ির হ্যাচারি কত প্রকার?
২। বাগদা চিংড়ির পোনা উৎপাদনের জন্য পানির লবণাক্ততা কত থাকা প্রয়োজন?
৩। বাগদা চিংড়ির হ্যাচারির পানির তাপমাত্রা কত থাকা উচিৎ ?
৪। বাগদা চিংড়ির হ্যাচারির পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কত থাকা উচিত?
৫। প্লাংকটন কী?
৬। আর্টিমিয়া কী?
৭। পরিপক্ক স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়কে কয়টি দশায় ভাগ করা যায়?
৮। কত ঘন্টার মধ্যে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়?
৯। মাইসিসের ধাপ কয়টি?
১০। নগ্নির ধাপ কয়টি?
১১। পোস্ট লার্ভা কী?
১২। লার্ভাল মাইকোসিস কী ধরনের রোগ?
১৩। নল্লি থেকে প্রোটোজুইয়া হতে কত ঘন্টা সময় লাগে?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন:
১। বায়ু সঞ্চালন পাম্প বলতে কী বোঝায়?
২। পানি পরিস্রাবক কত প্রকার ও কী কী?
৩। স্ত্রী চিংড়ির ডিম্বাশয়ের পরিপক্কতার বিভিন্ন পর্যায়ের নাম লেখ।
৪। পোস্ট লার্ভাকে কী ধরনের খাবার দেয়া হয়?
৫। চিংড়ির হ্যাচারিতে রোগ সংক্রমণের প্রধান কারণগুলো লেখ।
৬। আলোকদায়ক জীবাণুজনিত রোগের লক্ষণসমূহ লেখ।
৭। জৈব নিরাপত্তা বলতে কী বোঝায়?
রচনামূলক প্রশ্ন:
১। বাগদা চিংড়ির হ্যাচারির স্থান নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বর্ণনা করো।
২। বাগদা চিংড়ির হ্যাচারির বিভিন্ন অংশের বর্ণনা দাও।
৩। প্রজননের জন্য চিংড়ি বাছাইকরণ প্রক্রিয়া বর্ণনা করো।
৪। পোস্ট লার্ভার খাদ্য সম্পর্কে বিশদভাবে বর্ণনা করো।
৫। হ্যাচারির দৈনন্দিন পরিচর্যা বর্ণনা করো।
৬। হ্যাচারিতে বাগদা চিংড়ির কী কী রোগ হয় এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে লেখ।
৭। হ্যাচারির পানি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আলোচনা করো।
চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো চিংড়ির নার্সারি ব্যবস্থাপনা। নার্সারি পুকুর অস্থায়ী নিয়ন্ত্রিত জলাধার হিসেবে কাজ করে। যেখানে চিংড়িগুলোকে খামারের অবস্থার সাথে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নেয়া হয়। এজন্য সংগৃহীত পোস্ট লার্ভা নার্সারিতে ১৫-২০ দিন লালন পালন করে ঘেরে ছাড়া হয় ফলে পোস্ট লার্ভার মৃত্যুহার কমে যায় এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতিতে চিংড়ির সম্ভাব্য রোগ ও চাপের কারণ এবং স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত যেকোনো সমস্যা সহজেই প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করা যায়। নার্সারি সঠিকভাবে পরিচালনা করা না হলে অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন: পানির গুণগতমান নষ্ট হওয়া, চিংড়ির স্বাস্থ্যের ঝুঁকি এবং উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি। সুষ্ঠু নার্সারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিংড়ির ভালোভাবে বেঁচে থাকা, রোগের ঝুঁকি কমানো এবং চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। বাগদা চিংড়ি শিল্পের সাফল্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হলো নার্সারির সঠিক ব্যবস্থাপনা।
এ অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা-
বাগদা চিংড়ির নার্সারি বলতে বোঝায় যেরের এমন একটি স্থান যেখানে চিংড়ির পোনাকে ১৫-২০ দিন য সহকারে লালন পালন করে মূল ঘেরে ছাড়ার উপযোগী করে তৈরি করা হয়। নার্সারি পুকুর সাধারণত মংস্যকুক বা অবাঞ্ছিত প্রাণিমুক্ত, প্রাকৃতিক খাবার সমৃদ্ধ, দূষণ ও রোগজীবাণু মুক্ত, কম গভীরতা সম্পন্ন ছোট আকারের হয়ে থাকে। নার্সারি পুকুরের আয়তন সাধারণত উৎপাদন পুকুরের দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে থাকে। চিংড়ির পোনার আকার তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ার সরাসরি পুকুরে মজুদ করলে গভীরতাজনিত কারণে গোনা যারা যেতে পারে। এছাড়া পরিবেশের তারতম্য, পোস্ট লার্ভার পীড়ন, পরিবহণজনিত ধকল, ঠিক খাপ না খাওয়ানোর কারণেও পোনা মারা যেতে পারে। তাই চিংড়ি পোনার বেঁচে থাকার হার বৃদ্ধির নার্সারি ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘেরে অল্পদিনের জন্য নার্সারি পুকুর তৈরি করে পোনা লালন পালন করলে পোনার বেঁচে থাকার হার অনেকাংশে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
চিত্র-৩.১ বাগদা চিংড়ির নার্সারি পুকুর
দেশের চিংড়ি চাষিরা হ্যাচারি ও প্রাকৃতিক উভয় উৎস থেকেই বাগদা চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করে থাকে। পোনাগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ, পরিবহণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করলে মজুদকালীন অথবা মজুদ পরবর্তী সময়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পোনা মারা যেতে পারে। তাই চিংড়ি হ্যাচারি থেকে সংগৃহীত ছোট আকারের পোনা মজুদ পুকুরে ছাড়ার পূর্বে পোনাকে বড় ও সবল করে তোলার জন্য নার্সারি পুকুরে যত্ন সহকারে পরিচর্যা করতে হয়। একাজ করার উত্তম উপার হলো মার্সারি পুকুরে পোনার বর নেওরা। নার্সারি পুকুরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উল্লেখ করা হলো-
ক) বাগদা চিংড়ির পোনার যত্ন ও পরিচর্যা ভালোভাবে নেওয়া যায়
খ) ঘেরের পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
গ) সহজ উপায়ে পোনাকে খাবার প্রদান করা যায়।
ঘ) প্রয়োগকৃত খাবার পোনা সহজে খুঁজে পায়। উৎপাদন পুকুরে সরাসরি পোস্ট লার্ভা মজুদ করার চেয়ে নার্সারি পুকুরে অধিক ঘনত্বে পোনা মজুদ করলে খাদ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
ঙ) পোনা সুস্থ স্বাভাবিক ও শক্তিসম্পন্ন হয়।
চ) সরাসরি মজুদ পুকুরে পোনা মজুদের চেয়ে নার্সারি পুকুরে লালন করলে পোনার মৃত্যুহার কম হয়।
ছ) চিংড়ির পোনার বেঁচে থাকার হার সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়।
জ) নার্সারি পুকুরে পোনার সার্বিক রক্ষণাবেক্ষণ ভালো হয়।
ঝ) উৎপাদন পুকুরে অতিরিক্ত মজুদ ঘনত্ব এড়ানো সম্ভব হয়।
ঞ) চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাপের পোনা সময়মত পাওয়া যায়।
ট) পালন পুকুরে চিংড়ি পোনার মজুদ ঘনত্ব স্থিতিশীল অবস্থায় রাখা যায়।
ঠ) অবাঞ্ছিত বা রাক্ষুসে প্রাণির হাত থেকে চিংড়ি পোনাকে রক্ষা করা সম্ভব হয়।
ড) নার্সারি পুকুরে প্রতিপালনের ফলে চিংড়ি চাষির আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা কম থাকে, এবং
ঢ) নার্সারি ব্যবস্থাপনা ভালো হওয়ায় চিংড়ির রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।
নার্সারি পুকুরের স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন-
ক) মাটির পানি ধারণ ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দোঁআশ, এটেল বা বেলে দোঁআশ মাটি নার্সারি পুকুর তৈরি করার জন্য উপযুক্ত।
খ) যে জায়গার মাটি মোটামুটি ভালো গুণসম্পন্ন এবং পাড়ের কাছাকাছি জায়গায় নার্সারি পুকুর তৈরি করা উচিত।
গ) ঘেরের যে অংশটি তুলনামূলকভাবে গভীর ও পাহারা দেওয়ার জন্য সুবিধাজনক সে জায়গায় নার্সারি স্থাপন করা ভালো।
(ঘ) মাটির পিএইচ ৫-৬ এর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে মাটি অম্লীয় হলে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে তা উপযুক্ত করে নিতে হবে
নার্সারি পুকুর ভালোভাবে তৈরি করা হলে পোনার মজুদকালীন মৃত্যুহার কমে যায় এবং পোনার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়। এক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা বাঞ্ছনীয় -
ক) নার্সারি পুকুরে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ ফুট পানি থাকা প্রয়োজন।
খ) ঘন জাল দিয়ে নার্সারি তৈরি করতে হবে।
গ) নার্সারির জাল তলার মাটিতে কমপক্ষে ৫-৬ ইঞ্চি পরিমাণ গভীরে পুঁতে দিতে হবে এবং পানির উপরে ১ হাত পরিমাণ বেশি রাখতে হবে। জাল যেন বাতাসে পড়ে না যায় সেজন্য বাঁশের খুঁটির সাথে শক্ত করে বেধে দিতে হবে।
ঘ) নার্সারির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শুকনো লতা-পাতা, গাছের ডাল দিয়ে চিংড়ির আশ্রয়স্থল তৈরি করে দিতে হবে। এতে একদিকে যেমন পোনার আশ্রয়স্থল হবে অন্যদিকে জন্মানো পেরিফাইটন পোনার প্রাথমিক খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
ঙ) নার্সারির মাটি বা তলদেশ সমতল হওয়া ভালো।
চ) ঘেরের যে কোনো একপাশে বাঁশ বা বাঁশের চট ও নাইলনের জাল দিয়ে ঘিরে ঘেরের মোট আয়তনের ৫-৭ ভাগ আকারের নার্সারি তৈরি করতে হবে।
নার্সারি পুকুরের আয়তন সাধারণত উৎপাদন খামারের দশ ভাগের এক ভাগ হওয়া উচিত। তবে একটি নার্সারি পুকুরের আয়তন ৫০০ বর্গমিটার হলে ভালো। নার্সারির আকার বা আয়তন নির্ভর করে মূলত নার্সারির ধরন, পোনা মজুদের পরিমাণ, পালন ঘেরের আয়তন, নার্সারিতে পোনা কত দিন রাখা হবে ইত্যাদির ওপর। এক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলা উচিত-
ক) যদি পালন ঘের এক বিঘা বা ৩৩ শতাংশ হয় তাহলে নার্সারি পুকুরের আয়তন হবে ৩-৫ শতক।
খ) নার্সারি পুকুরের আয়তন এক বিঘার বেশি হওয়া উচিত নয়। যদি দরকার হয় তাহলে বড় ঘেরের ক্ষেত্রে কয়েকটি নার্সারি পুকুর তৈরি করা যেতে পারে।
চিংড়ির পোস্ট লার্ভার লালন পালন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো যথাযথভাবে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করা। নার্সারি পুকুর প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন-
ঘের ও নার্সারি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে প্রথমে ৫-৬ টি স্থানের মাটির পিএইচ মেপে দেখতে হবে। পরবর্তীতে পরিমাপকৃত মাটির পিএইচের ওপর ভিত্তি করে নার্সারি ও ঘেরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ চুন দিতে হবে।
ক) বাগদা চিংড়ির ঘের ও নার্সারি তৈরির সময় তলার দিকে এবং পাড়ের উপরের অংশে প্রতি শতকে ১ কেজি হারে পোড়া চুন প্রয়োগ করতে হবে।
খ) এছাড়া পোড়া চুন ও পাথুরে চুন ১:১ অনুপাতে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
গ) ঘের ও নার্সারি প্রস্তুতকালীন সময় তলদেশ ও পাড়ের উপর অংশ পর্যন্ত প্রতি হেক্টরে ২০০-২৫০ কেজি পরিমাণ ডলোমাইট ও পোড়া চুন এর মিশ্রণ দেয়া যেতে পারে।
ঘ) চুন প্রয়োগের ৩-৭ দিন পরে স্ক্রীনিং করে ঘের ও নার্সারিতে ৫০-৬০ সেমি জোয়ারের পানি ঢুকাতে হবে যাতে অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভূক প্রাণী ঘেরে প্রবেশ করতে না পারে।
ঙ) পানি উত্তোলনের পর ২৫ পিপিএম হারে ব্লিচিং পাউডার প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে অবাঞ্ছিত ও অন্যান্য মৎস্যভূক প্রাণী মারা যাবে।
চিত্র-৩.২ বাগদা চিংড়ির ঘের প্রস্তুতি
প্রধানত জোয়ারের সময় ঘের বা নার্সারির জন্য পানি উঠানো হয়। অন্য কোনো ঘের থেকে পানি না নিয়ে যদি খাল বা ক্যানেলের পানি নেয়া হয় তাহলে ভালো হয়। এক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত-
ক) পুকুরে চুন ও সার প্রয়োগের পর ৬-১০ ইঞ্চি পরিমাণ পানি প্রবেশ করাতে হবে। পানি প্রবেশ করানোর সময় প্রবেশ পথে ৪-৬ ধাপে চিকন ম্যাশ সাইজের জাল ব্যবহার করা জরুরি। পানি ঘন জাল দিয়ে ছেকে নিলে অবাঞ্ছিত প্রাণী বা প্রাণীর ডিম ঘের বা নার্সারিতে প্রবেশ করতে পারবে না।
খ) ঘের বা নার্সারির পাড় সর্বোচ্চ যে পরিমাণ পানি সহ্য করতে পারবে প্রথমেই সে পরিমাণ পানি উঠাতে হবে। দরকার হলে ২-৩ দিনে পানি উত্তোলন সম্পন্ন করতে হবে। ফলে কোনো পুকুর নতুন হলে পাড় ও নীচের মাটি যথেষ্ট পরিমাণ পানি শোষণ করতে পারবে।
অনেকসময় স্ক্রীনিং করার পরেও জোয়ারের পানির সাথে অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভূক প্রাণী ঘেরে প্রবেশ করতে পারে। এগুলো নির্মূল করার ক্ষেত্রে যেসকল রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় সেগুলো ক্রয় করার সময় অবশ্যই তার মেয়াদ, দাম কেমন ইত্যাদি বিষয় ভালোভাবে বিবেচনা করা দরকার। অবাঞ্ছিত প্রাণী দমন করার জন্য রোটেনন, ব্লিচিং পাউডার, ফসটক্সিন, চা বীজের খৈল, মহুয়া বীজের খৈল ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়। ঘেরে পানি উত্তোলনের তিন থেকে চার দিন পর যদি অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভুক প্রাণী দমন করা হয় তাহলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়। অবাঞ্চিত ও মৎস্যভূক প্রাণী দমন করার অনেকগুলো পদ্ধতির মধ্যে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ ও উপযুক্ত কয়েকটি পদ্ধতির বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো:
ক. রোটেনন
রোটেনন হলো ডেরিস নামক পুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ থেকে তৈরি বাদামি রংয়ের পাউডার জাতীয় কীটনাশক যা অবাঞ্ছিত মাছ, পোকা-মাকড় ইত্যাদি দমনে ব্যবহার করা হয়। এটি একটি জটিল জৈব যৌগ (C23H22O6 ) । এটি Derris ellipticas Lonchocarpus sp জাতীয় গাছের শিকড় গুড়া করে তা পাউডার আকারে রোটেনন হিসেবে বাজারে বিক্রয় করা হয়। রোটেননের শক্তি মাত্রা এর মধ্যে বিদ্যমান মূল কার্যকর উপাদানের ওপর নির্ভরশীল। এতে ৯.১% সক্রিয় রোটেনন থাকে। আরেক শক্তিমাত্রার (৭%) রোটেনন পাওয়া গেলেও ৯.১% শক্তি সম্পন্ন রোটেনন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। রোটেনন প্রয়োগের মাত্রা পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নির্ভরশীল। তাই অবাঞ্ছিত মাছ, পোকা-মাকড় ইত্যাদি দমনে গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে অধিক মাত্রায় রোটেনন প্রয়োগ করতে হয়। তবে রোটেনন প্রয়োগের সুবিধা হলো এ পদ্ধতিতে মারা যাওয়া মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে সাধারণত কোনো সমস্যা হয় না।।
প্রয়োপমাত্রা
মাছের প্রজাতি, পরিবেশের তাপমাত্রা, রোটেননের শক্তিমাত্রা ইত্যাদির ওপর রোটেননের প্রয়োগমাত্রা অনেকাংশে নির্ভর করে। আমাদের দেশে সাধারণত ৯.১% শক্তিমাত্রার রোটেনন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। নিম্নে ছকে রোটেননের প্রয়োগমাত্রা উল্লেখ করা হলোঃ
শক্তিমাত্রা | প্রয়োগমাত্রা (প্রতি শতক/ফুট পানি) |
---|---|
৭% | ১৮-২৫ গ্রাম |
৯.১% | ১৬-১৮ গ্রাম |
প্রয়োগ পদ্ধতি
অবাঞ্ছিত মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণী দমনের জন্য ভোর বেলায় রোটেনন প্রয়োগ করা ভালো। রোটেনন প্রয়োগের পূর্বে জলাশয়ের পানির আয়তন অনুযায়ী রোটেনন পাউডার মেপে নিতে হবে। অতঃপর একটি পাত্রে রোটেনন পাউডার এর সাথে পরিমাণমতো পানি যোগ করে কাই তৈরি করতে হবে। উক্ত কাইকে সমান তিনভাগে ভাগ করে, এক ভাগ দ্বারা ছোট বল তৈরি করে পানিতে প্রয়োগ করতে হবে। ফলে কাদার নিচের ও উপরিভাগের প্রাণিসমূহ মারা যাবে। অন্য দুই ভাগ পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করা হয়। ফলে পানিতে ভাসমান মাছ ও অন্যান্য পোকামাকড় মারা যাবে। তাছাড়া রোটেনন প্রয়োগের পর জাল টেনে পানি উলট- পালট করে দিলে রোটেননের কার্যকারীতা বৃদ্ধি পাবে। ১৫-২০ মিনিট পর মাছ ভাসতে শুরু করলে খুব দ্রুত জাল টেনে মাছ ধরে ফেলতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মৃত মাছ ধরে ফেলা প্রয়োজন নতুবা এগুলো পুকুরের তলদেশে চলে যাবে। রোটেনন এর কার্যকারীতা ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে পানিতে বিদ্যমান থাকে। তবে রোটেনন প্রয়োগের মাধ্যমে চিংড়ি ও কাঁকড়া অপসারণ করা সম্ভব হয় না।
উদাহরণ: ৩ ফুট গভীরতা সম্পন্ন ১০ শতকের একটি পুকুরে ৯.১% শক্তিমাত্রার রোটেনন প্রয়োগ করতে কী পরিমাণ রোটেনন লাগবে তা নিম্নের সূত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়- রোটেননের পরিমাণ = পুকুরের আয়তন (শতক) x গভীরতা x প্রয়োগ মাত্রা = ১০ × ৩ × ১৮ = ৫৪০ গ্রাম
রোটেনন প্রয়োগের ফলে মাছ পানি থেকে যথেষ্ট পরিমাণে দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না, কারণ এটি পানিতে থাকা দ্রবীভূত অক্সিজেন নষ্ট করে ফেলে। পানি হতে মাছ যখন দ্রবীভূত অক্সিজেন গ্রহণ করার জন্য নিঃশ্বাস নেয় তখন পানিতে দ্রবীভূত রোটেনন এর বিষক্রিয়ার ফলে মাছের ফুলকার ল্যামেলি ফেটে যায়। ফলে দ্রবীভূত অক্সিজেন হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন রূপে মাছের দেহে পরিবহণ সম্ভব হয় না। ফলে মাছ অক্সিজেন গ্রহণ করতে না পারার কারণে মারা যায়। রোটেনন প্রয়োগের ফলে নিম্নলিখিত বিক্রিয়া সম্পন্ন হয়
O2 + Hb = HbO2 (অক্সিজেন + হিমোগ্লোবিন - অক্সিহিমোগ্লোবিন)
রোটেনন রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে বা উচ্চ তাপমাত্রায় অধিক কার্যকর। এছাড়া অম্লীয় ভাবাপন্ন ও নিরপেক্ষ অর্থাৎ পিএইচ ৭ বা তার কম আছে এরূপ পানিতে রোটেনন দ্রুত কাজ করে।
খ. ফসটক্সিন/কুইকফস/ সেলফস
ফসটক্সিন ট্যাবলেট খুবই বিষাক্ত। গুদামে পোকামাকড় মারার কাজে এ ট্যাবলেটের ব্যবহার অত্যধিক। কিন্তু ইদানিং পুকুরে অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভূক প্রাণী দমনের জন্য ফসটক্সিন ব্যাপকহারে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফসটক্সিন প্রয়োগের ফলে পুকুরে থাকা সব ধরনের প্রাণীই মারা যায়। তাছাড়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সতর্কতার সাথে ফসটক্সিন ব্যবহার করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নিচের প্রয়োগমাত্রা অনুসরণ করা যায়-
সারণি: নার্সারি পুকুরে ফসটক্সিনের প্রয়োগের মাত্রা
প্রয়োগ পদ্ধতি
ফসটক্সিন ট্যাবলেট পুকুরের পানিতে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। অগভীর জলাশয়ে এর কার্যকারিতা বেশি হওয়ায় ফসটক্সিন প্রয়োগের পূর্বে পুকুরের পানি সেচযন্ত্রের সাহায্যে কমিয়ে নেয়া উচিত। ফসটক্সিন প্রয়োগের পর জাল টেনে পুকুরের পানি উলট-পালট করে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। ট্যাবলেট প্রয়োগের ১-২ ঘণ্টা পর মাছ ভাসতে শুরু করলে জাল দিয়ে সব মরা মাছ উঠিয়ে নিতে হবে।
বিষক্রিয়ার মেয়াদকালঃ ৮-১০ দিন (প্রায়)
উদাহরণ: ৪ ফুট গভীরতা সম্পন্ন ২০ শতকের একটি পুকুরে কী পরিমাণ ফসটক্সিন ট্যাবলেট লাগবে তা নিম্নের সূত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়-
ফসটক্সিনের পরিমাণ = পুকুরের আয়তন (শতক) × পভীরতা x প্রয়োগ মাত্রা = ২০ × ৪ × ১ = ৮০ টি
গ. ব্লিচিং পাউডার
সাদা রং এর ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইট [Ca(CIO)2] পাউডারই মূলত ব্লিচিং পাউডার নামে পরিচিত। পানি বিশোধনের পাশাপাশি এটি দ্বারা অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভুক প্রাণী দমন করা যায়। ব্লিচিং পাউডার ব্যবহারের ফলে পুকুরে আর চুন প্রয়োগের দরকার হয় না কারণ এটি চুনের কাজও করে থাকে। এটি ব্যবহারে পুকুরের মাছ, ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক, অন্যান্য রোগজীবাণু ইত্যাদি মারা যায়। নিম্নরূপ প্রয়োগমাত্রা অনুযায়ী ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা যায়-
সারণি: পুকুরে ব্লিচিং পাউডারের প্রয়োগমাত্রা
প্রয়োগ পদ্ধতি
পরিমাণ অনুযায়ী পাউডার নিয়ে একটি পাত্রে পানি দিয়ে গুলে দ্রবণ তৈরি করে নিতে হবে। এরপর দ্রবণটি পুরো পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। সকালবেলা ব্যবহার করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। পুকুরে পাউডার প্রয়োগের আধা ঘন্টার মধ্যে মাছ মরে ভেসে উঠা শুরু করলে দ্রুত জাল টেনে মৃত মাছ তুলে ফেলা প্রয়োজন। বিষক্রিয়ার মেয়াদকালঃ ৮-১০ দিন (প্রায়)
উদাহরণ: ৫ ফুট গভীরতার ২০ শতক পুকুরে কী পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার লাগবে তা নিম্নের সূত্রের মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়-
ব্লিচিং পাউডারের পরিমাণ: পুকুরের আয়তন (শতক) x গভীরতা x প্রয়োগ মাত্ৰা = ২০ × ৫ × ১ = ১০০ কেজি
ঘ. চা বীজের খৈল
যে সমস্ত পুকুরের পানি নিষ্কাশনের বা শুকানোর সুযোগ নেই সে সমস্ত পুকুরের মৎস্যভূক প্রাণী, শামুক, ঝিনুক ইত্যাদি মেরে ফেলার জন্য চা বীজের খৈল অত্যন্ত কার্যকর, যা চা বীজের গুড়া থেকে তৈরি করা হয়। চা বীজের খৈলের মধ্যে স্যাপোনিন নামক পদার্থের উপস্থিতির কারণে মাছের লোহিত রক্ত কণিকাকে জমাট বেধে ফেলে ফলে মাছ মারা যায়। চা বীজের খৈলের বিষাক্ততার মেয়াদকাল ৩ দিন। এটি দ্বারা মারা যাওয়া মাছ নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় এবং এটি পুকুরে জৈব সার হিসেবে কাজ করে। যা প্লাংকটনের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে থাকে। এটি প্রয়োগের ৩-৫ ঘন্টার মাঝে মাছ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে মারা যায় এবং পানিতে ভাসতে শুরু করে। তবে পানির তাপমাত্রা অধিক হলে এর কার্যকারীতা অনেক বেশি হয় এবং পানির তাপমাত্রা কম হলে এটি ধীরে কাজ করে। এটা প্রয়োগে অবাঞ্ছিত মাছ এর পাশাপাশি ব্যাঙাচি, জোক, শামুক, কিছু কিছু পোকামাকড় ইত্যাদি মারা যায়। তবে পরিমিত মাত্রায় চা বীজের খৈল ব্যবহারের ফলে পুকুরের পানিতে অবস্থিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক খাবার যেমন- রটিফার, কপিপোড ইত্যাদির কোনো ক্ষতি হয় না। নিচের ছকে চা বীজ খৈলের প্রয়োগমাত্রা উল্লেখ করা হলো-
সারণি: পুকুরে চা বীজ খৈলের প্রয়োগ মাত্রা
প্রয়োগ পদ্ধতি
প্রয়োজনীয় পরিমাণ চা বীজের খৈল পানিতে গুলে নিয়ে পাতলা দ্রবণ তৈরি করতে হবে ও সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ব্যবহার করতে হবে। প্রয়োগকালীন পুকুরের পানির গভীরতা যত কম হবে ফলাফল তত ভালো পাওয়া যাবে। খৈল প্রয়োগ করার ২০-৩০ মিনিট পর মাছ মারা যেতে শুরু করবে। পরবর্তীতে জাল দিয়ে মৃত মাছ দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। বিষক্রিয়ার মেয়াদকালঃ ২-৩ দিন (প্রায়)।
ঙ. মহুয়া বীজের খৈল
ল্যাটিফোলিয়া প্রজাতির মহুয়া বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। দিনাজপুর ও মধুপুর অঞ্চলে এই গাছ অধিক পরিমাণে জন্মে। বীজ হতে তেল নিষ্কাশনের পর যে খৈল অবশিষ্ট থাকে, তাতে স্যাপোনিন নামক বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতির কারণে এটি বিষ হিসেবে কাজ করে। মহুয়া বীজের খৈল ব্যবহারের ফলে প্রথমে এটি বিষ হিসেবে কাজ করে এবং পরবর্তীতে সার হিসেবে পুকুরের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এটি ব্যবহারের ২ ঘন্টার মাঝেই এর বিষক্রিয়া শুরু হয় এবং মাছ মারা যায়। এ খৈলের ব্যবহার মাত্রা নিম্নে দেওয়া হলো-
সারণি: পুকুরে মহুয়া বীজ খৈলের ব্যবহার মাত্রা
প্রয়োগ পদ্ধতি
সামান্য পরিমাণ পানিতে পরিমাণমতো মহুয়া বীজের খৈল প্রথমে গুলে নিতে হবে। পরে অতিরিক্ত পানি মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। প্রখর সূর্যালোকের উপস্থিতিতে সমস্ত পুকুরে যথাযথভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। এটি ব্যবহারের ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে মাছ মারা যেতে শুরু করবে। পরবর্তীতে দ্রুততার সাথে জাল নে মৃত মাছ ধরে ফেলতে হবে যাতে করে পুকুরের পানির গুণগতমান নষ্ট না হয়। বিষক্রিয়ার মেয়াদকালঃ ৩-৪ দিন (প্রায়)।
সাবধানতা
মাছ বা চিংড়ি চাষের নার্সারি পুকুরে প্রায়শই চুন প্রয়োগ করা হয়। মাছ চাষে জলজ পরিবেশের মাটি ও পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্য চুন প্রয়োগ করা হয়। নার্সারি পুকুরে পরিমিত পরিমাণে চুন প্রয়োগের নানাবিধ উপকার রয়েছে। চুন প্রয়োগের উপকারিতা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. চুন মাটি ও পানির অম্লীয় ভাব কমিয়ে ক্ষারত্ব ভাব বাড়িয়ে দেয়। মাটি ও পানির খরতা (কার্বনেট ও বাইকার্বনেট) বাড়িয়ে দেয়।
২. চিংড়ি চাষে পানির সঠিক পিএইচ মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
৩. পানির ঘোলাত্ব কমিয়ে পানির স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনে।
৪. চিংড়ির দেহ পরিষ্কার রাখে ফলে রোগজীবাণু সহজে আক্রমণ করতে পারে না।
৫. মাটি ও পানিতে বসবাসকারী জীবাণু, ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ ও পরজীবিকে ধ্বংস করে।
৬. চুন সার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অন্যান্য সারের কার্যকারীতা বৃদ্ধি করে।
৭. চুন থেকে প্রাপ্ত ক্যালসিয়াম চিংড়ির খোলস তৈরির মাধ্যমে দৈহিক বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৮. মাটি ও পানির দূষিত পদার্থ শোধন করে।
৯. প্রয়োগকৃত খাদ্যের অবশিষ্টাংশ পঁচতে সাহায্য করে।
১০. চুন অ্যামোনিয়া, ম্যাগনেসিয়াম, সোডিয়াম ও পটাসিয়াম-এর বিষক্রিয়া দূর করে এবং পানিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
১১. পানির অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড কে ব্যবহার করে চুন সালোকসংশ্লেষণের মাত্রা বাড়ায় ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
১২. চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পুকুরের মাটি থেকে বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকারক মনি সমূহ সহজেই পানিতে মিশে উৎপাদনশীল করে।
১৩. ফুল প্রলেপের ফলে মাটির জৈব পদার্থসমূহ থেকে পানির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।
১৪. চুন প্রয়োগের মাধ্যমে পানিতে রুময় শেওলার বৃদ্ধি রোধ করা যায়।
১৫. চুল কামার ফসফরাসকে মুক্ত করে প্লাংকটনের বৃষ্টিতে সহায়তা করুন।
চিত্র-৩.৪ নার্সারি পুকুরে চুন প্রয়োগ।
চুনের প্রকারভেদ
ৰাজারে প্রচলিত বিভিন্ন রকমের তুনের মধ্যে রয়েছে- পোড়া ফুল, পরে ফুল কপি, সাই ইত্যাদি। এছাড়া শামুক ও ঝিনুকের খোলস পুড়িয়েও চুন তৈরি করা যায়। কিন্তু এসকল পোৱা চুন ব্যবহার কলে নাগীরি পুকুরে কালি ফলাফল পাওয়া যায় না। সাধারণত বাজারে পাওয়া যায় এমন চুলগুলো হচ্ছে-
ক. পাথুরে চুন
খ. পোড়া চুন
গ. কলি চুন
ঘ. ভলোবাইট
ঙ. জিপসাম
প্রয়োগ মাত্রা
পানি ও মাটির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন- মাটির ধরন (যেমন- বেলে দোআঁশ, এঁটেল), পানির পিএইচ, নতুন/পুরোনো পুকুর, চুনের প্রকারভেদ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে নার্সারি পুকুরে চুন প্রয়োগের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। পানির পিএইচ ৭.৫ এর নীচে নেমে গেলে কিংবা সকাল ও বিকালের পিএইচ এর মাত্রার পার্থক্য ০.৫ এর বেশি হলে অবশ্যই চুন প্রয়োগ করতে হবে। সাধারণত কাদামাটি, এঁটেল মাটি ও লাল মাটির ক্ষেত্রে একটু বেশি পরিমাণ চুন প্রয়োগ করা দরকার। আবার পুকুরে অনেক দিনের আবর্জনা, ময়লা ইত্যাদি বেশি থাকলে অধিক পরিমাণে চুন দরকার হয়। পোড়া চুন পাথুরে চুনের থেকে দ্বিগুণ কার্যকর। আবার কলিচুন থেকে পাথুরে চুন প্রায় দেড় গুণ কার্যকর। প্রতি শতাংশ পুকুরে সাধারণত এক কেজি হারে চুন প্রয়োগ করা হয়।
সারণি: মাটির পিএইচ-এর ওপর ভিত্তি করে চুনের প্রয়োগ মাত্রা
ব্যবহার পদ্ধতি
মাটির পিএইচ অনুযায়ী পরিমাণমত চুন মাটির চাড়ি বা ড্রামে কমপক্ষে ১২-২৪ ঘন্টা আগে গুলে নিতে হবে। সকালবেলা প্রয়োজনমত চুন নার্সারি পুকুরের পাড়সহ সমস্ত পুকুরে সমানভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। চাষ দেয়ার ২-৩ দিন পর অথবা বিষ প্রয়োগের ৭-৮ দিন পর পুকুরে চুন প্রয়োগ করা উচিত।
সাবধানতা
১। ফুল প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর প্রতি শতকে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টিএসপি ৫০ গ্রাম পটাশ এবং ১২ গ্রাম চিটাগুড় ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া উপরোক্ত সারের সাথে ১৫০-২০০ গ্রাম সরিষার খৈল প্রয়োগ করা যেতে পারে।
২। নার্সারি পুকুরে সার প্রয়োগের পর পানি পরিবর্তন করা যাবে না।
৩। যদি পানির রং অনুজ বা বাদামী হয় তবে ধরে নিতে হবে পানিতে প্লাংকটন উৎপন্ন হয়েছে এবং পুকুর
গোনা থাকার জন্য প্র হয়েছে।
৪। সার প্রয়োগ - দিন পত্রেও যদি পানি অন্য জলাশয় থেকে প্লাং পুকুরে দিতে হবে। অথবা একর প্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া এবং ২০ কেজি টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে। পানির রং সবুজ বা হালকা বাদামী হলে পানিতে প্রাকৃতিক খাদ্য বিদ্যমান রয়েছে বুঝতে হবে এবং এ পর্যায়ে পোনা সম্মুখ করা যাবে।
চিত্র-৩.৫ নার্সারি পুকুরে সার প্রয়োগ
নার্সারি পুকুরে মজুদ করতে হবে। নার্সারি পুকুরের আয়তন, পানির গভীরতা ও চাষ পদ্ধতির ওপর পোনা মজুদের হার নির্ভর করে।
সারণি: জারকন, পানির গভীরতা ও চাষ পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে নার্সারি পুকুরে পোনা মজুদের পরিমাণ
নার্সারি পুকুরে পোনা মজুদকরণের পূর্বে পোনাকে খাপ খাওয়াতে হবে। এক্ষেত্রে-
সুস্থ্য সবল ও ভালো মানের পোনার বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ-
সারণি: চিংড়িকে পিলেট বা বাণিজ্যিক খাবার প্রদানের তালিকা
চিত্র-০.৬ নার্সারি পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ
চিংড়ির গুণগত মান পুকুরের পানির গুণগতমানের ওপর নির্ভরশীল। পানি দুষিত হলে চিংড়ি দুর্বল হয়, খাবার খায় না ফলে সহজে রোগাক্রান্ত হয়। পরিশেষে আংশিক অথবা নার্সারির সম্পূর্ণ চিংড়ি মারা থেকে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে উন্নত প্রচলিত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে ফলে খুব কম পরিমাণ খাদ্য ঘেরে প্রয়োগ করা হয়। কারণ এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক খাদ্যের ওপর চিংড়ির উৎপাদন নির্ভর করে। এজন্য ঘেরে পানি ব্যবস্থাপনার ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
ক) চিংড়ির অবাধ চলাচলের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা
নার্সারি পুকুরের তলদেশ অগভীর ও স্বচ্ছ হওয়ায় সূর্যের আলো তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছায় ফলে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ যেমন: নাজাস, কারা (উচ্চতর জলজ উদ্ভিদ) জন্মায় যা চিংড়ির চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। আবার উপকূল অঞ্চলের ঘেরের তলা সমতল না হওয়ায় পানি ঘেরের সর্বত্র সমানভাবে থাকে না। এমনকি কোনো কোনো ঘেরে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ এলাকায় কোনো পানিই থাকে না। ফলে ঘেরের অধিকাংশ এলাকা চাষের আওতার বাইরে থাকে এবং আয়তন অনুপাতে চিংড়ির উৎপাদন হ্রাস পায়। তাই পানি প্রবেশের মাধ্যমে ঘেরের সম্পূর্ণ এলাকাকে চাষের আওতায় এনে চিংড়ির অধিক উৎপাদন নিশ্চিত করা যায় ।
খ) চিংড়ির শ্বাস গ্রহণের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা
বাগদা চিংড়ির স্বাভাবিক শ্বাস গ্রহণের জন্য পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৪-৮ পিপিএম থাকতে হয়। অক্সিজেনের সাথে পানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, অ্যামোনিয়া, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি দ্রবীভূত থাকে। পানিতে দ্রবীভূত সকল গ্যাসের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা রয়েছে। যেমন- আমোনিয়া 0.১ পিপিএম, হাইড্রোজেন সালফাইড ০.০৩ পিপিএম। পানিতে এই গ্যাসগুলোর পরিমাণ বেড়ে গেলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। ফলে ঘেরের চিংড়ি মারা যেতে পারে।
গ) প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য পানি ব্যবস্থাপনা
পানিতে ফাইটোপ্লাংকটনের উৎপাদনের হারকে প্রাকৃতিক উৎপাদনশীলতা বলে। সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফাইটোপ্লাংকটন ঘেরের পানিতে প্রাথমিক খাদ্যের যোগান দেয় এবং চিংড়ির শ্বাস গ্রহণ ও অন্যান্য কাজের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে। ফলে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ঠিক থাকে এবং অন্যান্য গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় না। ফাইটোপ্লাংকটন পানিতে দ্রবীভূত নাইট্রোজেন ও ফসফরাসকে নিজের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে ফলে পানিতে বিষাক্ত গ্যাস উৎপাদন হয় না এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফাইটোপ্লাংকটন থাকায় আগাছা ও ক্ষতিকর উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না। চিংড়ির অধিক উৎপাদনের জন্য পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য থাকা প্রয়োজন। এজন্য পানিতে নির্দিষ্ট মাত্রায় নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান উপস্থিত থাকতে হবে।
ঘ) চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের জন্য পানি ব্যবস্থাপনা
পানিতে প্রচুর পরিমাণে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বিদ্যমান থাকে। সুস্থ সবল চিংড়িকে জীবাণু আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে রোগ জীবাণু চিংড়িকে সহজেই আক্রমণ করার উপযুক্ত পরিবেশ পায়। বসবাসের পরিবেশ উপযুক্ত না থাকলে সেখানে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায় এবং চিংড়িকে আক্রান্ত করে। চিংড়ির মাঝে যে কোনো রকম অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই প্রথমে পানির গুণাগুণ যেমন- পিএইচ, দ্রবীভূত অক্সিজেন, ক্ষারত্ব পরীক্ষা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুন পানি প্রবেশ করাতে হবে। নতুন পানি প্রবেশ করানোর সময় জীবাণুমুক্ত ও যথেষ্ট গুণাগুণসম্পন্ন পানি প্রবেশ করাতে হবে। সম্ভব হলে পরিশোধিত পানি ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া পানি পরিশোধনের জন্য ব্লিচিং পাউডার ট্রিটমেন্ট (২০- ২৫ পিপিএম হারে) করা যেতে পারে।
চিংড়ি চাষের সময় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পোনা বড় হলে তা নার্সারি পুকুর থেকে পালন পুকুরে স্থানান্তরিত করতে হবে। নার্সারি পুকুর থেকে পোনা বেরিয়ে পালন পুকুরে যাওয়ার মত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
চিংড়ির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে পালন ঘের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
সুস্থ্য সবল চিংড়ি উৎপাদনের জন্য পরিশোধিত পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্য পানি পুনঃউত্তোলন ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত জরুরি। এখানে নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখা উচিত-
অধিক উৎপাদনের জন্য চিংড়িকে চাপমুক্ত রাখা উচিত। কিন্তু শেওলা পরিষ্কার, জাল টানা, ঘের মেরামত প্রভৃতি কাজের জন্য চিংড়ি পীড়নের শিকার হয় ফলে চিংড়ির মৃত্যু হার বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে করণীয় হলো-
চিংড়ির প্রত্যাশিত উৎপাদন পাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক খাদ্যের পাশাপাশি ঘেরে সম্পুরক খাদ্য প্রয়োগ করা উচিত। ঘেরে উপস্থিত মোট চিংড়ির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সম্পূরক খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করতে হবে। এক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-
যেকোনো ধরনের জলজ আগাছা আধা নিবিড় চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে। কারণ জলজ আগাছা জন্মালে ঘেরের পানির গুণগতমান সহনীয় পর্যায়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই ২-৩ দিন সময় নিয়ে ঘেরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। ঘেরে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ আগাছা থাকলে তা গ্রহণযোগ্য তবে এর বেশি থাকলে তা ক্ষতিকর।
চিংড়ি চাষে নমুনায়ন ও পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতি ১৫ দিনে একবার অথবা মাসে ২ বার চিংড়ির নমুনায়ন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। রোগ অথবা বৃদ্ধি সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। চিংড়ির নমুনায়নের সময় করণীয় বিষয়গুলো নিম্নের সারণিতে দেয়া হলো-
সারণি: চিংড়ির নমুনায়নের সময় পর্যবেক্ষণের বিষয় ও করণীয়
পর্যবেক্ষণ বিষয় | করণীয় |
---|---|
১. ওজন স্বাভাবিক আছে কিনা ২. পাকস্থলিতে পর্যাপ্ত খাবার আছে কিনা ৩. চিংড়ির দেহে রোগের চিহ্ন আছে কিনা অথবা খোলসে সাদা চাকা দাগ আছে কিনা ৪. অস্বাভাবিক চলাচল ৫. ফুলকা কালো হয়ে গেছে কিনা ৬. লেজ ফোলা বা পানি জমে থাকা ৭. মাংস এবং খোলসের মাঝে ফাঁকা আছে কিনা ৮. খোলস নরম/শক্ত কিনা | ১. মাসে কমপক্ষে ২ বার নমুনায়ন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ২. পর্যাপ্ত পরিমাণ না থাকলে খাবারের পরিমাণ বাড়াতে হবে অথবা খাবার না খাওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। ৩. ভাইরাসের কারণে মুলত এরকম হতে পারে। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করতে হবে ৪. চিংড়ি পাড়ের নিকট স্থির হয়ে থাকলে বুঝতে হবে কোনো অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পানির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ করে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৫. স্বল্পমাত্রায় চুন প্রয়োগ করতে হবে। ঘেরে হররা/পালা টেনে নিতে হবে। ৬. চিংড়ি আক্রান্তের পরিমাণ বেশি হলে প্রতি বিঘায় ১.৫ কেজি পটাশ পানিতে গুলিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে। ৭. খাবার প্রদানের হার বৃদ্ধি করতে হবে ৮. নরম খোলসবিশিষ্ট চিংড়ি সংখ্যায় বেশি হলে ঘেরে চুন প্রয়োগ করতে হবে। |
তোমার প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি যে কোনো বাগদা চিংড়ির নার্সারি পুকুর পরিদর্শন করে নিম্নোক্ত ছক পূরণ কর।
পরিদর্শনকৃত চিংড়ি নার্সারির নাম | |
ঠিকানা | |
নার্সারিতে কর্মরত কর্মীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামসমূহের নাম লিখ | ১. ২. |
পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে পুকুরের তলা পর্যাপ্ত রোদে শুকানোর ব্যবস্থা করা | ১. ২. |
পুকুরের তলার মাটি অপসারণ করা | ১. ২. |
পুকুরের পাড় মেরামত/সংস্কার করা | ১. ২. |
অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভূক প্রাণী দমনে ব্যবহৃত উপকরণসমূহের নাম | ১. ২. |
নার্সারি পুকুরের আয়তন অনুসারে প্রয়োগকৃত চুন ও সারের পরিমাণ | ১. ২. |
নার্সারি পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের পরিমাণ | ১. ২. |
নার্সারি পুকুরে হাঁসপোকা ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পোকা দমনের পদ্ধতিসমূহ লিখ | ১. ২. |
নাম | |
শ্রেনী | |
রোল নং | |
প্রতিষ্ঠানের নাম | |
শ্রেণি শিক্ষকের নাম | |
প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শ্রেণি শিক্ষকের স্বাক্ষর |
তোমার প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি যে কোনো বাগদা চিংড়ির নার্সারি পুকুর পরিদর্শন করে মজুদ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে নিম্নোক্ত ছক পূরণ কর।
পরিদর্শনকৃত বাগদা চিংড়ির নার্সারির নাম | |
ঠিকানা | |
নার্সারি পুকুরে গোস্ট লার্ভা অবমুক্ত করার পর লার্ভার গতিবিধি | ১. ২. |
পিলেট খাদ্য নাকি হাতে তৈরি খাদ্য ব্যবহার করা হয় | ১. ২. |
খাদ্য প্রয়োগের পদ্ধতি | ১. ২. |
চিংড়ির পোস্ট লার্ভাকে প্রদেয় খাদ্যের পরিমাণ | ১. ২. |
নার্সারির পানি ব্যবস্থাপনা | ১. ২. |
পোস্ট লার্ভার নমুনায়ন পদ্ধতি | ১. ২. |
পোস্ট লার্ভার আহরণ ও পরিবহণ পদ্ধতি | ১. ২. |
নাম | |
শ্রেনী | |
রোল নং | |
প্রতিষ্ঠানের নাম। | |
শ্রেণি শিক্ষকের নাম | |
প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শ্রেণি শিক্ষকের স্বাক্ষর |
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
ক্রম | নাম | স্পেসিফিকেশন | সংখ্যা |
---|---|---|---|
০১ | এ্যাপ্রোন | শিক্ষার্থীর মাপ মতো | ১ টি |
০২ | হ্যান্ড গ্লোভস | মাঝারি মাপের | ১ জোড়া |
০৩ | মাস্ক | তিন স্তর বিশিষ্ট | ১ টি |
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
১. প্লাস্টিকের বালতি
২ স্কুপনেট
৩. গামছা
৪. প্লাস্টিকের গামলা
৫. পাতিল
৬. থার্মোমিটার
৭. টিস্যু পেপার
৮. খাতা, পেন্সিল
৯. বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভা
(গ) কাজের ধারা
১। প্লাস্টিক ব্যাগ বা পাতিলে করে আনা বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ছায়াযুক্ত শীতল স্থানে রাখ।
২। প্লাস্টিক ব্যাগের বা পাতিলের পানির তাপমাত্রা ও নার্সারি পুকুরের পানির তাপমাত্রা থার্মোমিটার দিয়ে মেপে নাও।
৩। প্লাস্টিক ব্যাগ বা পাতিলের ও পুকুরের পানির তাপমাত্রার ব্যবধান ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে আস্তে আস্তে পুকুরের পানি নিয়ে পাতিলের পানিতে মিশাও এবং ১৫ থেকে ২০ মিনি অপেক্ষা করো।
৪। এরপর পাতিল থেকে ২০% পানি ফেলে দিয়ে নার্সারি পুকুরের পানি নিয়ে পাতিল ভর্তি করো এবং ১৫ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করো।
৫। প্লাস্টিক ব্যাগ বা পাতিলের পানির তাপমাত্রা পুকুরের পানির তাপমাত্রার সমান হলে প্লাস্টিক ব্যাগ বা পাতিলের মুখ নার্সারি পুকুরের পানিতে কাত করে ব্যাগের বা পাতিলের ভিতর হাত দিয়ে পানির স্রোত সৃষ্টি করো।
৬। বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভাগুলো প্লাস্টিকের ব্যাগ বা পাতিল থেকে স্রোতের বিপরীতে লার্ভাগুলো বেরিয়ে যেতে দাও।
৭। এরপর পাতিল দিয়ে পুকুরের পানিতে ঢেউ সৃষ্টি করতে হবে যেন পোস্ট লার্ভাগুলো পুরো পুকুরে ছড়িয়ে যেতে পারে।
৮। পোস্ট লার্ভার সঠিক পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য নমুনা হিসেবে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ বা পাতিলের পোস্ট লার্ভা গণনা করা যেতে পারে।
৯। সম্পূর্ণ অনুশীলনটি ধৈর্য সহকারে করো এবং ব্যবহারিক খাতায় লেখ।
সতর্কতা
১। পাতিলের পানির তাপমাত্রা ও নার্সারি পুকুরের পানির তাপমাত্রার মধ্যে ব্যবধান অনেক থাকলে পোস্ট লার্ভার মৃত্যুর হার বেড়ে যেতে পারে তাই এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
২। মেঘলা দিনে অথবা রৌদ্রোজ্জ্বল সময়ে পুকুরে চিংড়ির পোস্ট লার্ভা ছাড়া যাবে না।
৩। সকাল বেলা বা বিকাল বেলা পোস্ট লার্ভা পুকুরে ছাড়ার জন্য উত্তম।
৪। চিংড়ির পোস্ট লার্ভা মজুদ করার সময় লার্ভার চাপমুক্ত অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
আত্মপ্রতিফলন
নার্সারি পুকুরে বাগদা চিংড়ির পোস্ট লার্ভা মজুদ করার বিষয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন :
১। নার্সারি পুকুর কী?
২। নার্সারি পুকুরের মাটির পিএইচ কত থাকা উচিত?
৩। নার্সারি পুকুরের আয়তন কেমন হওয়া উচিত?
৪। রোটেনন এর রাসায়নিক সংকেত লেখ।
৫। প্রতি শতাংশ নার্সারি পুকুরে কতটি পোনা মজুদ করা হয়?
৬। ব্লিচিং পাউডার এর প্রয়োগ মাত্রা কত?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন:
১। কোন ধরনের মাটি নার্সারি পুকুরের জন্য উপযুক্ত?
২। রোটেনন এর শক্তিমাত্রা ও প্রয়োগ মাত্রা উল্লেখ করো।
৩। মৎস্যভুক প্রাণী দমনে ব্যবহৃত রাসায়নিক কীটনাশকগুলোর নাম লেখ?
৪। চুন কত প্রকার ও কী কী?
৫। সুস্থ্য ও ভালো মানের পোনার বৈশিষ্ট্যগুলো লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন:
১। নার্সারি পুকুরের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করো।
২। নার্সারি পুকুর তৈরির সময় কী কী বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা উচিত?
৩। ঘেরে পানি উত্তোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
৪। অবাঞ্ছিত ও মৎস্যভূক প্রাণী অপসারণের প্রক্রিয়া বর্ণনা করো।
৫। মহুয়া বীজের খৈল প্রয়োগের সময় কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?
৬। নার্সারিতে চুন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রয়োগ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
৭। চুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?
৮। পুকুরের আয়তন ও গভীরতার ওপর ভিত্তি করে পোনা মজুদের পরিমাণ ও মজুদ পদ্ধতি বর্ণনা করো।
৯। নার্সারি পুকুরে বাগদা চিংড়ির খাদ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বর্ণনা করো।
১০। চিংড়ির পোনা আহরণ ও স্থানান্তর প্রক্রিয়া বর্ণনা করো।
১১। চিংড়ির পীড়ন নিয়ন্ত্রণের উপায় সম্পর্কে বর্ণনা করো।
১২। চিংড়ির নমুনায়নের সময় কী কী বিষয় পর্যবেক্ষণ করা উচিত এবং করণীয় সম্পর্কে লেখ।
বর্তমানে চিংড়ি চাষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা হলো রোগ। অন্যান্য সব প্রাণীদের মতোই চিংড়িতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়ে থাকে। চিংড়ির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে জীবাণু দ্বারা বিভিন্ন সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যে সমস্ত জীবাণু দ্বারা চিংড়ি আক্রান্ত হয় তার মধ্যে পরজীবী, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া উল্লেখযোগ্য। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অপুষ্টিজনিত এবং পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন- লবণাক্ততা, তাপমাত্রা, পিএইচ ইত্যাদি অসামঞ্জস্যতার সৃষ্টি হলে চিংড়ি রোগে আক্রান্ত হতে পারে এবং ফলশ্রুতিতে চিংড়ি মারা যেতে পারে।
এই অধ্যায় পাঠ শেষে আমরা
শুধু পানির মধ্যেই চিংড়ির পরিবেশ সীমাবদ্ধ নয় বরং মাটির গুণাগুণের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। কারণ মাটি পানিকে ধারণ করে রাখে। এক্ষেত্রে দোআঁশ মাটি ঘের নির্মাণের ক্ষেত্রে উত্তম। কারণ দোআঁশ মাটির পানি ধারণক্ষমতা ও উর্বরতা বেশি। দোআঁশ মাটির পানিতে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে লাল মাটির ঘের বা পুকুরের পানি অধিকাংশ সময় ঘোলা থাকে। বেলে মাটির পানির ধারণ ক্ষমতা খুবই কম। তবে এঁটেল মাটি ও লাল মাটিতে চিংড়ি চাষ করা যেতে পারে। তাছাড়া পানির গুণগত মানের ওপর চিংড়ি চাষের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই পানিতে অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোজেন ও সালফার গ্যাসের পরিমাণ সর্বোত্তম পর্যায়ে রাখা উচিত। অন্যথায় চিংড়ির মহামারী দেখা দিতে পারে। জৈব পদার্থ সরল রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তরের জন্য ঘেরে যথেষ্ট পরিমাণ সূর্যের আলো নিশ্চিত করতে হবে। পানির দূষণ চিংড়ির মহামারীর অন্যতম কারণ। যেমন- পানিতে অব্যবহৃত খাবার, নোংরা জৈব সার, অধিক গুল্ম আগাছা, বৃষ্টি বিধৌত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ইত্যাদির উপস্থিতি। তবে সুষ্ঠু চাষ ব্যবস্থাপনার অভাবে চিংড়িতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে থাকে।
চিংড়ির ভাইরাসজনিত রোগের কোন চিকিৎসা না থাকায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়াই উত্তম। যেমন- উত্তম উপায়ে ঘের তৈরি, পিসিআর পরীক্ষিত পোনা মজুদ, পরিমিত হারে সার ও খাবার প্রয়োগ ইত্যাদি। রোগ প্রতিরোধে তিনটি বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি যেমন- চিংড়ি (হোস্ট), জীবাণু ও পরিবেশ। চিংড়ি হঠাৎ কোনো ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হলে এবং তাৎক্ষণিকভাবে (২-৩ দিনের মধ্যে) চিকিৎসা প্রদানে ব্যর্থ হলে খামারের সব চিংড়ি মারা যেতে পারে। সুতরাং চিংড়িকে বিভিন্ন রোগের হাত থেকে রক্ষার্থে নিম্নে বর্ণিত
বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত-
ক. সুস্থ, সবল, রোগমুক্ত ও কৌলিতাত্ত্বিক গুণগত মানের পোনা ছাড়তে হবে।
খ. পরিমিত মাত্রায় সুষম খাবার প্রদান করতে হবে।
গ. পানির গুণগত মানের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখতে হবে এবং পরিবর্তন হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘ. পুকুরের তলদেশ পরিষ্কার রাখা ও পানি পরিবর্তনের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ঙ. পুকুরে কোন রোগের আক্রমণ দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে রোগের শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
চ. পানির গুণগতমান নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যেমনঃ পিএইচ, স্বচ্ছতা, পানির তাপমাত্রা ইত্যাদি।
ছ. পরিমাণ মতো অক্সিজেন সরবরাহে পেডেল হুইলের ব্যবস্থা করতে হবে।
জ. পরিমিত পরিমাণে সার প্রদান করতে হবে যাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃতিক খাদ্য উৎপাদিত হয়।
পানির গুণাগুণ রক্ষায় নিম্নবর্ণিত বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন:
ক) তাপমাত্রা: যে কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেই বিপাক ক্রিয়ায় তাপমাত্রা পুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তেমনি চিংড়ির বিপাক ক্রিয়ায়ও তাপামাত্রার গুরুত্ব অপরিসীম। চিংড়ির বৃদ্ধির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা হল ২৮-৩২ ডিগ্রি সে.। ৩৫ ডিগ্রি সে. এর বেশি ও ২৫ ডিগ্রি সে. এর কম তাপমাত্রায় চিংড়ি দুর্বল হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পানির তাপমাত্রা যদি ১৩ ডিগ্রি সে. এর নীচে ও ৩৪ ডিগ্রি সে. এর উপরে হলে চিংড়ির ব্যাপক মহামারী দেখা যায়। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখে খাবার ও সার প্রয়োগ কম বা বেশি করতে হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পানি পরিবর্তন করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সনাতন ও হালকা উন্নত পদ্ধতির চাষের পুকুরে গভীরতা সর্বদা ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য খামারের ভেতরে চারদিকে কোনাকুনি নালা থাকা প্রয়োজন। নার্সারির পানির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ৪-৬% এলাকায় কচুরিপানা রাখা যেতে পারে।
খ) দ্রবীভূত অক্সিজেন: বাগদা চিংড়ির অক্সিজেন চাহিদা বেশি হওয়ায় চিংড়ি চাষের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চিংড়ি চাষের জন্য অক্সিজেনের আদর্শ পরিমাপ হল ৫-৭ পিপিএম।
সারণি: বাগদা চিংড়ি চাষে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের প্রভাব
তাপমাত্রা, লবণাক্ততা ও বায়ুচাপের ওপর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ভর করে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের উৎস হল বাতাস ও সালোকসংশ্লেষণ। রাত্রিকালে উদ্ভিদের শ্বাস গ্রহণ, প্রাণীকূলে শ্বাস গ্রহণ ও পচনশীল জৈব পদার্থের পচন এর কারণে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়ে থাকে। পানিতে অক্সিজেন হ্রাসের কারণে চিংড়ির ক্ষুধামন্দা, দৈহিক ক্লেশ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, দৈহিক বৃদ্ধির ব্যাঘাত, শ্বাস প্রশ্বাসের হার বৃদ্ধি এবং মারা যায়। সাধারণত মেঘলা দিনে, খুব গরম পড়লে এবং মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত পুকুরে অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। পুকুরে অক্সিজেন হ্রাসের লক্ষণসমূহ নিম্নরূপ-
১। চিংড়ি পানির উপরিভাগে এসে খাবি খাবে।
২। পুকুরে বুদবুদ আকারে গ্যাস উঠতে দেখা যায়।
৩। পানির উপর স্বরের মতো বুদবুদ জমা হয়।
৪। চিংড়ি এদিক ওদিক ছুটাছুটি করবে।
৫। মরা মাছের মত চিংড়ি পানির উপরে ভেসে উঠবে ও ফুলকা ছেড়ে যাবে।
সারণি: বিভিন্ন তাপমাত্রায় পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ
রাতের বেলায় আলো না থাকায় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকে কিন্তু চিংড়ি অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে। তাই ভোরের দিকে অক্সিজেন সংকট দেখা যায়। আবার যে পুকুরে ফাইটোপ্লাংকটন বেশি থাকে সেখানে দিনের ভাগে আলোর উপস্থিতিতে সালোকসংশ্লেষণ বেশি হওয়ায় বিকালের দিকে অক্সিজেনের পরিমাণ বেশি থাকে।
নিম্নোক্ত উপায়ে পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যায়-
গ) পানির লবণাক্ততা: লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চল চিংড়ি চাষের উপযোগী। লোনা পানিতে চিংড়ির ভাল উৎপাদন হয়। সাধারণত ৮-১৪ পিপিটি লবণাক্ত পানি বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য উপযোগী। একটানা প্রখর সূর্যতাপের কারণে পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অনেক বেশি হয়। পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ২৫ পিপিটি এর বেশি হলে পানি সরবরাহ করে লবণাক্ততার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। রিফ্লাক্টোমিটারের সাহায্যে পানির লবণাক্ততার পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।
ঘ) অ্যামোনিয়া (NH3): জলজ প্রাণীর বিপাক ক্রিয়া ও পুকুরে পুঞ্জিভূত জৈব পদার্থের পচন থেকে অ্যামোনিয়ার সৃষ্টি হয়। উচ্চ অ্যামোনিয়া জলজ প্রাণির জন্যে সব থেকে বিষাক্ত পদার্থ। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.০৫ মিলিগ্রাম/ লিটার এর বেশি হলে মাছের ফুলকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আয়নিত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ ০.১ পিপিএম এর বেশি হলে বৃদ্ধির হার অর্ধেক এ নেমে আসে। পানিতে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ পানির পিএইচ এর সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন- পানির পিএইচ বৃদ্ধির সাথে সাথে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে পানির রং তামাটে বা কালচে রংয়ের হয় ফলে চিংড়ির ছোটাছুটি বেড়ে যায় এবং চিংড়ি মারা যায়। অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে চিংড়ির মজুদ ঘনত্ব কমাতে হবে। সার ও খাদ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিকার হিসেবে প্রতি শতাংশে ২০০-২৫০ গ্রাম জিওলাইট দিতে হবে।
ঙ) নাইট্রাইট (NO2); নাইট্রাইটের পরিমাণ বেড়ে গেলে চিংড়ির দেহে অক্সিজেন সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয় এবং বিষাক্ততার সৃষ্টি করে। এতে চিংড়ি বাদামী রং ধারণ করে এবং খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। নিরাপদ চিংড়ি চাষের জন্য নাইট্রাইটের মাত্রা ০.১ পিপিএম এর নীচে রাখা জরুরি। প্রতিকার হিসেবে চিংড়ির ঘনত্ব হ্রাস ও পানি পরিবর্তন করে ২৫০ মিলিগ্রাম/লিটার হারে লবণ দিতে হবে।
চ) নাইট্রেট (NO3): নাইট্রেট খুব বিষাক্ত নয় বরং শেওলার পুষ্টি হিসেবে কাজ করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে নাইট্রেটের উচ্চ ঘনত্বের সংস্পর্শে থাকলে চিংড়ির অ্যান্টেনার দৈর্ঘ্য ছোট হয়, ফুলকা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হেপাটোপ্যানক্রিয়াস এ ক্ষত সৃষ্টি হয়। নাইট্রেটের পরিমাণ ২০ পিপিএম এ রাখা চিংড়ি চাষের ক্ষেত্রে উত্তম।
ছ) খরতা ও ক্ষারত্ব: খরতা ও ক্ষারত্বের মধ্যে সামঞ্জস্যতা নষ্ট হলে পানির নিরপেক্ষকরণ ক্ষমতা কমে যায় এবং পিএইচ এর স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় ফলে পুকুরে প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎপাদন বাধ্যগ্রস্ত হয় এবং চিংড়ির বৃদ্ধি কমে যায়। খরতা ও ক্ষারত্বের মান ৪০-২০০ মিলিগ্রাম/লিটার চিংড়ি চাষের জন্য উত্তম। ঘের/পুকুর তৈরির সময় গড়ে শতাংশ প্রতি ১-২ কেজি চুন প্রয়োগ করতে হয়। এছাড়া ছাই ব্যবহারে পানির ক্ষারত্ব নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
জ) পিএইচ (pH): চিংড়ি চাষে পুকুরের পানির পিএইচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। ঘেরের পানির পিএইচ সকালের দিকে ৭.৫-৮.৫ চিংড়ি চাষের জন্য খুবই উপকারী।
সারণি: চিংড়ির ওপর পানির পিএইচ এর প্রভাব
ঝ) কার্বন-ডাই অক্সাইড: দিনের বেলায় কার্বন ডাই অক্সাইড কম থাকে কারণ সালোকসংশ্লেষণে কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যবহৃত হয় এবং রাতের বেলায় বৃদ্ধি পায়। পানিতে ৬০ মিলিগ্রাম/লিটার কার্বন ডাই অক্সাইড থাকলে চিংড়ি বাঁচতে পারে। কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পেলে অক্সিজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়।
ঞ) হাইড্রোজেন সালফাইড হাইড্রোজেন সালফাইড যেকোন জলজ প্রাণীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। হাইড্রোজেন সালফাইডের যে কোন পরিমাণ চিংড়ির জন্য ক্ষতিকর। সাধারণত যখন পানির পিএইচ কম থাকে তখন হাইড্রোজেন সালফাইড বিষাক্ত হয়। পানি পরিবর্তন ও মাঝে মাঝে চুন প্রয়োগের মাধ্যমে হাইড্রোজেন সালফাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
রোগাক্রান্ত চিংড়ির রোগের লক্ষণ ছাড়াও যে সব বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ দ্বারা খামারে রোগের আক্রমণ প্রত্যক্ষ
করা যায়-
চিংড়ির রোগের প্রধান কারণসমূহ নিম্নরূপ-
১) পরিবেশের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক গুণাবলির পরিবর্তনজনিত কারণ
ক) ভৌত গুণাবলীর পরিবর্তন
খ) রাসায়নিক গুণাবলীর পরিবর্তন
গ) জৈবিক গুণাবলীর পরিবর্তন
২) খাদ্যের অভাবজনিত কারণ
৩) প্রযুক্তি বাস্তবায়নগত অসুবিধা
বাগদা চিংড়িতে সাধারণত চার ধরনের রোগ দেখা যায়-
ক) ভাইরাসজনিত রোগ: ভাইরাস এক প্রকার অতিক্ষুদ্র জৈবকণা বা অনুজীব যা জীবিত কোষের ভিতরে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। চিংড়ি চাষের সমস্যাগুলোর মধ্যে ভাইরাসজনিত রোগ অন্যতম। চিংড়ি চাষে ভাইরাসের আক্রমণে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং আমাদের দেশে ভাইরাসের কারণে চিংড়ির ব্যাপক মহামারী দেখা যায়। চিংড়ির ক্ষেত্রে প্রধান ভাইরাসজনিত রোগ গুলো হলো- White Spot Syndrome Virus (WSSV), Yellow Head Virus (YHV), Baculovirus penaei (BP), Monodon baculovirus (MBV), Infectious Myonecrosis Virus (IMNV), Hepatopancreatic Parvovirus (HPV)
খ) ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ: আদিকোষী অনুজীবদের একটি বিরাট অধিজগৎ ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গঠিত। ব্যাকটেরিয়া আণুবীক্ষণিক জীব যা খালি চোখে দেখা যায় না। চিংড়ির দেহে প্রচুর পরিমাণে ব্যাকটেরিয়া থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে ব্যাকটেরিয়া চরম ক্ষতিকর রোগ হিসেবে দেখা যায়। রোগ সৃষ্টিকারী প্রধান ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিসমূহ হলো- Vibrio parahaemolyticus, V. harveyi, V. vulnificus, V. damsela, Aeromonas spp., Flavobacterium spp., alginalyticus প্রভৃতি। বাগদা চিংড়িতে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট রোগগুলো হলো- Filamentous bacterial disease, Necrotising Hepatopancreatitis (NHP, Mycobacteriosis, Chitinolytic bacterial shell disease, Rickettsial infection প্রভৃতি।
গ) পরজীবীঘটিত রোগ: বিভিন্ন প্রকার এককোষী ও বহুকোষী পরজীবী আছে যারা চিংড়ির রোগ সৃষ্টি করে। এই পরজীবীগুলো চিংড়ির ত্বকের সাথে লেগে থেকে ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি করে। ফুলকাতে আক্রমণ করে চিংড়ির ওজন কমিয়ে দেয় এবং অবশেষে মৃত্যু ঘটায়। Black / Brown gill disease হয়ে থাকে Zoothamnium, Epistylis, Vorticella প্রোটোজোয়ার জন্য। Gregarine disease হয়ে থাকে অ্যানিলিড পরজীবী Nematopsis spp. এর জন্য এবং Cotton shrimp এর জন্য দায়ী Agmasoma sp
ঘ) ছত্রাকজনিত রোগ: ছত্রাক প্রধানত চিংড়ির লার্ভা পর্যায়ে বেশি আক্রমণ করে। সাধারণত চিংড়ির ফুলকাতে আক্রমণ করে এবং শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে। ফলে চিংড়ি মারা যায়। প্রধান সংক্রামক প্রজাতিগুলো গুলো- Lagenidium callinectes, L. marina, Sirolpidium spp. Pythium spp, Fusarium solani, Fusarium incarnatum প্রভৃতি।
ক) ভাইরাসজনিত রোগ
১) হোয়াইট স্পট বা চায়না ভাইরাস রোগ (White spot syndrome baculovirus-WSBV)
চিকিৎসা
২) সংক্রামক হাইপোডার্মাল এবং হেমাটোপয়েটিক নেক্রোসিস (Infectious hypodermal and hematopoietic necrosis -IHHN)
লক্ষণ
চিকিৎসা
৩) মনোডন ব্যাকুলোভাইরাস (Monodon Baculovirus MBV)
লক্ষণ
চিকিৎসা
৪) মস্তক হলুদ রোপ
লক্ষণ
চিকিৎসা
খ) ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ
১) নেক্রোটাইজিং হেপাটোপ্যানক্রিয়াটাইটিস (Necrotising hepatopancreatitis (NHP)
লক্ষণ
চিকিৎসা
২) কালো ফোটা রোগ (Black spot disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
৩) লেজ পঁচা রোগ (Tail rot disease)
চিকিৎসা
৪) ব্যাকটিরিয়াল সেপ্টিসেমিয়া (Bacterial septicemia)
লক্ষণ
চিকিৎসা
৫) কালো দাগ রোগ (Black spot / shell disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
গ) পরজীবীজনিত রোগ
১) ইপিকম্মেন্সাল রোগ (Epicommensal disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
২) ইন্টারোসাইটোজোন হেপাটোপেনাই (Enterocytozoon hepatopenai, EHP)
লক্ষণ
চিকিৎসা
ঘ) ছত্রাকঘটিত রোগ
১) ফুলকা পঁচা রোগ (Gill not disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
২) ছত্রাক রোগ (Fungal disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
৩) কালো ফুলকা রোগ (Black gill disease)
চিকিৎসা
৪) ফুসেরিয়াম রোগ (Fusarium sp.)
লক্ষণ
চিকিৎসা
ঙ) অপুষ্টিজনিত রোগ
১) খোসা নরম রোগ (Soft shell disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
২) দেহ খিচুনি রোগ (Body cramp disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
চ) বিবিধ রোগ
১) চিংড়ির গায়ে শেওলাজনিত সমস্যা (Extrenal fouling of shrimp)
লক্ষণ
চিকিৎসা
২) বুদবুদ রোগ (Gas bubble disease)
লক্ষণ
চিকিৎসা
১। পটাশ (KMnO4)
২। কপার সালফেট (Copper sulphate)
৩। ম্যালাকাইট গ্রিন (Malachite green
৪। মিথিলিন ব্লু (Methylene blue
৫। টিমসেন (Timsen )
৬। ফরমালিন (Formalin )
৭। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড (Aluminium oxide)
৮। ব্লিচিং পাউডার (Bleaching powder)
৯। প্রোটোজোয়াসাইড (Protozoacide)
১০। বায়ো অ্যাকুয়া (Bio aqua )
১১। ট্রাফলান (Trafian)
এন্টিবায়োটিক
১। পলিমিক্সিন (Polymixin)
২। ইরিথ্রোমাইসিন (Erythromycin)
৩। অক্সিটেট্রাসাইক্লিন (Oxytetracycline)
৪। সারাফ্লোক্সাসিন (Sarafloxacin)
৫। সালফোনামাইড (Sulphonamide)
৬। কুইনোলোন (Quinolone)
৭। অ্যালবাজিন (Albazin
৮। টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline)
৯। ক্লোরামফেনিকল (Chloramphenicol
১০। মেট্রোনিডাজল (Metronidazole)
নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিক
১। সালফামেথোক্সাজল (Sulfamethoxazole)
২। ফিউরাজলিন (Furazolidone )
৩। ক্লোরামফেনিকল (Chloramphenicol
৪। নাইট্রোফুরান (Nitrofuran
৫। নিওমাইসিন (Neomycin)
৬। নালিডিক্সিক এসিড (Nalidixic acid)
ক) গভীরতাজনিত সমস্যা: চিংড়ি চাষে নার্সারিতে পানির গভীরতা ০.৬-০.৭ মিটার এবং পালন ঘেরে ১.০- ১.৫ মি. হওয়া উচিত।
খ) পানির উপর সবুজ ফাইটোপ্লাংকটন স্তর বেশি জৈব সার প্রয়োগে পানিতে ফাইটোপ্লাংকটন অনেক বেশি জন্মায়। ফলে পুকুরের পানির উপর সবুজ মোটা কাথার মতো স্তর দেখা যায়। সবুজ স্তর দূর করার জন্য প্রতি শতকে ১৫ গ্রাম (৩-৫ ফুট গভীরতা) তুঁতে প্রয়োগ করতে হবে।
গ) ইউগ্লেনাজনিত স্তর: ইউগ্লেনা নামক বহুকোষী প্রাণিতে ক্লোরোফিল নামক উপাদান থাকায় সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে লালচে বাদামী বর্ণ ধারণ করে। ইউগ্লেনা স্তরের উপর প্রতি কেজিতে ২০০ মিলি হারে পাথুরে চুন পানির সাথে মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতে হবে।
ঘ) আয়রনজনিত স্তর: পানিতে আয়রনের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে আয়রনজনিত স্তর তৈরি হয়ে থাকে। এটি সবসময় লালচে বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। আয়রনজনিত স্তর দূর করার জন্য পুকুরে প্রতি শতকে ২০০ গ্রাম চুন এবং ৫০-১০০ গ্রাম হারে ফিটকিরি ব্যবহার করা যেতে পারে।
ঙ) আগাছা নিয়ন্ত্রণ: যে কোনো ধরনের জলজ আগাছা আধা নিবিড় চিংড়ি চাষে একটি বিশেষ সমস্যা। তাই দৈনিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কায়িক শ্রম দ্বারা আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
চ) পানিতে শামুক ঝিনুকের প্রকোপ/উপদ্রব বেশি পরিমাণ শামুক ঝিনুকের উপস্থিতি লক্ষ্য করলে শক্ত ডালপালা বা তালপাতা পুকুরের পানিতে পুতে দেওয়া যেতে পারে। এসব ডালে শামুক আশ্রয় নিলে পাড়ে ভুলে মেরে ফেলতে হবে। এছাড়া শামুক নিয়ন্ত্রণের জন্য পুকুরে ব্লাক কার্প মাছ ছাড়া যেতে পারে,কারণ এরা খাবার হিসেবে শামুক গ্রহণ করে থাকে।
ছ) অবাঞ্ছিত মাছসহ রাক্ষুসে মাছ দূরীকরণ: পুকুরে বার বার জাল টেনে যত দূর সম্ভব সকল অবাঞ্ছিত মাছ ধরে ফেলতে হবে। এরপর অবশিষ্ট সব মাছ ধরে ফেলার জন্য প্রতি শতক আয়তন ও প্রতি ফুট পানির গড় গভীরতার জন্য ২৫-৩০ গ্রাম হারে রোটেনন প্রয়োগ করতে হবে।
জ) কাঁকড়ার উপদ্রব: যদি ঘেরের পানিতে কাঁকড়ার উপদ্রব হয় তাহলে ক্যালসিয়াম কার্বাইড ট্যাবলেট ব্যবহার করা যেতে পারে।
চিংড়ির একক চাষ হচ্ছে এরুপ একটি চিংড়ি খামার পরিদর্শন কর এবং এর কর্ম পরিবেশ ও উৎপাদন সংক্রান্ত বিষয়ে নিম্নোক্ত ছক পুরণ কর।
পরিদর্শনকৃত চিংড়ি খামারের নাম | |
ঠিকানা | |
কর্মরত কর্মীগণ কর্তৃক ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামসমূহের নাম লিখ | |
বাগদা চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে পানির গুণগতমান | |
পুকুরে প্রয়োগকৃত সার ও খাদ্যের পরিমাণ | |
চিংড়ির খামারের পরিবেশ (ময়লা ও দুষিত পানির অনুপ্রবেশ) | |
ঝাকিজাল দিয়ে চিংড়ি সংগ্রহ করে চিংড়ির নিয়মিত স্বাস্থ্য ও বৃদ্ধির হার পরীক্ষা | |
নাম | |
শ্রেণি | |
রোল নং | |
প্রতিষ্ঠানের নাম | |
শ্রেণি শিক্ষকের নাম | |
| প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শ্রেণি শিক্ষকের স্বাক্ষর |
চিংড়ির একক চাষ হচ্ছে এরুপ একটি চিংড়ি খামার পরিদর্শন কর এবং চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের উপায় সংক্রান্ত বিষয়ে নিম্নোক্ত ছক পূরণ কর।
পরিদর্শনকৃত চিংড়ি খামারের নাম | |
ঠিকানা | |
চিংড়ি খামারের পানির ভৌত ও রাসায়নিক পুণাগুণ | |
খামারের ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে গৃহীত কার্যক্রমসমূহ | |
প্রয়োগকৃত সুষম সম্পুরক খাদ্যের পরিমাণ এবং খাদ্য প্রয়োগের সময় | |
রোগ দমনে ব্যবহৃত রাসায়নিক দ্রব্যের নাম | |
খামারে ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও উপকরণগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ | |
খামারে কাজের পরিবেশ | |
নাম শ্রেণি রোল নং প্রতিষ্ঠানের নাম | |
শ্রেণি শিক্ষকের নাম | |
প্রতিবেদন জমাদানের তারিখ | শ্রেণি শিক্ষকের স্বাক্ষর |
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
১. প্রমান সাইজের একটি এ্যাপ্রোন
২. মাঝারি সাইজের এক জোড়া হ্যান্ড গ্লোভস
৩. তিনস্তর বিশিষ্ট একটি মাস্ক
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
১। মিটার স্কেল
২। থার্মোমিটার
৩। পিএইচ মিটার
৪। দ্রবীভূত অক্সিজেন মিটার
৫। রিফ্লাক্টোমিটার
৬। অ্যামোনিয়া টেস্ট কীট
৭। প্লাস্টিকের গামলা
৮। প্লাস্টিকের বালতি
৯। পাতিল
১০। লিটমাস পেপার
১১। স্কুপনেট
১২। টিস্যু পেপার
১৩। মাঝারি মাপের গামছা
১৪। খাতা পেন্সিল
(গ) কাজের ধারা
১। পুকুরের পানিতে থার্মোমিটার ব্যবহার করে পানির তাপমাত্রা নির্ণয় করো।
২। পিএইচ মিটার বা লিটমাস পেপার দিয়ে পানির পিএইচ নির্ণয় করো।
৩। দ্রবীভূত অক্সিজেন মিটার দ্বারা পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ নির্ণয় করো।
৪। রিফ্লাক্টোমিটারের সাহায্যে পানির লবণাক্ততা পরিমাপ করো।
৫। অ্যামোনিয়া টেষ্ট কীট ব্যবহার করে পানিতে দ্রবীভূত অ্যামোনিয়ার পরিমাণ নির্ণয় করো।
সতর্কতা
১) দক্ষ টেকনিশিয়ান এবং জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি দ্বারা পানির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
২) পর্যবেক্ষণের সময় যত্ন সহকারে প্রতিটি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে।
৩) পর্যবেক্ষণের সময় পানিতে বসবাসকারী চিংড়ি যেন পীড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৪) পানির ভৌত রাসায়নিক গুণাগুণ নির্ণয়ের পর ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত করে নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
আত্মপ্রতিফলন
পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুণাগুণ নির্ণয়ে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
১. প্রমান সাইজের একটি এ্যাপ্রোন
২. মাঝারি সাইজের এক জোড়া হ্যান্ড গ্লোভস ৩. তিনস্তর বিশিষ্ট একটি মাস্ক।
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ডিসেক্টিং বক্স
অনুবীক্ষণ যন্ত্র
পাতিল
স্কুপনেট
মাঝারি মাপের গামছা
খাতা পেন্সিল
প্লাস্টিকের গামলা
টিস্যু পেপার
প্লাস্টিকের বালতি
বাগদা চিংড়ি
(গ) কাজের ধারা
ক) বাহ্যিক অঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে রোগাক্রান্ত চিংড়ি শনাক্তকরণ
১. বাইরের খোলস বা শিরবক্ষ এলাকায় ক্যারাপেসে কালো বা বাদামি রঙের ফাটল কি না শনাক্ত করো।
২. ফুলকার রং বাদামি বর্ণের কি না শনাক্ত করো।
৩. হালকা সাদা রঙের বহিঃকঙ্কাল দেখা যায় কি না চিহ্নিত করো।
৪. চক্ষু দণ্ডের বর্ণ ছাই ও সোনালী রঙের হলে আলাদা করো।
৫. ফুলকা কমলা, হলুদ, লাল বা তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে কি না শনাক্ত করো।
৬. খোলস ফ্যাকাসে এবং শক্ত হলে আলাদা করো।
৭. পদ, উপাঙ্গ, ইউরোপড ও প্লিওপড়ে কালো দাগের মতো দেখা যায় কি না চিহ্নিত করো।
৮. দেহ শক্ত বা বেঁকে গেলে আলাদা করো।
৯. লেজ নিচের দিকে হেলে পড়েছে কি না এবং ভালোভাবে সংকোচন ও সম্প্রসারিত হয় কি না শনাক্ত করো।
১০. খোলসের নিচে দলবদ্ধ অবস্থায় ছোট ছোট সাদা ফোঁটার মতো দাগ আছে কি না চিহ্নিত করো।
১১. চিংড়ির দেহ নোংরা দেখালে ফাউলিং এর আক্রমণ হিসেবে শনাক্ত করো।
১২. লেজের অংশে ফোঁটা ফোঁটা দাগ ও স্ফীতি আছে কি না চিহ্নিত করো।
খ) পরিবেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রোগ শনাক্তকরণ
১. আকস্মিকভাবে পানির রঙের পরিবর্তন হলে।
২. পানির রং কালচে এবং ওপরে বুদবুদের সৃষ্টি হলে।
৩. খামারে হঠাৎ চিংড়ি মারা গেলে।
৪. খামারের আশেপাশে পঁচা ডিমের মত গন্ধ পেলে বোঝা যাবে যে পানির নিচে পঁচা জৈব পদার্থ জমেছে।
৫. পানির তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সে. এর ওপরে হলে।
৬. প্রবল বাতাসের সময় পানির উপরে ভাসমান স্তর পড়লে।
৭. পানির পিএইচ মাত্রা কম-বেশি হলে।
৮. পানির স্বচ্ছতা কম-বেশি হলে।
গ) মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে রোগ শনাক্তকরণ
নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে আনুবীক্ষণিক ছবি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও রোগ শনাক্ত করা যায়।
সতর্কতা
১) দক্ষ টেকনিশিয়ান দ্বারা রোগাক্রান্ত চিংড়ি শনাক্ত করতে হবে।
২) শনাক্তের সময় প্রতিটি চিংড়ি যত্ন সহকারে পানি থেকে তুলতে হবে এবং শনাক্ত শেষে যত্ন সহকারে পানিতে ছাড়তে হবে। চিংড়ি যেন পীড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৩) রোগ শনাক্তের আগে ও পরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে এবং কাজ শেষে নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
আত্মপ্রতিফলন
রোগাক্রান্ত বাগদা চিংড়ি শনাক্তকরণে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
পারদর্শিতার মানদন্ড
(ক) ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম
১. প্রমান সাইজের একটি এ্যাপ্রোন
২. মাঝারি সাইজের এক জোড়া হ্যান্ড গ্লোভস
৩. তিনস্তর বিশিষ্ট একটি মাস্ক।
(খ) প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ
ডিসেক্টিং বক্স
প্লাস্টিকের বালতি
টিস্যু পেপার
অনুবীক্ষণ যন্ত্ৰ
পাতিল
খাতা পেন্সিল
প্লাস্টিকের গামলা
স্কুপনেট
বাগদা চিংড়ি
(গ) কাজের ধারা
ক) লক্ষণ দেখে ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ শনাক্তকরণ
১. শরীরের একাধিক স্থানে বা খোলসে কালো দাগ পরিলক্ষিত হলে।
২. খোলস সহজে ভেঙে গেলে।
৩. চিংড়ির লেজ নিচের দিকে হেলে পড়লে এবং কালো বর্ণ ধারণ করলে।
৪. লেজের অংশে ক্ষয় হলে অথবা লেজের মাংস পেশীতে পচন ধরলে এবং পচে যাওয়া অংশ লাল বর্ণ ধারণ করলে।
৫. খোলসের নিচে কালো চ্যাপ্টা দাগ দেখা গেলে।
৬. লেজের ধারসমূহ বিবর্ণ হয়ে পড়লে।
ঘ) লক্ষণ দেখে ভাইরাসজনিত রোগ শনাক্তকরণ
১. বর্ণ ফ্যাকাসে বা লালচে হলে।
২. খোলসের নিচে সাদা ক্যালসিয়াম লবণ জমা হলে।।
৩. শিরবক্ষ এলাকা হলুদ বর্ণ ধারণ করলে।
৪. যকৃত, খাদ্যনালী ও অগ্ন্যাশয় গ্রন্থিতে ভাইরাস শনাক্ত হলে
৫. চিংড়ির গায়ে, মাথায় ও খোলসে সাদা দাগ দেখা গেলে।
গ) লক্ষণ দেখে ছত্রাকজনিত রোগ শনাক্তকরণ
১. ফুলকায় ময়লা জমে দুর্গন্ধ হলে।
২. ফুলকার বর্ণ কালো বা বাদামি হলে ।
৩. ফুলকায় কালো স্পট (Black gill disease) দেখা গেলে।
৪. স্যাপ্রোলেগনিয়ার (Saprolegnia sp.) আক্রমণে ফুলকার ল্যামিলি নষ্ট হয়ে গেলে।
৫. খোলসের গায়ে অনেক ছিদ্র দেখা গেলে।
৬. মস্তিষ্কের গোড়ায় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ক্ষত দেখা গেলে।
ঘ) লক্ষণ দেখে পরজীবীজনিত রোগ শনাক্তকরণ
১. চিংড়ির স্বাভাবিক শ্বসন প্রক্রিয়া, চলাফেরা ও খোলস বিবর্তনে বাধার সৃষ্টি হলে।
২. দেহ দেখতে বিবর্ণ হয়ে গেলে।
৩. বহিঃ পরজীবীর আক্রমণে চিংড়ি পুকুরের কোনো শক্ত বস্তুর সাথে গা ঘষতে থাকলে।
৪. আক্রান্ত স্থানে ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের আক্রমণ পরিলক্ষিত হলে।
ঙ) পুষ্টিহীনতা বা খাদ্যের অভাবজনিত রোগ শনাক্তকরণ
১. চিংড়ির দেহের আবরণ ও মাংস নরম হয়ে পড়লে।
২. শিরবক্ষ খোলসের নিচের মাংস ও পর্দা কালচে বর্ণ ধারণ করলে (Soft shell disease) |
৩. ফুলকা ও শরীর প্রথমে হলুদ ও পরে লাল বর্ণ ধারণ করলে (Red colonation disease)
৪. লেজ ও উপাঙ্গ লালচে রঙের দেখা গেলে।
৫. উদর খাদ্য শূন্য থাকলে।
৬. যকৃত ও অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি ছোট হয়ে গেলে ও নষ্ট হয়ে গেলে।
৭. উদর ও লেজের মাংসপেশী সংকুচিত হলে।
সতর্কতা
১) দক্ষ টেকনিশিয়ান দ্বারা রোগাক্রান্ত চিংড়ির রোগ শনাক্ত করতে হবে।
২) শনাক্তের সময় প্রতিটি চিংড়ি যত্ন সহকারে পানি থেকে তুলতে হবে এবং শনাক্ত শেষে যত্ন সহকারে পানিতে ছাড়তে হবে। চিংড়ি যেন পীড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৩) রোগ শনাক্তের আগে ও পরে ব্যবহৃত সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে যেন এগুলো থেকে পরবর্তীতে আর কোনো রোগ ছড়াতে না পারে।
৪) কাজ শেষে জীবাণুমুক্ত করা সকল জিনিসপত্র নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।
আত্মপ্রতিফলন
চিংড়ির রোগের কারণ শনাক্তকরণে দক্ষতা অর্জিত হয়েছে/হয় নাই/আবার অনুশীলন করতে হবে।
অতিসংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন :
১। বাগদা চিংড়ির বৃদ্ধির জন্য আদর্শ তাপমাত্রা কত?
২। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের আদর্শ পরিমাণ কত?
৩। পানিতে অ্যামোনিয়া বেড়ে গেলে করণীয় কী?
৪। ঘেরের পানির পিএইচ সকালের দিকে কত থাকা উচিত?
৫। ঘেরের পানির খরতা কত থাকা উচিত?
৬। বাগদা চিংড়ি চাষের জন্য পানির লবণাক্ততা কত থাকা উচিত?
সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রশ্ন:
১। বাগদা চিংড়ির রোগের কারণগুলো কী কী?
২। রোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত কয়েকটি এন্টিবায়োটিকের নাম লেখ।
৩। চিংড়ির রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত কয়েকটি নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকের নাম লেখ।
৪। পানিতে শামুক ঝিনুক বেড়ে গেলে কী করা উচিত?
৫। পানিতে কাঁকড়ার উপদ্রব বাড়লে করণীয় কী?
৬। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ বৃদ্ধির উপায় কী কী?
৭। বাগদা চিংড়ির রোগ দমনের জন্য ব্যবহৃত কয়েকটি রাসায়নিক দ্রব্যের নাম লেখ।
রচনামূলক প্রশ্ন :
১। বাগদা চিংড়ির রোগ প্রতিরোধের উপায়সমূহ বর্ণনা করো।
২। বাগদা চিংড়ির স্বাস্থ্য রক্ষায় হ্যাচারিতে পানির গুণাগুণ সংক্ষেপে বর্ণনা করো।
৩। রোগাক্রান্ত বাগদা চিংড়ির লক্ষণসমূহ লেখ।
৪। বাহ্যিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে বাগদা চিংড়ির রোগ শনাক্ত করবে?
৫। ভাইরাসজনিত যে কোনো দু'টি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা বর্ণনা করো।
৬। ব্যাকটেরিয়াজনিত যে কোনো দু'টি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা বর্ণনা করো ।
৭। ছত্রাকজনিত যে কোনো দু'টি রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা বর্ণনা করো।
৮। বাগদা চিংড়ি চাষকালে উদ্ভুত সমস্যা ও সমাধানের উপায়সমূহ বর্ণনা করো।
আরও দেখুন...